সপ্তম শতাব্দী, মধ্যপ্রাচ্যে তখন সাম্রাজ্য বিস্তারের মৌসুম। অথচ তরুণী লায়লার প্রেমে উন্মত্ত হয়ে পড়ে আরব তরুণ কায়েস। বুকে দুর্বিনীত প্রেম নিয়েও তাকে অবনত হতে হয় নিয়তির সামনে। অপ্রাপ্তি আর হতাশাকে তিনি গেঁথে রাখেন কবিতায়। প্রেমিকা লায়লা ও উন্মত্ত প্রেমিক কায়েসের সে গল্প ডালপালা গজিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। তারপর যত কবি প্রেম নিয়ে লিখেছেন, তারা স্মরণ করেছেন মজনুকে। লোককথা হয়ে মজনুর কীর্তি ছড়িয়ে গেছে বলকান থেকে বাংলা পর্যন্ত। নানা ভাষায়, নানা সংস্করণে। এমনকি ‘লাইলি-মজনু’র বসতবাড়ি পর্যন্ত মানুষ কল্পনা করে নিয়েছে নিজেদের চেনা অঞ্চলে। অসংখ্যবার কীর্তিত হওয়া সে গল্পকেই নতুন আঙ্গিকে সামনে এনেছেন ভারতীয় নির্মাতা সাজিদ আলী। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে তৈরি করেছেন তার ‘লায়লা মজনু’।
সাজিদ আলীর গল্পের পাটাতন কাশ্মীর। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে লায়লাকে নিয়ে মুগ্ধ এলাকার তরুণরা। কিছুটা কৌতূহল আর কিছুটা কৌতুকের ছলেই তার যোগাযোগ হয় কায়েসের সঙ্গে। ক্রমে লায়লার প্রেমে আচ্ছন্ন হতে থাকে কায়েস। লায়লাও এগিয়ে যায় অনেকটা পথ। কিন্তু বাধা হয়ে ওঠে কায়েসের পিতার সঙ্গে লায়লার পিতার দ্বন্দ্ব। লায়লার বাবা জোর করেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় নিজের রাজনৈতিক সহকারীর সঙ্গে। ক্রমে জট পাকাতে থাকে গল্প। যুক্ত হয় একের পর এক দুর্ঘটনা আর নতুন রহস্য। প্রিয়া হারানোর ব্যথা কিংবা ফের পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে আখ্যান, এগোতে থাকে কায়েসের সত্যিকার অর্থেই মজনু হয়ে ওঠা পর্যন্ত।
সিনেমা শুরু হয় মজনুর একটা উক্তি দিয়ে। লায়লার উৎকণ্ঠার জবাবে মজনু বলেছিল, ‘কী মনে হয় তোমার? এসব কি আমরা করছি? আমাদের আখ্যান আগে থেকেই লিখে রাখা। দুনিয়া, দুনিয়ার মানুষ এমনকি আমরা নিজেরাও সে কাহিনী বদলাতে পারব না।’ শেষ দৃশ্য পর্যন্ত সাজিদ আলী বাক্যে অটল ছিলেন।
পরিচালক হিসেবে সাজিদ আলীর প্রথম সিনেমা ‘লায়লা মজনু’। যদিও বলিউডে তার আত্মপ্রকাশ ভাই ইমতিয়াজ আলীর সহলেখক হিসেবে। ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া ককটেল সিনেমা বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। সেদিক থেকে দেখলে প্রথম প্রচেষ্টায়ই তিনি জানান দিয়েছেন নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান। লায়লা মজনু মুক্তি পায় ২০১৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথম দিকে খুব একটা সাড়া না ফেললেও ক্রমে চলে আসে আলোচনায়। গল্পের বুনন, অনবদ্য অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি ও মিউজিক বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা এর মধ্যেই ‘কাল্ট ক্ল্যাসিক’ হিসেবে তকমা দিয়ে ফেলেছেন। জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকায় ছয় বছর পর ৯ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো ফের মুক্তি পেল লায়লা মজনু।
