পাকিস্তানে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়ের পরপর ভারতের মাঠে গিয়ে ভরাডুবি হয় বাংলাদেশ দলের। সেখান থেকে ফেরার পর ঘরের মাঠে প্রোটিয়াদের কাছে বিধ্বস্ত হয় নাজমুল হোসেন শান্তর দল। মাঝে আরব আমিরাতের মাঠে আফগানিস্তানের কাছে ওয়ানডে সিরিজে হারের পর আবার লাল বলের লড়াইয়ে নামছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে ২ টেস্টের সিরিজ খেলবে টাইগাররা। আগামী শুক্রবার অ্যান্টিগায় শুরু হবে প্রথম টেস্ট ও ৩০ নভেম্বর জ্যামাইকার কিংস্টনে শুরু হবে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ২০ টেস্টে মুখোমুখি হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ চারটি ও ক্যারিবীয়রা ১৪টি জিতেছে, বাকি দুটি টেস্ট ড্র হয়। বাংলাদেশের পাওয়া চার জয়ের দুটিই এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটি থেকে।
দুই দল মোট ১০টি সিরিজে মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রতিটি সিরিজেই ছিল দুটি করে টেস্ট। এ ১০ সিরিজের মধ্যে বাংলাদেশ দুটি ও ক্যারিবীয়রা আটটি জিতেছে। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো দুই টেস্টের সিরিজে ক্যারিবীয়দের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। সফরকারীরা প্রথমটিতে ইনিংস ও ৩১০ রানে এবং দ্বিতীয়টিতে ৭ উইকেটের জয় পায়। ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে ১-০-তে হেরে যায় বাংলাদেশ।
অবশেষে তৃতীয় সিরিজে সফলতা পায় বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদেরই মাঠে ২-০-তে হারায় বাংলাদেশ। সেন্ট ভিনসেন্টে ৯৫ রানে ও গ্রেনাডায় ৪ উইকেটের ঐতিহাসিক জয় পায় টাইগাররা। প্রথম ম্যাচে মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে ও তিনি চোটে পড়লে দ্বিতীয় টেস্টে তরুণ সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে খেলেছে বাংলাদেশ। সিরিজটাই ছিল সাকিবের। ১৫৯ রান করার পাশাপাশি ঘূর্ণি বলে নেন ১৩ উইকেট। দ্বিতীয় টেস্ট ও সিরিজের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।
এরপর ঘরের মাঠে দুটি ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দুটিসহ মোট চারটি সিরিজে টানা হেরেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দেশের মাঠে দুই টেস্টের সিরিজে ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করার কৃতিত্ব দেখায় সাকিব আল হাসানের দল। ২০২১ সালে বাংলাদেশ সফরে গিয়ে অবশ্য ২-০-তে জয় পায় ক্যারিবীয়রা। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েও একই ব্যবধানে হেরে আসে সাকিবের দল।
১১তম সিরিজে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বাংলাদেশ। এ সিরিজের দুটি ম্যাচ যথাক্রমে অ্যান্টিগার নর্থ সাউন্ড আর জ্যামাইকার কিংস্টনে। নর্থ সাউন্ডে এখন পর্যন্ত দুটি টেস্ট খেলে জয় পাওয়া হয়নি বাংলাদেশের। সর্বশেষ ২০২২ সালের সফরে এখানে স্বাগতিক দলের কাছে ৭ উইকেটে হেরেছে টাইগাররা। এবার শুরুতেই সেই নর্থ সাউন্ডে পরীক্ষায় নামছে বাংলাদেশ দল।
টাইগারদের এবার দিতে হবে কঠিন পরীক্ষা। সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ার রাজনৈতিক কারণে কি একটু আগেভাগেই শেষ হয়ে গেল? ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট খেলতে চেয়েও বাধার মুখে দেশেই আসতে পারেননি। পরে আফগান সিরিজ থেকে সরে যান। এবার নেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও।
মুশফিকুর রহিম ও অধিনায়ক শান্ত চোটের কারণে ছিটকে পড়েছেন। মিডল অর্ডারের কান্ডারি মুশফিক আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলার সময় পড়েছেন আঙুলের চোটে, আর অধিনায়ক শান্ত পড়েছেন কুঁচকির ইনজুরিতে। সাকিব, মুশফিক আর শান্তর অনুপস্থিতিতে তারুণ্যনির্ভর দলটিকে নিয়ে ক্যারিবীয় সাগর পাড়ি দেয়ার মতোই কঠিন কাজটি করতে হবে মেহেদী হাসান মিরাজকে।
১৬ বছরের মধ্যে এ প্রথম কোনো টেস্ট সিরিজ খেলতে নামছে বাংলাদেশ যাতে নেই মুশফিক, সাকিব কিংবা তামিম ইকবালের মধ্যে অন্তত একজন!
