একাদশ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) শুরুর পর মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে এসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদ বলেছেন, তিনি কিউরেটরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন এমন উইকেট তৈরি করা হয়, যাতে বিপিএলে রান ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। সে মোতাবেক রান হচ্ছেও। শুক্রবার শেষ হওয়া ঢাকার প্রথম পর্বে দুইশর ওপরে রান উঠেছে তিনবার, ১৯০ পেরিয়েছে দুবার। এছাড়া সাতবার দেড়শ পেরিয়েছে দলীয় সংগ্রহ। আট ম্যাচের ১৬ ইনিংসে দেড়শর নিচে স্কোর ছিল মাত্র চারবার। এবার অন্ততপক্ষে রান নিয়ে হতাশা নেই। কিন্তু এই একটি বিষয় ছাড়া এবার বিপিএলে বাকি সবকিছুতেই রাজ্যের হতাশা। চরম অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা তুঙ্গে।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে নানা অব্যবস্থাপনা ছাড়াও টিকিট নিয়ে স্টেডিয়ামের মূল ফটক ভাংচুর ও টিকিট বুথে আগুন দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক নিয়েও বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বেশকিছু খেলোয়াড় তাদের প্রথম কিস্তির পারিশ্রমিক সময়মতো পাননি বলে গণমাধ্যমে সংবাদ আসার পর এ নিয়ে কথা বলেছেন বিসিবি প্রেসিডেন্ট। তিনি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক ঠিকমতো পরিশোধের উদ্যোগ নেবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই পারিশ্রমিকের ৫০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করার কথা প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির। এরপর টুর্নামেন্ট চলাকালে ২৫ শতাংশ ও শেষ হলে বাকি ২৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করার কথা রয়েছে। যদিও ৭ ফ্র্যাঞ্চাইজির বেশির ভাগই তাদের স্থানীয় খেলোয়াড়দের এখনো প্রথম কিস্তির পারিশ্রমিক পরিশোধ করেননি বলে অভিযোগ করেছেন কিছু খেলোয়াড়।
বিপিএলে অংশ নেয়া ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নির্দিষ্ট অংকের অর্থ বিসিবির কাছে ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে জমা রেখে দেয়। ফ্র্যাঞ্চাইজি গড়িমসি করলেই বিসিবি তখন ওই অর্থ থেকে খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক দিয়ে দেয়। কিন্তু এবার ফরচুন বরিশাল ছাড়া আর কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দেয়নি। এ বিষয়ে ফারুক আহমেদ নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। তিনি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক পরিশোধের ব্যাপারে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। অতীতে ব্যাংক গ্যারান্টির অর্থ থেকে খেলোয়াড়দের পাওনা পরিশোধ করেছে বিসিবি। এবার ব্যাংক গ্যারান্টি জমা পড়েনি বলে খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
এ নিয়ে ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক, সাবেক প্রধান নির্বাচক ও বর্তমানে বিসিবি প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা প্রথম দিন থেকেই বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। আমি তাদের বলেছি, আপনাদের টাকা দিতে হবে। আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করেন (ব্যাংক গ্যারান্টি পরিশোধ নিয়ে) আমি পরিষ্কার উত্তর দিতে পারব না। গত চার মাসের পরিস্থিতি কী ছিল, সেটি আপনাদের নিজেদের অবস্থান থেকেই অনুধাবন করতে হবে। তার মানে এ নয় যে, খেলোয়াড়রা তাদের পারিশ্রমিকের অর্থ পাবে না। আমরা ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি। বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি নিজে ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে কথা বলেছি, যেন তারা ভাবে আমরা একে অপরের সহযোগী। তারা সবাই কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই অর্থ ব্যয় করছে।’
