এমন এক দেশের কথা ভাবুন, যেখানে হরেক ভাষার, হরেক রঙের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেঁটে বেড়ায়। এমন এক দেশের কথা ভাবুন, যেখানে এ মানুষেরা অবিরাম আনন্দ নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে ছবি আঁকে, ভাস্কর্য বানায়, পাপেট শো করে, শিল্প নিয়ে বিতর্ক করে। এমন এক দেশের কথা ভাবুন, যেখানে শিল্পীর হাতে গড়া বুনন প্রত্যক্ষ ও শিল্পের রস আস্বাদন করতে ছুটে আসে হাজারো অনুরাগী।
অপ্রত্যাশিত হলেও সত্য যুদ্ধ, অবিচার, লুণ্ঠন ও নৈরাজ্যের এ পৃথিবীতে এখন আর শুধু শিল্প ও শিল্পীদের দিয়ে সাজানো এ রকম একটি দেশ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে শিল্পীরা চাইলেই যে সব সম্ভব, তা তারা নানাভাবে, নানা ঢঙে সম্ভবপর করে তোলার সামর্থ্য রাখেন। এর বড় উদাহরণ ঢাকা আর্ট সামিট। এ আয়োজন যেসব উপাদান দিয়ে সাজানো হয়, তাতে প্রতিবার ক্ষণিকের জন্য হলেও শিল্প দিয়ে ঘেরা কাঙ্ক্ষিত এক ‘দেশ’কে প্রত্যক্ষ করা যায়।
বরাবরের মতো এবারো সে রকম একটি আয়োজন নিয়ে হাজির হতে যাচ্ছে ঢাকা আর্ট সামিট। আগামী শুক্রবার থেকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে শুরু হবে ঢাকা আর্ট সামিটের পঞ্চম সংস্করণ। নয় দিনব্যাপী এ আয়োজনের উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। এবারের সামিটের প্রতিপাদ্য ‘সঞ্চারণ’। এ বছরের আসরে স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ৪৪ দেশের পাঁচ শতাধিক চিত্রশিল্পী-ভাস্কর, কিউরেটর, শিল্প-সমালোচক, আর্ট প্রফেশনাল, শিল্প সংগ্রাহক, স্থপতি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করবেন।
গতকাল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা আর্ট সামিটের এবারের আয়োজন নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা রাজীব সামদানী ও নাদিয়া সামদানী। এ সময় প্রদর্শনীর বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন সামিটের অন্যতম কিউরেটর চিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী।
পঞ্চম ঢাকা আর্ট সামিট সাজানো হয়েছে সলো আর্ট এক্সিবিশন, পাবলিক আর্ট প্রজেক্ট, কিউরেটেড এক্সিবিশন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, একক ও দলবদ্ধ বক্তৃতা, নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, লাইভ আর্ট পারফরম্যান্স, পাপেট শো, প্রিন্টমেকিং ওয়ার্কশপসহ শিল্প ও শিল্পকলার নানা বিষয় দিয়ে। এছাড়া থাকবে শিল্পবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। থাকছে ‘মুজিব বর্ষ’ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুর্লভ আলোকচিত্রের বিশেষ প্রদর্শনী। এ বছর সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ড হিসেবে থাকছে রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম।
সামিটের পুরো আয়োজনের জন্য প্রধান ভেনু হিসেবে ব্যবহার করা হবে ১ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট আয়তনের শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা ভবনকে।
৭ ফেব্রুয়ারি উৎসবের উদ্বোধনী দিন প্রথম পারফম্যান্স অনুষ্ঠিত হবে চিত্রশালার ছয় নম্বর গ্যালারিতে। এদিন সকাল ১০টায় সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ড পারফরম্যান্সে অংশ নেবেন বাংলাদেশী শিল্পী আরিফুল কবির। একই দিন সন্ধ্যা ৭টায় একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা প্লাজায় ‘টুগেটার (ঢাকা সংস্করণ)’ শিরোনামে
পারফরম্যান্স অনুষ্ঠিত হবে।
এবারের সামিটে অংশ নেয়া শিল্পী, সমালোচক ও আলোচকদের মধ্যে রয়েছেন দিলারা বেগম জলি, রোকেয়া সুলতানা, সেলিমা কাদের চৌধুরী, লুইস হ্যান্ডারসন, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, আরিফুল কবির, ইয়াসমিন জাহান নূপুর, হেক্টর জামোরাহ, আয়ো আকিনবেদ, রেহানা জামান, এসি এশুন, ড. অর্ণব বিশ্বাস, সাজেদুল হক, অ্যানা পাই, আনিয়কায় ইগনে, ফায়হাম ইবনে শরীফ, আলফ্রেড সান্টানা, শিন অ্যান্ডারসনসহ আরো অনেকে।
ঢাকা আর্ট সামিট নিয়ে এর অন্যতম উদ্যোক্তা ও সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক নাদিয়া সামদানী বলেন, ‘ঢাকা
আর্ট সামিট একটি অলাভজনক পদক্ষেপ। এখানে দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত শিল্পী ও বহির্বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গ্যালারিগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পঞ্চমবারের মতো এ আয়োজন একই ছাদের নিচে শিল্পকলা প্রদর্শনীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ও শিল্পরসিকদের উপভোগের দুর্লভ সুযোগ এনে দিচ্ছে।’
এবারের সামিটে বাংলাদেশী শিল্পীদের জন্য কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করছেন চিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী। তার তত্ত্বাবধানে ‘রুটস’ বা ‘শেকড়’ শিরোনামে এক বিশেষ প্রদর্শনী রয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, এসএম সুলতান, কামরুল হাসানসহ বরেণ্য শিল্পীদের জীবনকর্ম তুলে ধরা হবে বিশেষ এ প্রদর্শনীতে। ঢাকা আর্ট সামিটে অংশ নেবে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, ফ্রান্স, ইতালি, ইরান, শ্রীলংকা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের নিয়ে বিভিন্ন আর্ট প্রজেক্ট।
ঢাকা আর্ট সামিটের সার্বিক দায়িত্বে আছেন সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক নাদিয়া সামদানী। এছাড়া দেশী-বিদেশী ৩২ জন কিউরেটরের সমন্বয়ে গঠিত ঢাকা আর্ট সামিটের চিফ কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করছেন সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট। তার সঙ্গে আছেন রুক্সমিনি আর কিউ চৌধুরী ও তেরাসা আলবর।
উল্লেখ্য, সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন প্রথমবারের মতো ঢাকা আর্ট সামিট আয়োজন করে ২০১২ সালে। দক্ষিণ এশীয় শিল্পকর্ম প্রদর্শনীবিষয়ক ও চিত্রকলার সবচেয়ে বড় আয়োজন বলা হয় ঢাকা আর্ট সামিটকে। যেখানে অংশ নেন দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের পাশাপাশি উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীরা।
এ উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে যে কেউ প্রদর্শনী ঘুরে দেখতে পারবেন নিবন্ধন ছাড়াই।