গল্পের শুরু একটা হত্যাকাণ্ড দিয়ে। নদীর পাড়ে টঙঘর মতো জায়গা। তার কাছেই বস্তাবন্দি মরদেহ। শুরুতেই দর্শকের মনোযোগ টেনে নেন পরিচালক। কেন খুন হলো, কীভাবে হলো, তা জানার আগেই দর্শককে প্রদীপের কাছে নিয়ে যান তিনি। প্রদীপ স্বরূপকাঠির একজন মাস্তান। গডফাদারের নির্দেশমতো সে কাজ করে। হুমকি থেকে শুরু করে খুন অবধি করতে তার হাত কাঁপে না। কিন্তু সেসব অতীত। প্রদীপ এসব কাজ ছেড়ে দিয়ে দোকান করে। সুপ্তিকে নিয়ে সংসার করতে চায়। কিন্তু আর পাঁচটা ক্রাইম থ্রিলার বা বাস্তবতার মতোই অপরাধের দুনিয়া সহজে ছাড়ে না প্রদীপকে। একটা সময় ফেরারি হতে হয় তাকে।
কিঙ্কর আহসানের উপন্যাস ‘রঙিলা কিতাব’ অবলম্বনে একই নামে সিরিজ নির্মাণ করেছেন অনম বিশ্বাস। পোস্টার বলছে রঙিলা কিতাব একটা ‘রক্তরাঙা প্রেমের কিসসা’। কিন্তু সিরিজ দেখতে বসার পর গল্প যতই এগোতে থাকে, দেখা যায় এটা মূলত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতার গল্প। আট পর্বের সিরিজে অন্তত চারটি চরিত্র স্বরূপকাঠি শহরের সর্বময় ক্ষমতা নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তা নিয়েই গল্প আবর্তিত হয় এবং প্রদীপ সেখানে একজন ফুট সোলজার।
তার গল্পকে ঘিরেই আবর্তিত হয় রঙিলা কিতাব। সে এমপিকে হুমকি দিয়ে যায়, কিন্তু এমপি মারা যায় অজানা কারো গুলিতে। এর পর থেকে তাকে পলাতক থাকতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এ যাত্রায় সঙ্গী হয় তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সুপ্তি। কিন্তু সেখানে একের পর এক বাধা আসে।
গল্পটা প্রদীপকে ঘিরে হলেও অনম বিশ্বাসের রঙিলা কিতাবে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নওরোজ শাহ। তিনি স্বরূপকাঠির রাজনীতির পুরনো খেলোয়ার। প্রদীপকে লালন-পালন করেছেন। তারই আদেশে এমপিকে হুমকি দিতে যায় প্রদীপ। পরবর্তী ঘটনাবলীতে দর্শক দেখতে পায় নওরোজ শাহ ও আজম চৌধুরীর চাপান উতোর। স্বরূপকাঠির এমপি হতে চায় আজম, কিন্তু তার সে যোগ্যতা নেই। ব্যবসায়ী হিসেবে ভালো হলেও রাজনীতি সে রাজনীতির মতো করে করতে পারে না। ফলে ষড়যন্ত্রই করে যায়। সে কারণে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে। প্রদীপ বারবার মরতে মরতে বাঁচে।
রঙিলা কিতাবের গল্পের যে ধাঁচ তা বহু পুরনো। মারিও পুজোর গডফাদার ফর্মুলা অনুসারী এ গল্পের চিত্ররূপে মির্জাপুরের ভাইব আছে। এমনকি চইচই যেভাবে আবহসংগীত ও কলাকুশলীর নাম দেখায়, সে ধাঁচেও মিল পাবেন। রাজনীতির বিষয়টির সঙ্গে মিল পাবেন তাণ্ডবের। তবে আশা বা ইতিবাচক দিক হলো এ সিরিজের স্ক্রিনপ্লে ও সিনেমাটোগ্রাফি। স্ক্রিনপ্লে একটু ফাস্ট। কিছু জায়গায় দ্রুতই গোলাগুলি মারামারি শুরু হয়ে যায়। প্রদীপ একাধিক অ্যাকশন করে আট পর্বের সিরিজে। সেগুলো একটু নবিশ হলেও কাজ চালানোর মতো। মফস্বলের গুণ্ডা অবশ্যই কারাটে ফাইট করবে না।
দ্বিতীয় বিষয় সিনেমাটোগ্রাফি। গল্পের প্লট স্বরূপকাঠিতে। ফলে শহরটা ফুটিয়ে তোলা দরকার ছিল। শহর ফোটেনি আট পর্বে, কিন্তু নদী, নৌকা, ছোট জাহাজ, টঙঘর, স-মিল মিলে বোঝা গেছে জায়গাটা বরিশালের। বিশেষত প্রদীপ-সুপ্তির টিনের ঘরের সামনে বাঁধানো ‘শান’ ও ঘরের পাশে খাল দেখে বরিশালেরই সিগনিফিকেন্স প্রকাশ করে। এ ডিটেইল লক্ষ্য করার মতো। কিন্তু স্বরূপকাঠির হয়েও নওরোজ, প্রদীপ, আজম, হেলেনারা তুলনামূলক শুদ্ধ বা চলতি ভাষায় কথা বলে, বরিশালি টান না থাকাটা দৃষ্টিকটু।
প্রদীপ চরিত্রে মোস্তাফিজুর নূর ইমরান দারুণ কাজ করেছেন। তাকে অনাথ গুণ্ডাই মনে হয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্বাসী ও দুর্ধর্ষ। প্রেমিক ও স্বামী হিসেবে তিনি দর্শকের বাহ্বা পাবেন। পরীমণি দুই-এক জায়গায় অকারণ লাউড হয়ে উঠলেও অন্তঃসত্ত্বা সাধারণ গৃহবধূ হিসেবে ভালো কাজ করেছেন। পাফ ড্যাডির মতো কনটেন্টের পর এ রকম চরিত্র তাকে অভিনেত্রী হিসেবে এগিয়ে নেবে।
লোকাল পলিটিকস নিয়ে নির্মিত সিরিজ হিসেবে ভালো নম্বর পেতে পারে রঙিলা কিতাব। মূল গল্পে সব ধরনের উপাদান ও চরিত্র ছিল। পর্দায় সেসব উপাদান চরিত্ররা ধারণ করেছেন। সবচেয়ে ভালো করেছেন ফজলুর রহমান বাবু। নওরোজ শাহ চরিত্রে তিনি নিজেকে আবারো প্রমাণ করেছেন একজন অসাধারণ অভিনেতা হিসেবে। তানভিন সুইটিও ভালো করেছেন। ইরেশ জাকের তার চরিত্রটির মান রেখেছেন পুরোপুরি। মনোজ প্রামাণিককে আরেকটু ভালোভাবে উপস্থাপন করা যেত। তবে যেহেতু ক্লিফ হ্যাঙ্গারে শেষ হয় সিরিজ, ধারণা করা যায় পরের সিজনে তিনি ফিরবেন।
রঙিলা কিতাব মূলত রক্ত রঞ্জিত স্থানীয় রাজনীতির গল্প। সেখানে খুনখারাবি, প্রেম-প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র নিয়ে সিরিজটি স্বরূপকাঠিকে মির্জাপুর করে তুলেছে।