দক্ষিণ এশিয়ার পপ কুইন ছিলেন নাজিয়া হাসান

দুই বেণি করা এক কিশোরী। পরনে ডেনিম ডাংগারি। আশির দশকে হঠাৎ করেই দক্ষিণ এশিয়ার সংগীতাঙ্গনে নতুন এক ধারা নিয়ে এলেন।

দুই বেণি করা এক কিশোরী। পরনে ডেনিম ডাংগারি। আশির দশকে হঠাৎ করেই দক্ষিণ এশিয়ার সংগীতাঙ্গনে নতুন এক ধারা নিয়ে এলেন। পপসংগীত নিয়ে যাদের আগ্রহ ছিল তাদের ঘরে ঘরে বাজতে শুরু করল ‘আপ জ্যায়সা কোয়ি মেরি’, ‘ডিস্কো দিওয়ানে’। সেখান থেকে একসময় ‘ক্যামেরা ক্যামেরা’। ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় এ গান। ৩৩ বছর পরও জেনারেশন এক্স এমনকি মিলেনিয়ালরাও চিনতে পারবেন এ গানগুলোর শিল্পীকে। আশি ও নব্বইয়ের দশকের তরুণদের নিজের কণ্ঠ ও গায়কিতে বুঁদ করে রেখেছিলেন নাজিয়া হাসান। নিজের সময়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার পপ কুইন। তার মৃত্যুর এক যুগ পর বলিউডে রিমেক হয় ‘ডিস্কো দিওয়ানে’। আবেদন তখনো হারায়নি। এমনকি এখনো ‘কুরবানি’র ‘আপ জ্যায়সা’র তালে দুলতে থাকেন অনেকে।

নাজিয়া হাসানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ৩ এপ্রিল, করাচির সিন্ধে। কিন্তু বেড়ে উঠেছেন প্রথমে করাচি ও পরে লন্ডনে। তার বাবা বশির হাসান ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও মা মুনিজা বশির ছিলেন একজন সক্রিয় সমাজকর্মী। সেই সূত্রেই নাজিয়ার বেড়ে ওঠা ছিল তুলনামূলক প্রগতিশীলতার মধ্য দিয়ে। পড়াশোনা করেছেন লন্ডনের রিচমন্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতক সম্পন্ন করে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি করেন। এর আগে ইনটার্ন করেছিলেন জাতিসংঘের উইমেনস লিডারশিপ প্রোগ্রামে। তাই নাজিয়া হাসানের পরিচয় হিসেবে তাকে আইনজীবী, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গীতিকার ও সংগীতশিল্পী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তার সংগীতশিল্পী পরিচয়টি অন্য সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে। আর তা শুরু হয়েছিল ফিরোজ খান অভিনীত কুরবানি সিনেমার মাধ্যমে।

আশির দশকের বলিউড। তখন সিনেমায় সংগীত করছেন আরডি বর্মণ, কল্যাণজি-আনন্দজির মতো ক্ল্যাসিক সংগীতকাররা। এর মধ্যে অবশ্য নতুন ধারার এক্সপেরিমেন্টও চলছে। আরডি বর্মণ নিজেও তা করেছেন। এরপর করেছেন বাপ্পি লাহিড়ি। এমন সময় কল্যাণজি-আনন্দজিকে ফিরোজ খান জানালেন তার পরবর্তী সিনেমা ‘কুরবানি’তে একটি গানের জন্য বিড্ডু আপাইয়া ও নাজিয়া নামের দুজনের সঙ্গে কাজ করতে চান তিনি। কল্যাণজি-আনন্দজি অবাক হয়েছিলেন। কেননা অন্য গানগুলোয় কণ্ঠ দিচ্ছিলেন মহম্মদ রফি, কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে ও অমিত কুমার। কিন্তু ফিরোজ খান জোর দিয়েছিলেন নাজিয়ার বিষয়ে। আর ফিরোজের সঙ্গে নাজিয়ার পরিচয় হয়েছিল জিনাত আমানের মাধ্যমে।

লন্ডনে একটা অনুষ্ঠানে নাজিয়া হাসানকে গাইতে শুনেছিলেন জিনাত আমান। তিনিই পরে ফিরোজ খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নাজিয়ার। এদিকে বিড্ডু আপাইয়ার ইচ্ছা ছিল বনি এমের ‘রাসপুটিন’ অনুসরণে একটি হিন্দি গান তৈরির। কিন্তু নাজিয়া হাসান ও তার ভাই জোহেব হাসানের (নাজিয়ার আপন ভাই। তারা একসঙ্গেই গাইতেন) মনে ছিল অন্য কিছু। সেখান থেকেই তৈরি হয় ‘আপ জ্যায়সা কোয়ি’ এবং একটা গানেই বলিউডের পপগান, পপ কালচারে ভীষণ প্রভাব পড়ে। তারা আলোচনায় আসতে শুরু করেন। এরপর একে একে এসেছে ডিস্কো দিওয়ানে, বুম বুম স্টার, ইয়ং তারাঙ্গ ইত্যাদি।