পারিশ্রমিকের বিষয়টি তখনই উঠে এলো, যখন টিকিট না পেয়ে ক্ষুব্ধ সমর্থকরা মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের মূল ফটক ভাংচুর করেছেন, সুইমিং কমপ্লেক্স-সংলগ্ন গেট ভাঙচুর করেছেন, আগুন দিয়েছেন ও এক তারকা খেলোয়াড়ের গাড়ি আটকে দিয়েছেন। এছাড়া ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল বিপিএলের প্রথম পর্ব। শুধু ব্যতিক্রম ছিল শুক্রবার প্রথম পর্বের শেষদিনের চিত্র। এদিন বিশৃঙ্খলা থামাতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী নিয়োজিত করা হয়। ফলে সমর্থকরা টিকিট না পেয়ে ক্ষুব্ধ হলে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননি।
তবে বিতর্ক আর সমালোচনা থেমে থাকেনি। শুক্রবার দুপুরে ম্যাচ শুরুর আগে সুইমিং কমপ্লেক্স-সংলগ্ন গেটের কাছে বিসিবির বুথ থেকে টিকিট কিনতে না পেরে ক্ষুব্ধ এক সমর্থক এ প্রতিবেদককে জানান, ২ হাজার টাকা দামের টিকিট ছাড়া আর কোনো টিকিট বুথে নেই। সেখান থেকে জানানো হয়, অন্যান্য মূল্যের টিকিট বিক্রি শেষ।
অথচ, সব শ্রেণীর দর্শক যাতে খেলা দেখতে পারে, সেজন্য ২০০, ৩০০, ৫০০, ৬০০, ৮০০ ও ১০০০ টাকা দামের টিকিট রাখা হয়। যদিও দুপুরের মধ্যেই এসব টিকিট ফুরিয়ে যায় বলে দাবি করা হয়।
মাঠের চিত্র অবশ্য ভিন্নই দেখা গেছে। স্টেডিয়ামের প্রায় ২০-৩০ শতাংশ সিট খালিই ছিল। অভিযোগ রয়েছে, ক্লাব কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে সৌজন্য টিকিট দেয়া হয়, সেগুলো প্রায়ই কালোবাজারিদের হাতে চলে যায়। এসব টিকিট বাইরে চড়া দামে বিক্রি করা হয়। অনেক টিকিট অবিক্রীতই থেকে যায়। ফলে গ্যালারির বেশকিছু সিট খালি পড়ে থাকতে দেখা যায়।
টিকিট ও নানা অব্যবস্থাপনা ইস্যুতেই ঘটে যায় অপ্রীতিকর ঘটনা। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার প্রেস সচিব মাহফুজুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রেসিডেন্ট বক্সে বিসিবি প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। যদিও মাহফুজুল আলম এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
গত ৩০ ডিসেম্বর বিপিএলের শুরুর দিনে কিছু বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা হয়। এসব ঘটনা নিয়ে সেদিন প্রেসিডেন্ট বক্সে ফারুক আহমেদের সঙ্গে কথা বলছিলেন মাহফুজ ও তার সঙ্গে থাকা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা টিকিট নিয়ে বিশৃঙ্খলা, গ্যালারিতে আবু সাঈদ কর্নার ও দর্শকদের বিনামূল্যে পানি পানের জন্য মুগ্ধ কর্নারের প্রস্তুতিতে দেরি এবং জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহত ১০০ জনের সৌজন্য টিকিট পেতে দেরি হওয়া নিয়ে বোর্ড সভাপতির কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে মাহফুজ উত্তেজিত হয়ে ফারুক আহমেদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। ফারুক আহমেদকে তিনি এ-ও বলেন, ‘আপনি কীভাবে বিসিবি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তা আমাদের জানা আছে।’
ফারুক আহমেদের সঙ্গে অশোভন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিবির কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়াও সাবেক ক্রিকেটাররা। তারা বলেন, ‘প্রেস সেক্রেটারির এমন আচরণ বিসিবি সভাপতি ও ক্রীড়া উপদেষ্টা উভয়েরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অসদাচরণ মানা যায় না।’
