স্বপ্ন কিংবা বেহাত এক বিপ্লবের গল্প

পৃথিবীর প্রায় সব জাতির কাছেই বিপ্লবের হাওয়া এসেছিল। আর সবসময়ই বিপ্লবের কেন্দ্রে থাকে তরুণরা।

পৃথিবীর প্রায় সব জাতির কাছেই বিপ্লবের হাওয়া এসেছিল। আর সবসময়ই বিপ্লবের কেন্দ্রে থাকে তরুণরা। তাদের হাত ধরেই বিপ্লব আসে আর শেষ পর্যন্ত বিপ্লব ব্যর্থ বা বেহাত হলে বলিও হয় তারা। এরিখ মারিয়া রেমার্কের ‘দ্য রোড ব্যাক’, ইসমাইল কাদারের ‘জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’তে পাই যুদ্ধের পর যোদ্ধাদের বিষণ্নতার কাহিনী। সমরেশ মজুমদারের ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’ ও ‘কালবেলা’য় আছে বিপ্লব ব্যর্থ হওয়া তরুণদের গল্প। দেখা যায়, বিশ্বযুদ্ধ আর নকশাল আন্দোলনে তরুণদের ওপর প্রভাব সমাপতন হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এখানেও তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পড়েছিল নানা প্রভাব। একই রকম গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে আয়ারল্যান্ডে। তা নিয়েই নির্মিত ‘দ্য উইন্ড দ্যাট শেকস দ্য বার্লি’।

সিনেমার শুরু একটা হকি ম্যাচ থেকে। একদম ঘরোয়া খেলা। ডেমিয়ান, টেডি, এইডান ব্যস্ত খেলায়। ম্যাচ শেষে সবাই যায় শিনিডের বাড়ি আর সেখানেই তারা আক্রান্ত হয় ব্রিটিশ আর্মির দ্বারা। নিজের নাম ইংরেজিতে না বলায় ব্ল্যাক অ্যান্ড ট্যানসরা (ব্রিটিশদের নিযুক্ত আইরিশ আর্মির কনস্টেবল) উপর্যুপরি আঘাত করে হত্যা করে মাইকেল ও’সুলিভানকে। মেডিসিনে পড়াশোনা করা ডেমিয়েন মনে করত এখানে আর্মির সঙ্গে সহযোগিতা করে ইংরেজিতেই নাম বলা উচিত ছিল। কিন্তু টেডি তা মনে করে না। এজন্য টেডি যুক্ত হয় বিপ্লবের সঙ্গে। ট্রেনে চড়ে কাউন্টি কর্ক ছাড়ার সময় আর্মির সদস্যদের ট্রেনে চড়তে না দেয়া বিষয়ে রেলের গার্ড ও ড্রাইভারের প্রতিরোধ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডেমিয়েনও এক সময় যুক্ত হয় টেডির সঙ্গে বিপ্লবী দলে।

সিনেমার গল্পের সময়কাল ১৯১৯-১৯২৩ সাল। সে অনুসারেই অভিনেতা-অভিনেত্রীর পোশাক, আয়ারল্যান্ডের উপস্থাপন। কিলিয়ান মারফি অভিনয় করেছেন ডেমিয়েন চরিত্রে। টেডির চরিত্রে পেড্রিক ডেলানি। তাদের বিপ্লবী দলে আরো অনেকে ছিলেন। এদের কর্মকাণ্ড সেই চিরাচরিত গেরিলা দলের মতো। খুব সাধারণভাবে থাকা এবং সুযোগ পেলেই আর্মিদের অ্যাম্বুশ করা। তারপর আর্মির তরফ থেকে তাদের খোঁজ চলে। দলেরই একজন, মনিবের চাপে পড়ে দলের তথ্য ফাঁস করলে ধরা পড়ে কয়েকজন। তারপর জেলখানায় সমবেত সংগীত। সিনেমার এ দৃশ্যগুলো বাংলাদেশের দর্শককে মনে করিয়ে দেবে নকশাল আন্দোলনের কথা কিংবা পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ, ধরার পড়ার পরের অত্যাচার।

সফল হয়েছিল ডেমিয়েন-টেডি ও অন্যদের বিপ্লব। কিন্তু আর পাঁচটা বিপ্লবের মতো এখানেও প্রশ্ন ওঠে—উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছিল? পূরণ হয়েছিল স্বপ্ন?

