চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখা মানুষদের সংখ্যা কম নয়। শত সংকটকে জয় করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য নির্মাতা বানিয়েও ফেলছেন চলচ্চিত্র। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ সংখ্যাটি যেন বেড়েই চলেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নানা কারণে হাতেগোনা কিছু চলচ্চিত্রের বাইরে অধিকাংশই থেকে যায় পর্দার অন্তরালে। অথচ এ ছবিগুলোও সক্ষম ছিল সারা পৃথিবীর দর্শকদের হূদয় জয় করতে। চলতি দশকে নির্মিত এ রকম শক্তিশালী গল্প ও উপস্থাপনশৈলীসমৃদ্ধ সেরা ১০ চলচ্চিত্রের একটি তালিকা তৈরি করেছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হোম ভিডিও প্লাটফর্ম ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের চলচ্চিত্র সাময়িকী দ্য কারেন্ট। তাদের করা ‘চলতি দশকের গুপ্তধন’ শিরোনামে ১০টি চলচ্চিত্রের এ তালিকার চার নম্বর অবস্থানে রয়েছে রুবাইয়াত হোসেন নির্মিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র মেড ইন বাংলাদেশ। এর আগে এ নির্মাতা নির্মাণ করেছেন মেহেরজান ও আন্ডার কনস্ট্রাকশন নামের দুটি চলচ্চিত্র।
‘ক্রাইটেরিয়ন কালেকশন’ এ তালিকা তৈরির জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণে জড়িত কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতাকে যুক্ত করেছিল। যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, চলতি দশকে নির্মিত অসাধারণ গল্প ও প্রভাবসমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের ভেতর থেকে এমন ১০টি চলচ্চিত্রকে সামনে আনা, যেগুলো আরো বেশিসংখ্যক দর্শকের সামনে আসার দাবি রাখে এবং পৃথিবীর আরো বেশিসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে ছবিগুলো মুক্তি পাওয়ার সক্ষমতা এগুলোর ছিল।
এ তালিকা তৈরির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারকরা হলেন নির্মাতা শন বেকার, এরি এস্টন, লেসলি হ্যারিস, এলেক্স রস পেরি, ড্যানিয়েল স্মিথ, সুসান সিডেলম্যান, জুলি তৈমর ও গ্রেগ মোত্তোলার মতো প্রথিতযশা চলচ্চিত্র নির্মাতা।
মেড ইন বাংলাদেশ নিয়ে নিজের মতামত ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকর ও প্রযোজক লেসলি হ্যারিস। তিনি
লিখেছেন, ছবিটিতে চলতি দশকের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক বিষয়বস্তুরও উপস্থাপন। ছবিটিতে রুবাইয়াত দেখিয়েছেন, নানা শোষণ-বঞ্চনার মতো বাধাকে টপকে নারীরা কীভাবে আরো বেশি আত্মনির্ভরশীল ও সাহসী হয়ে উঠেছেন এবং সম্মানের সঙ্গে টিকে থাকার অভিপ্রায় রপ্ত করেছেন।
মেড ইন বাংলাদেশ ছবির প্রটাগনিস্ট চরিত্র শিমু। শিশু অবস্থায় তার মা তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দেয়ার পর শিমু বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। এরপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর থেকে শিমু নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলে—এমন গল্প তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে।
লেসলি হ্যারিস তার জবানিতে আরো বলেছেন, চলচ্চিত্রটির গল্প বলার ধরন এর প্রধান চরিত্রের মতোই শান্ত, সুসংহত ও পরিচ্ছন্ন; যা আমাদের মহান চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি আরো উল্লেখ করেন, এ দশকের গুরুতর কিছু সমস্যা প্রতিফলিত হয়েছে মেড ইন বাংলাদেশ-এ। যেমন শ্রমিকদের ওপর বৈশ্বিক শোষণ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও বাণিজ্যিক লোভ। এছাড়া রয়েছে এ দশকে ঘটে যাওয়া নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার নারীশক্তির জাগরণের মতো সর্বজনীন বিষয়ও।
এ বিচারকের মতে, লেখক ও নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেন নান্দনিক ও সিনেম্যাটিক ক্যামেরা মুভমেন্টের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ঢাকা শহরের উজ্জ্বল রঙের ছোঁয়া, প্রাণবন্ত বিন্যাস ও দগদগে ক্ষত। লেসলি আরো উল্লেখ করেন, এটি নারীদের সংহতি, বন্ধুত্ব এবং আশঙ্কার গল্প, যেখানে নারীরা পরস্পরকে সোচ্চার হতে উৎসাহিত করে। এটি এমন একটি ছবি, যা এ দশকের নারীশক্তির যে উত্থান তাকেই ধারণ করে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ৭১টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ছবিটি। পঞ্চম সপ্তাহে এসেও দেশগুলোর ৬৪ প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে ছবিটি। এছাড়া চলতি বছর কানাডা, আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে মুক্তির জন্য এরই মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ছবিটি। একই সঙ্গে বাংলাদেশেও মুক্তি দেয়ার পরিকল্পনা চলছে বলে জানিয়েছেন ছবিটির অন্যতম প্রযোজক আদনান ইমতিয়াজ আহমেদ।
পুরো বিষয়টি নিয়ে টকিজের সঙ্গে কথা হয় এ আদনানের। তিনি বলেন, ‘ভালো
গল্পে প্রতি বছর অসংখ্য ছবি নির্মিত হয়, যা আরো বেশিসংখ্যক মানুষের দোরগোড়ায় আসার দাবি রাখে। কিন্তু নানা কারণে এর অধিকাংশই সাধারণ দর্শকের নজরে আসতে পারে না। সে রকম ছবি নিয়েই দ্য কারেন্ট এ তালিকা করেছে। যাহোক, মার্কিন নির্মাতা লেসলি হ্যারিস মেড ইন বাংলাদেশ দেখেছেন এবং এ নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করে বলেছেন। তিনি বলেছেন, এটি তার দেখা সেরা ছবিগুলোর একটি। তার এ বক্তব্য আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে।’ পরের প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়, চলতি দশকের সেরা ১০টি ছবির তালিকায় মেড ইন বাংলাদেশ জায়গা পেয়েছে, কিন্তু এ ছবিটি মুক্তিই পেয়েছে একেবারেই সম্প্রতি। এ বিষয়টিকে কেমন হচ্ছে? ‘এ
বিষয়টি আমাদের কাছে অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। যদি তালিকার অন্য ছবিগুলোর নাম দেখা হয় তাহলে বোঝা যায়, সেগুলো খুবই ভালো গল্পের অথচ অনেকের চোখে পড়েনি।’
‘চলতি দশকের গুপ্তধন’ নামে ১০টি চলচ্চিত্রের এ তালিকায় আরো রয়েছে টমি লি জোন্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন পাম মনোনয়ন পাওয়া ছবি দ্য হর্সম্যান (২০১৪), ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি পুরস্কারজয়ী দুটি ছবি আলরিচ সেইডলের প্যারাডাইস: ফেইথ (২০১২), আনা লিলি আমানপোর পরিচালিত দ্য ব্যাড ব্যাচ (২০১৬), সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চিত্রনাট্য পুরস্কারজয়ী ম্যাট স্পাইসারের ইনগ্রিড গোজ ওয়েস্ট (২০১৮) ও নাডিন লাবাকির অস্কার মনোনীত ও কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি পুরস্কারজয়ী ক্যাপারনাম (২০১৮)।