এ বিষয়ে ফারুক আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। মাহফুজ দাবি করেন, তিনি বোর্ড সভাপতির সঙ্গে কোনো অশোভন আচরণ করেননি।
মাহফুজের কথায়ই বেরিয়ে আসে এবারের বিপিএলে অব্যবস্থাপনার চিত্র। তিনি বলেন, ‘বিপিএলের একদিন আগে দুপুর পর্যন্ত মানুষ জানে না, কীভাবে টিকিট কাটবে। খেলা যখন শুরু হলো, তখনো শহীদ আবু সাঈদ স্ট্যান্ডের ব্যানার লাগানো হয়নি—এ রকম অনেক অব্যবস্থাপনা আমাদের চোখে পড়ে। তাছাড়া টিকিট ইস্যুতে গেট ভাঙার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। এসব নিয়েই আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল। এ রকম প্রত্যাশিত ছিল না। সবকিছু আরো ভালো হতে পারত। এসব অব্যবস্থাপনার জন্য মানুষের গালাগাল শুনেছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টা।’
বিপিএল শুরুর আগের দিন ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফ্র্যাঞ্চাইজির অধিনায়কের নাম জানাতে পারেনি ফ্র্যাঞ্চাইজি কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিবি। সাত দলের অধিনায়ককে নিয়ে একসঙ্গে আনুষ্ঠানিক ফটোসেশন ছিল না, ছিল না ট্রফির সঙ্গে চিরাচরিত ফটোসেশন। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর জার্সি উন্মোচন নিয়েও বিসিবির পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। সাত দলের অধিনায়ক কিংবা কোচ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রেস কনফারেন্সও ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলেছেন দু-একজন অধিনায়ক ও কোনো কোনো দলের প্রতিনিধি। আর বিপিএল গভর্নিং বডিও টুর্নামেন্ট নিয়ে কোনো সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়। পরিশেষে টিকিট নিয়ে নৈরাজ্য, যা সামাল দিতে শুক্রবার সেনাবাহিনী নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় প্রশাসন।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক এবং জাতীয় দলের সাবেক ম্যানেজার শফিকুল হক হীরা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টিকিট নিয়ে যা হচ্ছে, এটা তো বিপিএলে কখনো দেখা যায়নি। এটা আসলে খুবই দুঃখজনক।’ বিসিবি প্রেসিডেন্টকে ক্রীড়া উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি অপমান করেছেন বলে যে সংবাদ এসেছে, তা নিয়ে হীরা বলেন, ‘এটা তো হতে পারে না। কারণ, বিসিবি প্রেসিডেন্ট তো তার ওপরে, যদি করে থাকে সেটা খুবই খারাপ কাজ হয়েছে।’
বিসিবির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ গঠনেই ত্রুটি দেখছেন হীরা। তিনি মনে করেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে যখন নতুন সভাপতি ও নতুন কয়েকজনকে বোর্ডে নিয়ে আসা হয়, তখন সাবেক ক্রিকেটারদের ডেকে তাদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারত। তাতে বিসিবি উপকৃত হতো।
জাতীয় দলের সাবেক দুই অধিনায়ক, দেশের ক্রিকেটের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মর্তুজা এবার ‘রাজনৈতিক কারণে’ বিপিএলে খেলতে পারছেন না। সাকিবকে দলে নিয়েছিল চট্টগ্রাম কিংস এবং মাশরাফি ছিলেন সিলেট স্ট্রাইকার্সে। যদিও তাদের খেলা হয়নি। এ নিয়ে হীরা বলেন, ‘সাকিব শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে বলে তার ব্যাপারে কঠোর হওয়া দরকার ছিল, স্টাম্পে লাথি মারায় তাকে আগেই নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল। তবে মাশরাফিকে খেলতে দেয়া উচিত ছিল। তিনি এমন কিছু করেননি, যে কারণে তাকে খেলতেই দেয়া যাবে না।’