প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেশপ্রেম

আশুতোষ সুজনের পরিচালনায় ২০২২ সালের নভেম্বরে মুক্তি পায় ‘দেশান্তর’। সিনেমাটি গভীরভাবে দেশের ইতিহাস, দেশপ্রেম ও শিকড়ের প্রতি ভালোবাসার গভীর অনুভূতিকে তুলে ধরে।

আশুতোষ সুজনের পরিচালনায় ২০২২ সালের নভেম্বরে মুক্তি পায় ‘দেশান্তর’। সিনেমাটি গভীরভাবে দেশের ইতিহাস, দেশপ্রেম ও শিকড়ের প্রতি ভালোবাসার গভীর অনুভূতিকে তুলে ধরে। এটি মূলত ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের পটভূমিতে নির্মিত। ওই সময় এ অঞ্চলের বহু মানুষকে নিজের শিকড়, পরিবার ও প্রতিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছিল। তবে সাধারণত যে ধরনের দেশভাগের গল্প আমরা দেখি, তার থেকে দেশান্তর একটু ভিন্ন। এটি তাদের গল্প, যারা দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসার জন্য নিজেদের মাতৃভূমি ত্যাগ করেনি। সিনেমাটি কবি নির্মলেন্দু গুণের একই নামের উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। আশুতোষ সুজন এ চ্যালেঞ্জকে নান্দনিকভাবে পর্দায় রূপ দিয়েছেন। এর চিত্রনাট্য রচনা করেছেন নুরুল আলম আতিক, ডালিম কুমার ও আশুতোষ সুজন।

সিনেমার প্রধান চরিত্র মহীন্দ্র ও তার মেয়ে মনসার জীবন। দেশান্তরের গল্প দর্শককে যে সফরে নিয়ে যায়, সেটা একই সঙ্গে কাল্পনিক ও বাস্তবনির্ভর। এ সিনেমা নবীন প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে আসে, যা তাদের দেশের ইতিহাসের প্রতি মনোযোগী করে তোলে। ভারত উপমহাদেশের বিভক্তির ইতিহাস ও এর প্রভাব আমাদের সমাজে এখনো বিদ্যমান। দেশের একটি অংশের জন্য অভিবাসন, নির্যাতন ও সংস্কৃতি হারানোর যে শঙ্কা তা সিনেমাটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

এ সিনেমায় আহমেদ রুবেলের মহীন্দ্র চরিত্রটি সেসব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা জীবনের নানা টানাপড়েনের মধ্যেও দেশের প্রতি তাদের আনুগত্য ধরে রেখেছিল। তার চরিত্রে যেমন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মধ্যে পড়া একজন মানুষের জীবনযুদ্ধ তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি দেশের প্রতি তার ভালোবাসা এক ধরনের আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। আহমেদ রুবেলের অভিনয় চরিত্রটির ভেতরের আবেগকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তার চোখের ভাষা, সংলাপের গভীরতা ও শারীরিক ভাষা প্রতিটি দৃশ্যে তার চরিত্রের মানসিক টানাপড়েনকে সামনে নিয়ে আসে। মহীন্দ্রর মা যখন মৃত্যুসজ্জায় মহীন্দ্রকে স্মরণ করিয়ে দেয় ‘তোর বাপ-দাদার সাত পুরুষের ভিটা ছাইড়া যাইও না রে বাপ’—তখনই এক অদ্ভুত দেশপ্রেম ও দায়বদ্ধতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

এ সিনেমায় মনসা চরিত্রটি একজন চঞ্চল ও স্বাধীন কিশোরীর। অভিনয় করেছেন টাপুর। মহীন্দ্র ও মনসার বাবা-মেয়ের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সিনেমার থিমগুলো জোরালোভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মহীন্দ্র চরিত্রটি দেশের মাটির প্রতি যে প্রেমময় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, তা মনসা চরিত্রের গভীর দেশপ্রেম তৈরিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ সম্পর্ক দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে, ‘দেশপ্রেম’ কি কেবল একটি শব্দ, নাকি এটি একটি জীবনযাত্রার অংশ? দুই চরিত্রের সংলাপ, আবেগ ও যোগাযোগের মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেশপ্রেমের প্রবাহ ঘটার স্বাভাবিক নিয়ম, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেও ছাড়িয়ে যায়।

সিনেমাটিতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন মৌসুমি, ইয়াশ রোহান ও সুভাশিষ ভৌমিকের মতো শক্তিশালী অভিনেতারা, যারা প্রতিটি দৃশ্যে নিজেদের কৃতিত্ব প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে, মৌসুমীর বাণিজ্যিক সিনেমার গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসা দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। তিনি তার অন্নপূর্ণা চরিত্রে পারিবারিক দায়িত্ববোধ ও দেশপ্রেমের মধ্যে থাকা কঠিন দ্বিধাকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

পরিচালক আশুতোষ সুজনের এক বিশাল সফলতা হলো, তিনি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কষ্ট ও মানুষের জীবনের ওপর তার প্রভাবকে বাস্তবসম্মতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সিনেমার গতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, যাতে গল্পের মর্মার্থকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়। অতিরিক্ত সংলাপ বা মেলোড্রামা ছাড়াই, দৃশ্য ও দৃশ্যপটের নীরবতাগুলো চলচ্চিত্রের আবেগকে আরো তীব্র করেছে।

সিনেমাটোগ্রাফিও অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। চিত্রগ্রাহক নেহাল কুরাইশী একটি শক্তিশালী দৃষ্টি নিয়ে প্রতিটি ফ্রেম দৃশ্যায়ন করেছেন, যা সিনেমায় প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করে। ছোটখাটো নান্দনিক উপাদানগুলো একান্তই ওই সময়কালের নিখুঁত উপস্থাপনা। মাটির বাড়ি, পুকুরের পাড় ও সে সময়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পোশাক ও আসবাবপত্র পুরো সিনেমার সময়কে জীবন্ত করে তোলে। সিনেমার সেটিং এ দেশভাগের শিকড় বিচ্ছিন্নতার বিষাদকে আরো গভীরভাবে প্রভাবিত করে, যা দর্শককে ইতিহাসের সঙ্গে আবেগময় সম্পর্ক উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।

সিনেমাটির সাউন্ড ডিজাইনও উল্লেখযোগ্য। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মাধ্যমে যে আবেগ সৃষ্টি করা হয়েছে, তা দর্শককে চলচ্চিত্রের মধ্যে আরো গভীরভাবে নিমজ্জিত করে। এছাড়া ‘আমার স্বপ্নের হাতে হাতকড়া’ গানটিও দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়।

দেশান্তর শুধু একটি বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র নয়। এটি দর্শককে মনে করিয়ে দেয় যে ইতিহাসের পাঠ শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের বর্তমানের সিদ্ধান্ত ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের ওপর এর গভীর প্রভাব রয়েছে। সার্বিকভাবে, ‘দেশান্তর’ একটি আবেগপূর্ণ ও চিন্তনীয় চলচ্চিত্র, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেশপ্রেমের প্রবাহের গল্প বলে। মনসা ও মহীন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক দেশপ্রেমের প্রকৃত রূপকে চিত্রায়িত করে। দেশান্তর আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে দেশপ্রেমের গল্প কখনো শেষ হয় না, বরং এটি অবিরাম যাত্রা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।

আরও