চলে গেলেন অভিনেতা মনোজ কুমার

জাতীয় পুরস্কারের অর্থ দান করেছিলেন ভগৎ সিংয়ের পরিবারকে

বিপুল অমৃতলাল শাহ পরিচালিত সিনেমা ‘নমস্তে লন্ডন’। বলিউডের সিনেমায় দেশপ্রেমের কথা সবসময়ই আসে।

বিপুল অমৃতলাল শাহ পরিচালিত সিনেমা ‘নমস্তে লন্ডন’। বলিউডের সিনেমায় দেশপ্রেমের কথা সবসময়ই আসে। ২০০৫-০৯ সময়কালে প্রবাসীদের নিয়ে বেশকিছু সিনেমা নির্মাণ হয়েছিল। নমস্তে লন্ডন সে ধারারই। এ সিনেমায় একটা দৃশ্যে অক্ষয় কুমার একজন ইংরেজকে ভারতের নানা বিশেষত্ব জানান। এর মধ্যে দেশটির ভাষা, উন্নতি, সেনাশক্তি ইত্যাদির আলাপ ছিল। শেষে অক্ষয়ের অর্জুন সিং চরিত্রটি বলে, ‘আরো কিছু বিশেষত্ব আছে আমার দেশের। সেটা জানতে চাইলে আমি মনোজ কুমারের ‘‘পূর্ব-পশ্চিম’’ সিনেমার ডিভিডি পাঠিয়ে দেব।’

মনোজ কুমার। ভারতীয় সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক। তিনি বলিউডেরই নায়ক, কিন্তু একটা সময় জনপ্রিয় হয়েছিলেন পুরো ভারতেই। এর অন্যতম কারণ তার সিনেমাগুলোর বেশির ভাগই ছিল দেশপ্রেমমূলক। বিপুলের সিনেমাটিতে মূলত মনোজ কুমারকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল। এখনো নানা সময় তার সিনেমাগুলোর কথা ভারতের সিনেমার আলাপে উঠে আসে। সেই মনোজ কুমার চলে গেলেন।

গতকাল ৮৭ বছর বয়সে ধরাধাম ত্যাগ করলেন তিনি। গত সকালে মুম্বাইয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বিবিসির বরাতে জানা যায়, মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে মারা যান তিনি। ভারতীয় গণমাধ্যমকে মনোজ কুমারের ছেলে কুনাল গোস্বামী জানান, তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন।

১৯৩৭ সালে জন্ম মনোজ কুমারের। পাঞ্জাবের অ্যাবোটাবাদে (বর্তমান খাইবার পাখতুনখাওয়ার অন্তর্গত) ছিল তাদের আদি নিবাস। পাঞ্জাবি ব্রাহ্মণ পরিবারের এ সন্তানের পারিবারিক নাম হরিকৃষ্ণ গিরি গোস্বামী। ভারতভাগের পর তার পরিবার জানদিয়ালা শের খানে চলে আসেন। তিনি দিল্লির হিন্দু কলেজ থেকে কলা বিভাগে স্নাতক হন। ছেলেবেলা থেকে অশোক কুমার, দিলীপ কুমার ও কামিনী কৌশলের সিনেমা দেখে তাদের ভক্ত হয়েছিলেন হরিকৃষ্ণ। এক সময় তিনিও সিনেমায় অভিনয়ের চিন্তা করেন। এমনকি দিলীপ কুমারের অনুসরণে নিজের নাম বদলে ফেলেন। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পাওয়া শবনম সিনেমায় দিলীপ কুমারের চরিত্রের নাম ছিল মনোজ কুমার। হরিকৃষ্ণ গোস্বামী সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের নাম মনোজ কুমার করে নেন।

তার সিনেমার শুরুটা খুব একটা স্বস্তিদায়ক ছিল না। ১৯৫৭ সালে ‘ফ্যাশন’ নামের সিনেমা দিয়ে তার অভিষেক হয়। এরপর ১৯৫৮ সালে ‘সাহারা’, পরের বছর ‘চাঁদ’, ১৯৬০ সালে ‘হানিমুন’, ১৯৬১ সালে ‘কাচ কি গুড়িয়ায়’ অভিনয় করেন। এ সিনেমাগুলো সাফল্য পায়নি। প্রথম বাণিজ্যিক সাফল্য আসে ১৯৬২ সালে বিজয় ভাট পরিচালিত ‘হারিয়ালি অউর রাস্তা’ সিনেমা দিয়ে। বিপরীতে ছিলেন মালা সিনহা। এরপর ‘শাদি’, ‘ড. বিদ্যা’ও সফল হয়েছিল। তবে প্রথম বড় সাফল্য পান রাজ খোসলা পরিচালিত মিস্ট্রি সিনেমা ‘ওহ কউন থি?’র মাধ্যমে। সিনেমাটি সুপারহিট হয়। এ সিনেমারই গান ‘লাগ যা গলে’ আজও জনপ্রিয়। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া এ গান কম্পোজ করেছিলেন মদন মোহন। এরপর মনোজ কুমারের উত্থান শুরু। তারকা বনে যান তিনি।

১৯৬৫ সালে মনোজ কুমার অভিনয় করেন ভগৎ সিংয়ের চরিত্রে। সিনেমার নাম ‘শহীদ’। সিনেমাটি নিয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীও উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এরপর আসে ‘হিমালয় কি গোদ মে’, ‘গুমনাম’। ১৯৬৬ সালে ফের রাজ খোসলার পরিচালনায় ‘দো বদন’ সিনেমায় অভিনয় করেন আশা পারেখের বিপরীতে। সিনেমার গানগুলো জনপ্রিয় হয়। ‘সাওয়ান কি ঘাটা’য় অভিনয় করেন শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে।

১৯৬৫ সালে ইন্দো-পাক যুদ্ধের পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাকে দেশপ্রেমের সিনেমা নির্মাণের অনুরোধ করেন। সে অনুরোধ থেকে তৈরি হয় ‘উপকার’। বক্স অফিসের অল টাইম ব্লকবাস্টারের একটি এ সিনেমা। ‘মেরে দেশ কি ধরতি’ এখনো বাজানো হয় ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে। এরপর আরো অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে রোমান্টিক সিনেমাও ছিল। ‘পাত্থর কে সানাম’, ‘আদমি’, ‘দো রাস্তে’, ‘নীল কমল’ অন্যতম। তবে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন দেশপ্রেমমূলক সিনেমার জন্যই। এখনো মনোজ কুমারের সিনেমা নিয়ে কথা হলে ‘শহীদ’, ‘রোটি কাপড়া অউর মাকান’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘ক্রান্তি’, ‘উপকার’-এর নাম আসে।

বাস্তব জীবনেও তিনি দেশপ্রেমীই ছিলেন। শহীদ সিনেমায় অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু সে অর্থ নিজে রাখেননি। হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথোপকথনে নিজেই সে কথা জানিয়েছেন। মনোজ কুমার জানান, তিনি পুরস্কারের সব অর্থ দান করেছিলেন ভগৎ সিংয়ের পরিবারকে।

সিনেমায় অবদানের জন্য মনোজ কুমার বহু স্বীকৃতি পেয়েছেন। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাশাপাশি সাতটি ফিল্মফেয়ার পেয়েছেন। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রীতে ভূষিত করে। ভারতের সিনেমার সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড পান ২০১৫ সালে।

আরও