সিনেমার ধারে কাছেও ছিলেন না নাজিয়া-জোহেব। নাজিয়া বড় হয়েছিলেন তার দাদির কাছে ম্যানচেস্টারে। ফিরোজ খান যখন তাকে সিনেমার গানের জন্য প্রস্তাব দেন, তখন স্কুল বাদ পড়ার ভয়ে নাজিয়া রাজি হচ্ছিলেন না। জিনাত আমানের মতো গ্ল্যামারাস তারকার ঠোঁটে ১৪ বছরের নাজিয়ার কণ্ঠ কেমন শোনা যাবে তা নিয়েও সন্দেহ ছিল অনেকের। কিন্তু আপ জ্যায়সা সব সন্দেহ কাটিয়ে দিল বলিউডের অন্যতম বড় হিট। ডিস্কো ঘরানার তখন কেবল শুরু। পরের বছর আরডি বর্মণের সুরে এসেছিল দিল লেনা খেল হ্যায় দিলদার কা এবং ১৯৮২ সালে বাপ্পি লাহিড়ি এনেছিলেন ডিস্কো ডান্সার।

আশির দশকে তখন নতুন ধারার সংগীত নিয়ে শ্রোতাদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। ১৯৮১ সালে নাজিয়া নিয়ে এলেন অ্যালবাম ‘ডিস্কো দিওয়ানে’। একই বছর কনিষ্ঠতম শিল্পী হিসেবে প্লেব্যাকে ফিল্মফেয়ার পেলেন তিনি। এর আগ পর্যন্ত বলিউডে সিনেমা গানগুলোয় ‘পার্টি ভাইব’ কম থাকত। সেখান থেকে ডান্স নাম্বারে চলে গিয়েছিলেন নাজিয়া। সঙ্গে তার ভাই জোহেব। দক্ষিণ এশিয়ার সংগীতপ্রেমীদের ঘরে ঘরে এই অ্যালবাম ঢুকে যায়। এখানেই শেষ না। ব্রাজিলের টপ চার্টে চলে এসেছিলেন নাজিয়া। এছাড়া ব্রিটিশ সংগীতের চার্টে প্রথম পকিস্তানি শিল্পী হিসেবে উঠে আসে নাজিয়ার নাম। এরপর এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল কয়েকবার।

১৯৮২ সালে মুক্তি পায় নাজিয়া হাসানের বুম বুম/স্টার, ১৯৮৪ সালে ইয়ং তারাঙ্গ, ১৯৮৭ সালে হটলাইন। এ তিন অ্যালবাম রীতিমতো দক্ষিণ এশিয়ার পপসংগীতের ধারাই বদলে দিয়েছিল। নতুন বেশকিছু বিষয় যুক্ত করেছিলেন নাজিয়া-জোহেব। যেমন ইয়ং তারাঙ্গ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মিউজিক অ্যালবাম যেখানে মিউজিক ভিডিও যুক্ত করা হয়েছিল। এরপর আন্তর্জাতিক সংগীত প্রযোজনা সংস্থা ইএমআই তাদের সঙ্গে অ্যালবাম তৈরির চুক্তি করেন।

নিজেদের দেশেও নাজিয়া-জোহেব সংগীতের বাজার ও প্রচলিত ধারায় নতুন বিষয় এনেছিলেন। ১৯৮৯ সালে তারা শুরু করেন ‘মিউজিক ৮৯’। এটি পাকিস্তানের পপসংগীত নিয়ে প্রথম টেলিভিশন শো। এ আয়োজনের মধ্য দিয়েই উঠে এসেছিল ভাইটাল সাইনস, জুপিটারস ও স্ট্রিংস। পাকিস্তানের সংগীতে এরপর তারা অবদান রেখেছিলেন।

মোটামুটি ১৯৯২ সালে ক্যামেরা ক্যামেরা অ্যালবাম পর্যন্ত নাজিয়া হাসানের জাদু চলেছিল। এর পরও যে চলেনি তেমন নয়। কিন্তু সক্রিয় সংগীতের সঙ্গে নাজিয়ার পথচলা শেষ হয়ে আসছিল। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছিলেন তিনি। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই সময়ে তার দাম্পত্য জীবনেও ছিল কিছু সংকট। মৃত্যুর মাত্র ১০ দিন আগে মির্জা ইশতিয়াক বেগের সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ২০০০ সালের ১৩ আগস্ট চলে গেছেন নাজিয়া।

কিন্তু তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সংগীত ও শিল্পীদের জন্য রেখে গিয়েছেন সংগীত, সুর, স্টাইল ও ফ্যাশন সেন্স। নাজিয়া হাসান এখনো বহু শিল্পীর প্রেরণা। এমনকি নির্মাতারাও। সে কারণেই ২০১২ সালে করণ জোহর তার ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ সিনেমায় রিমেক করেছিলেন ‘ডিস্কো দিওয়ানে’।

আরও