দ্বিমতের সূত্রপাত একটি ‘সন্ধিচুক্তি’ দিয়ে। টেডি ও’ডনোভান সে চুক্তির পক্ষে। ১৯২১ সালের এ চুক্তি অনুসারে, আয়ারল্যান্ডকে অনেকটা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আইরিশ রিপাবলিকের সমর্থকদের একটা বড় অংশের দাবি ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা। এ সময় টেডি ও ডেমিয়েন আলাদা মত প্রকাশ করে। টেডির মতে, এ সন্ধির জন্যই তারা লড়েছিল। সে যুক্তি দেয়া, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এত বড় যে তারা এ মুহূর্তে আয়ার‍ল্যান্ডকে স্বাধীনতা দিয়ে অন্য উপনিবেশগুলোকে হারাতে চাইবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভারতে তখন শুরু হয়েছে স্বাধিকার আন্দোলন। এ সময় আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীনতা দিলে ভারত ও আফ্রিকার আন্দোলন আরো বেগ পাবে এবং তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হতে দেবে না। সে কারণে সন্ধিচুক্তিই মেনে নেয়া উচিত।

কিন্তু ডেমিয়েন, ড্যান (লিয়াম কানিংহ্যাম) ও শিনিডরা চায় পূর্ণ স্বাধীনতা। তারা যুক্তি দেয়—এ আধা স্বাধীনতার জন্য তারা লড়েনি। তাদের ভাইরা জীবন দেয়নি। সিনেমার এ দৃশ্যে বাংলাদেশী দর্শকের অবশ্যই মনে পড়ার কথা চল্লিশের দশকে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কাল ও পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকারের সময় তোলা ছয় দফা দাবি, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এমনকি চব্বিশের আন্দোলন। দাবি থেকে একটা অংশ কখনো সরে আসেনি। কিন্তু এরপর কী হয়? টেডি বনে যায় আইরিশ রিপাবলিক আর্মির অফিসার আর ডেমিয়েন চালিয়ে যায় তাদের বিপ্লব।

পল লেভার্টির গল্পে সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন কেন লোচ। খুব সাদামাটা সিনেমাটোগ্রাফির মধ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন আয়ারল্যান্ডের ল্যান্ডস্কেপ। কাউন্টি কর্কের বিপ্লবী দল ও দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে আসলে উঠে এসেছে সবসময়ের বিপ্লবের একটি বয়ান। সেখানে উদ্দেশ্য থাকে এক, কিন্তু বিপ্লব হয়ে গেলে বিপ্লবের সঙ্গে থাকা মানুষই বদলে যায়। যেমন বদলে গিয়েছিল টেডি। তাকে ক্ষমতালোভী মনে হয় না, কিন্তু একটা সময় সে নিজেই এস্টাবলিশমেন্টের হাতিয়ারে পরিণত হয়। একটা সময় ব্ল্যাক অ্যান্ড ট্যান্সরা যা করেছিল, পরে টেডিরাই তা শুরু করে। সে হয়ে ওঠে ক্ষমতার নতুন কেন্দ্র। টেডি-ডেমিয়েন-ড্যানরা যে উদ্দেশ্য থেকে কাজ শুরু করেছিল, তা পূরণ হয় না।

‘দ্য উইন্ড দ্যাট শেকস দ্য বার্লি’ নামটি নেয়া হয়েছে রবার্ট ডয়্যার জয়েসের লেখা একটি রণসংগীত থেকে। গানটি ১৭৯৮ সালের আইরিশ বিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা। আয়ারল্যান্ড ও তার মানুষের বিপ্লবকে তুলে ধরা সিনেমার নামটি দারুণ মিলেছে। সেই সঙ্গে এ সিনেমার ক্ষমতার বলয়কে প্রশ্ন করেছে, এমনকি প্রশ্ন করেছে চার্চকেও। চার্চের বিশপ যখন চুক্তির পক্ষে কথা বলে, তখন ডেমিয়েনসহ আরো অনেকে ওয়াক আউট করে এবং বের হওয়ার সময় বলে যায় ক্যাথলিকসহ অন্য চার্চও মূলত ধনী ও ক্ষমতাসীনদেরই পাশে থাকছে।

বিপ্লব বারবার আসে। কিন্তু বিপ্লবীরা একটা সময় ভুলে যায়, কেন তারা লড়েছিল। ‘দ্য উইন্ড দ্যাট শেকস দ্য বার্লি’ মনে করিয়ে দিতে চায় সে উদ্দেশ্যের কথা, যার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত হয় তরুণরা।

আরও