৯৪ টেস্টের অভিজ্ঞ মুশফিক আগস্টে পাকিস্তানে সিরিজ জয়ের অন্যতম নায়ক। ওই সফর থেকেই তিনি কাঁধের চোটে ভুগছিলেন। এবার শারজায় আফগানদের বিপক্ষে ওয়ানডে খেলতে গিয়ে পড়েছেন আঙুলের চোটেও।
শারজায় দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে দারুণ এক ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে জিতিয়েছেন শান্ত। ওই ম্যাচেই তিনি কুঁচকির চোটে পড়েন। পরে স্ক্যানে তার চোট নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর বিসিবি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, শারজা থেকেই দেশে ফিরে যাবেন শান্ত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট সিরিজে তার জায়গায় দলকে নেতৃত্ব দেবেন মিরাজ।
শান্তর জায়গায় ২২ বছর বয়সী টপ অর্ডার ব্যাটার শাহাদাত হোসেন দিপুকে ডাকা হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের স্কোয়াডে। গত বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজে অভিষেকের পর থেকে এখন পর্যন্ত চারটি টেস্ট খেলেছেন দিপু, রান করেছেন ১৭.৭৫ গড়ে এবং সর্বোচ্চ স্কোর ৩১। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোম সিরিজে তিনি বাদ পড়েন। বিবেচনায় ছিলেন জাতীয় লিগে ৭৭.৬৬ গড়ে ৪৬৬ রান করা অমিত হাসান। এছাড়া চারশর বেশি রান করেছেন এনামুল হক বিজয় আর অমিত মজুমদারও।
পেসার খালেদ আহমেদ আর স্পিনার নাঈম হাসানকে বাদ দেয়া হয়েছে। দলে ফিরেছেন উইকেটকিপার ব্যাটার লিটন কুমার দাস। জ্বরের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট ও পরে আরব আমিরাতে আফগানদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলা হয়নি লিটনের।
সফরকারীদের পেস ব্রিগেডে আছেন তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ, শরিফুল ইসলাম ও নাহিদ রানা। স্পিন অ্যাটাকে অভিজ্ঞ তাইজুল ইসলাম ও অধিনায়ক মিরাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে অনভিজ্ঞ বামহাতি স্পিনার মুরাদ হাসানকে।
টপ অর্ডার ব্যাটিংয়ে সাদমান ইসলাম, মাহমুদুল হাসান জয় ও জাকির হাসানের ওপর ভরসা রেখেছেন নির্বাচকরা। এছাড়া মুমিনুল হক সৌরভ, শাহাদাত, মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন, মিরাজ আর জাকের আলী আছেন ব্যাটিং ব্রিগেডে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের শীর্ষ তিন রান সংগ্রাহক তামিম ইকবাল (৯৫৪), সাকিব (৯৫১) ও মুশফিকুর রহিম (৭৮২) কেউই এ সিরিজে নেই। দুই দেশ মিলিয়ে সাদা পোশাকের লড়াইয়ে সর্বোচ্চ ৪৭টি উইকেট নিয়েছেন সাকিব। তার না থাকা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের ধার কমিয়ে দেবে। ভরসা এখন মিরাজ ও তাইজুল, যারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ-বাংলাদেশ টেস্ট লড়াইয়ে উইকেট শিকারে যথাক্রমে তিন ও চারে রয়েছেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে তিনটি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচও খেলবে বাংলাদেশ। সাদা বলের এ দুটি সিরিজের জন্য এখনো দল ঘোষণা করেনি বিসিবি। ওয়ানডেতে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে দারুণ রেকর্ড বাংলাদেশের। এখন পর্যন্ত ৪৪ ম্যাচের মুখোমুখিতে উভয় দল সমান ২১টি করে জয় পেয়েছে। এমনকি ২০২২ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে স্বাগতিক দলটিকে ৩-০-তে হোয়াইটওয়াশ করার কৃতিত্বও দেখায় বাংলাদেশ দল! ২০২১ সালের হোম সিরিজেও ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করে টাইগাররা। সব মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টানা ১১টি ওয়ানডে ম্যাচে হারানোর অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব দেখিয়েছে বাংলাদেশ।
মিরাজদের সফরের সবশেষে থাকবে তিনটি টি-টোয়েন্টি। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একটি সময় বলা হতো ‘টি-টোয়েন্টির রাজা’। দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ধার একটু কমলেও এ ফরম্যাটে তারা সব সময়ই প্রতিপক্ষের জন্য বিপজ্জনক দল। ২০ ওভারের ফরম্যাটে ১৬টি লড়াইয়ে ক্যারিবীয়রা ৯টি ও বাংলাদেশ ৫টি জিতেছে। বাকি দুটি ম্যাচে ফল হয়নি।