২০১৪ সাল। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা
হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন অং রাখাইন নামে একজন তরুণ নির্মাতা। ক্যারিয়ারের প্রথম
চলচ্চিত্র দিয়ে চমকে দিলেন সবাইকে। কারণ তার হাত ধরেই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের
মতো নির্মিত হয়েছিল চাকমা ভাষার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মর থেংগারি বা মাই
বাইসাইকেল। ছবিটি টানা কয়েক বছর বিশ্বের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উৎসবে অংশ নেয় এবং
অর্জন করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পুরস্কার। যদিও সেন্সর ছাড়পত্র না পাওয়ায় এখনো দেশের
প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মুক্তি পায়নি।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছেন অং রাখাইন। টকিজের মুখোমুখি হয়ে গতকাল প্রথমবারের মতো প্রকাশ করলেন, তার দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু ম্রো জনগোষ্ঠী। ছবির নামও রাখা হয়েছে ম্রো।
নতুন ছবি নিয়ে কথা প্রসঙ্গে অংয়ের কাছে কিছু প্রশ্ন রাখা হয়। চাকমার পর ম্রো জনগোষ্ঠী নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। কেন এবারো আপনার চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু নৃগোষ্ঠী প্রাধান্য পেল? ‘দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নৃগোষ্ঠী, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, বিচিত্র জীবনাচার ও সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য থাকার পরও এতদিনে কেউই বোধ করেনি এদের নিয়ে চলচ্চিত্র বানানোর। যাহোক, দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি হিসেবে ম্রো জনগোষ্ঠীকে বেছে নেয়ার কারণ হলো, এ মুহূর্তে সম্ভবত সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে এ জনগোষ্ঠী। হয়তো আগামী তিন-চার বছরের মধ্যেই তাদের অস্তিত্ব মুছে যাবে দেশ থেকে। তাদের আইডেন্টিটি নিশ্চিহ্নের এ বিষয়টি সবার নজরে আসা জরুরি। আমি অন্তত চাই না যে পাঁচ বছর পর তাদের দেখতে আমাকে জাদুঘরে যেতে হবে। আমি আমার ছবির মাধ্যমে দলিল আকারে তাদের অস্তিত্বকে ধরে রাখার চেষ্টা করব—বলেন অং।
আপনি নিজে রাখাইন জনগোষ্ঠীর মানুষ।
সেক্ষেত্রে তারা কেন আপনার দ্বিতীয় ছবির বিষয়বস্তু হলো না? ‘কারণ
রাইন জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে ম্রো জনগোষ্ঠী অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। নিজের জায়গা-জমি থেকে সরতে
সরতে তাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। ট্যুরিজম, উন্নয়নের নামে ধীরে ধীরে তাদের সবকিছু
দখল করা হচ্ছে। তাছাড়া নানা কারণে অনেকেই ধর্মান্তরিত হচ্ছে। ওদের ভাষাও বিপন্ন।
এখনই যদি বিষয়টি নজরে না আসে,
তাহলে তাদের নিঃশেষ হওয়া ঠেকানো সম্ভব নয়’—প্রশ্নের
উত্তরে অং।
শুরু থেকেই অং স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র
নির্মাণ করছেন। এক্ষেত্রে এ ছবি নির্মাণের ব্যাপারেও তিনি তার নিজস্বতাকেই গুরুত্ব
দিতে চান। অং জানালেন, প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় ছবি বানালে অবশ্যই সেখানে অন্যের চিন্তাকে
প্রাধান্য দিতে হয়। কিন্তু একজন শিল্পী হিসেবে তিনি তা মানতে নারাজ। এজন্য যথারীতি
এবারো ব্যক্তি উদ্যোগ ও ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে ছবিটি নির্মাণ করবেন। এ নিয়ে
অংয়ের বক্তব্য, ‘নিজেকে বিক্রি করতে পারব না। জানি আমার এ ছবির গল্পকে বহন করার মতো
মানসিকতা অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নেই। যে কারণে নিজেই মাঠে নেমেছি। এমনকি মাই
বাইসাইকেলের মতো এবারো আমি আমার স্ত্রীর ১০ ভরি গহনা বিক্রি করেছি। এছাড়া আমার
চিন্তাকে যারা সমর্থন দেন, তাদের সাহায্য নিচ্ছি। এর মধ্যে রয়েছেন নির্মাতা নূরুল আলম আতিক ও
সিনেমাটোগ্রাফার বরকত হোসেন পলাশ। আতিক ভাই সাউন্ড ও পলাশ ক্যামেরাবিষয়ক সহযোগিতা
দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত যে অবস্থায় আছি,
তা দিয়ে ছবিটা তৈরি করতে পারব। এছাড়া ইচ্ছা আছে
ছবিটির পুরো পোস্ট প্রডাকশন বিদেশে করব। মূলত তখন আন্তর্জাতিকভাবে ফান্ড রাইজের
চেষ্টা করব।’
অং জানিয়েছেন, ২০২১ সালের মার্চে ম্রোর শুটিং শেষ হবে। ছবিটির সঙ্গে যারা কাজ করছেন তারা অধিকাংশই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর। ছবিটির স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে আছেন রাজিব রাফি। এর দৈর্ঘ্য হবে ৯০ থেকে ১০০ মিনিট। মূলত ক্রিয়েটিভ ডকুমেন্টারি ফরম্যাটে ছবিটি বানানো হবে।
এ পর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে সামনে চলে এল
মাই বাইসাইকেল ছবি। অংয়ের সামনে তুলে ধরা হয়,
এ ছবি নিয়ে এখনো সংকটে আছেন তিনি। এর মধ্যে
আরেকটি নৃগোষ্ঠীভিত্তিক ছবি করতে যাচ্ছেন। এ পর্যায়ে থামিয়ে দিয়ে অং নিজেকেই উল্টো
প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘নির্মাতা হিসেবে আমি কি বাজার চাচ্ছি? আমি আমার সিনেমাটিই বানাব নাকি টাকা
রোজগারের জন্য বানাব? আমার প্রথম কথা হলো,
নিজের ছবি বানানোর ব্যাপারে শুরু থেকেই আমি
প্রতিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল। আমি যতদিন বাঁচব,
ততদিন চেষ্টা করব দেশের মূলধারার বাইরের
কমিউনিটির মানুষদের নিয়ে কাজ করার। এর সঙ্গে বাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি আমার
সিনেমাটা বানিয়ে যাব। তাছাড়া সিনেমা বানানো তো আমার প্রফেশন না। আমি আমার দৈনন্দিন
জীবনের সঙ্গে সিনেমার জীবনকে মেলাই না কখনো। আমি জানি, এ
কারণেই আমার সিনেমা আমি বানাতে পারব,
তা যত বাধাই আসুক না।’
নতুন ছবি নিয়ে কথাবার্তা একেবারেই শেষ প্রান্তে। ঠিক তখন অং আবারো কিছু একটা বলতে চাইলেন। এবং জানালেন, পূর্ণদৈর্ঘ্য হিসেবে ম্রো হতে যাচ্ছে তার দ্বিতীয় ছবি। কিন্তু শুধু সিনেমা হিসেবে এটি তার তৃতীয় ছবি। মাই বাইসাইকেলের পর তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি পোস্ট মাস্টার বানিয়েছেন। শেষ কথায় অং বললেন, ‘একজন নির্মাতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবি হলো তিন নম্বরটি। নির্মাতা বাঁচবে নাকি মরবে, তা বিচার হয় তার তিন নম্বর ছবি দিয়ে। যে কারণে বলতে চাই, আমার তিন নম্বর ছবিটি আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।’