প্রতি বছরের মতো এবারো বসেছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবের আসর। বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাবান চলচ্চিত্র উৎসব এটি। এবার ছিল উৎসবের ৭৮তম আসর। গত শনিবার রাতে শেষ হলো উৎসব। নানা কারণেই এবারের আসর ভিন্নতা দেখিয়েছে। এমনকি সমাপনেও তা ধরে রেখেছে কান। প্রতি বছরই দর্শক ও সিনেমাসংশ্লিষ্টদের নজর থাকে স্বর্ণপামের (পাম ডি’অর) দিকে। এবার তা পেলেন ইরানি নির্মাতা জাফর পানাহি। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করছেন, এ পুরস্কার তারই যোগ্য। আরো একটি বিশেষ ঘটনা ঘটেছে এবারের উৎসবে। স্পেশাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড পেল আদনান আল রাজীব পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আলী’।
কান উৎসবের এবারের আসরে মূল প্রতিযোগিতায় ছিল বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আলী। কান উৎসবে বিভিন্ন ধরনের বিভাগ ও পুরস্কার আছে। কোনোটি সরাসরি কান কর্তৃপক্ষ দেয়, কোনোটি কানের পার্শ্ব বিভাগ বা ব্যবস্থাপনা থেকে আসে। তবে ‘স্পেশাল মেনশন’ সরাসরি কান উৎসবের জুরি থেকেই আসে। গতকাল সকালেই জানা গেল এ বিশেষ পুরস্কারটি পেয়েছে আলী। এর পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আদনান আল রাজীব ও আলীর টিমকে সবাই অভিনন্দন জানাতে শুরু করে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকেও আলী ও সিনেমার টিমকে অভিনন্দিত করা হয়েছে।
আলীর গল্প এক কিশোরকে নিয়ে। আলী নামের কিশোরটির জীবনসংগ্রাম, মানবিক সংকটের সঙ্গে উঠে এসেছে সমাজের প্রান্তিক মানুষের জীবনবাস্তবতা। নির্মাতা আদনান আল রাজীবের সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি ও আবেগময় বর্ণনায় ফুটে উঠেছে এক বাস্তবধর্মী ও গভীর মানবিক আখ্যান।
আলী প্রযোজনা করেছেন তানভীর হোসেন ও ক্রিস্টিন ডি লিওন (ফিলিপাইন)। সিনেমাটির লাইন প্রডাকশন কোম্পানি ‘রানআউট ফিল্মস’।
এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসব শুরু থেকেই ছিল রাজনৈতিক। প্রথম দিন আজীবন সম্মাননা পেয়েছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো। তিনি তার বক্তব্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসন নিয়ে সমালোচনা করেন। ট্রাম্পের কাজের প্রতিবাদ করেন। এরপর কান উৎসবেও আনা হয়েছিল বেশকিছু পরিবর্তন। যেমন পোশাকের ওপর বেশকিছু নীতিমালা আরোপ করা হয়। বলা হয়েছিল নগ্নতা রোখার জন্য এসব নিয়ম জারি হয়েছে। কিন্তু অনেকে মনে করেন, কোনো দেশ বা সংস্কৃতির পক্ষে-বিপক্ষে দাঁড়ানোর সুযোগ না দিতে এ কাজ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত বছর কেট ব্ল্যানচেট এমন পোশাক পরেছিলেন যা রেড কার্পেটে দাঁড়ানোর পর ফিলিস্তিনের পতাকাকে উপস্থাপন করেছিল।
এদিকে পানাহি ও তার সিনেমাকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমেও একটি রাজনৈতিক অবস্থান নিল কান কর্তৃপক্ষ। আবার একে সিনেমার পক্ষে দাঁড়ানোও বলা যায়। কেননা জাফর পানাহি জীবনভর সিনেমা নির্মাণ করতে চেয়েছেন এবং সেই সঙ্গে তিনি নিষ্পেষিত মানুষের কথাও বলতে চেয়েছেন। গত বছর ইরান থেকে নির্বাসিত হন তিনি। রীতিমতো সরকারের কোপ থেকে পালিয়ে বাঁচতে হেঁটে হেঁটে সীমান্ত পার করেছিলেন এ নির্মাতা। ২২ বছর পর কান উৎসবে অংশ নিয়েছেন তিনি।
জাফর পানাহিকে তার সর্বশেষ সিনেমা ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’-এর জন্য পাম ডি’অর দেয়া হয়েছে। সিনেমা বাহিদ নামের এক ব্যক্তিকে ঘিরে। সে একদিন কৃত্রিম পায়ের এক লোককে অপহরণ করে। কেননা লোকটি দেখতে তার পুরনো কোনো শত্রুর মতো। যে কিনা তাকে অত্যাচার করেছিল। এরপর বাহিদ আরো অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে, যারা ওই ব্যক্তির হাতে নির্যাতিত। মূলত ইরানে নানা ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতেই সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন জাফর পানাহি।
২০১০ সালে ইরানে প্রথম গ্রেফতার হন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রের নিয়মবিরোধী সিনেমা নির্মাণ করা। এরপর ইরানের আদালত পানাহির সিনেমা নির্মাণ ও বিদেশ ভ্রমণে ২০ বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু পানাহি থামেননি। সিনেমা নির্মাণ করে গেছেন। নিজেই মূল চরিত্র হয়েছেন ‘ট্যাক্সি’ সিনেমায়। ২০১৫ সালে এ চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার হয় বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানে গোল্ডেন বিয়ার জিতেছিল সিনেমাটি। এছাড়া ১৯৯৫ সালে ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ দিয়ে কান উৎসবে ক্যামেরা ডি’অর জিতেছিলেন তিনি।
৬৪ বছর বয়সী পানাহির জন্য কানের এ সম্মাননা বিশেষ হয়ে থাকবে। সিনেমার প্রিমিয়ারের দিন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তবে স্বর্ণপাম হাতে বিজয়ীর হাসি হেসেছেন। মঞ্চে তার পাশে ছিলেন অভিনেত্রী কেট ব্ল্যানচেট ও কান উৎসবের এবারের জুরি প্রেসিডেন্ট জুলিয়েট বিনোশ। প্রিমিয়ার থেকে পুরস্কার হাতে ওঠা পর্যন্ত তার সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী, কন্যা, অভিনেতা বাহেদ মোবাশসেরিসহ অন্য কলাকুশলীরা।