সিনেমাটির প্রযোজনা করেছেন ইমতিয়াজ আলী। গানের সংখ্যা সব মিলিয়ে ১০। অরিজিৎ সিং, আতিফ আসলাম, মুহিত চৌহান, নিলাদ্রী কুমার, সুনিধি চৌহান, মুহম্মদ মুনিম, জয় বড়ুয়া ও দেবি নেগি তাদের সেরাটুকু ঢেলে দিতে কার্পণ্য করেননি। নিলাদ্রী কুমার এর মধ্যে দুটি পুরস্কারও ঝুলিতে তুলেছেন সিনেমার গানের কারণে। কিন্তু পুরো নির্মাণকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন লায়লা চরিত্রে থাকা তৃপ্তি দিমরি ও মজনু চরিত্রে থাকা অবিনাশ তিওয়ারি। অবিনাশের কথা আলাদা করে বলার মতো। কারণ লায়লার বিয়ের পর থেকে পরবর্তী প্রতিটা দৃশ্য যেন তিনি এককভাবে শাসন করেছেন। আরবি ‘মজনু’ শব্দের অর্থ উন্মাদ, সে হিসেবে অবিনাশের প্রতিটি অভিব্যক্তি ছিল অসামান্য। সম্ভবত এটুকু তার ক্যারিয়ারের সেরা অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে ভবিষ্যতে।
মজনু কারো কাছে মানবিক প্রেমের আদর্শ উদাহরণ, কারো কাছে আবার আধ্যাত্মিকতায় বুঁদ হওয়ার। এজন্য কেবল প্রণয়োপাখ্যান নয়, সুফি কবিতাও তৈরি হয়েছে তাদের আখ্যানকে কেন্দ্র করে। সুফিদের মধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে মাশুক বা প্রিয়তম হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা আছে। সাজিদ আলী তার মানবিক লোককাহিনীকে তুলে ধরার সময় সেই সুফি ভাইবটিকেও সমানভাবে চিত্রিত করতে চেয়েছেন। তার সফল স্বাক্ষর দেখা যায় বেশ কয়েকটি দৃশ্যে। তার মধ্যে একবার আত্মভোলা মজনু কল্পনার লায়লার সঙ্গে কথা বলতে বলতে নামাজরত জনতার সামনে চলে যায়। তার অজ্ঞতা দেখে মুসল্লিরা বিরক্ত হয় ও তাকে মারধর করে। সে সময় মজনুর জবাব ছিল চমৎকৃত হওয়ার মতো। মজনু বলে, ‘আমাকে কেন মারলে? আমি তো প্রিয়তমার সঙ্গে আলাপে বিভোর ছিলাম, এজন্য তোমাদের দেখিনি। কিন্তু তোমরাও তো তোমাদের মাশুকের সঙ্গে কথা বলছিলে। তাহলে আমাকে দেখলে কীভাবে?’
প্রেম নিয়ে আখ্যান জগতে কম নেই। কিন্তু কিছু প্রেমের আখ্যান ছাপিয়ে যায় ভাষিক ও আঞ্চলিক সীমারেখা। লায়লা মজনু তেমন এক কিংবদন্তি। মজনুর প্রেমে মগ্নতা মানব হৃদয়ের চূড়ান্ত প্রকাশ। সেটাকে সফলভাবে পর্দায় এনেছেন সাজিদ আলী। সিনেমার একপর্যায়ে মজনুকে জানানো হয় তার সামনে লায়লা দাঁড়িয়ে। জবাবে মজনু ভর্ৎসনার হাসি হাসে। উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, তার সামনেই যদি লায়লা হয় তাহলে চারপাশে ওরা কারা? প্রেমিক মজনু এবার যেন চারপাশে লায়লাকে দেখে। দেহী প্রেম হয়ে উঠেছে অবিনশ্বর। জগতের সমস্ত প্রেমিক যেন তখন মজনুর সঙ্গে সুর মিলায়, ‘হর জাগা বাস এক হি নাম, লায়লা’।