তামিমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অধ্যায় শেষ

ওয়ানডের শীর্ষ রান সংগ্রাহক তামিম, টেস্টে দুইয়ে, টি-টোয়েন্টিতে চারে

২০১০ সালের মে মাস। ঐতিহ্যবহুল লর্ডসে সিরিজের প্রথম টেস্টে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের মুখোমুখি বাংলাদেশ।

২০১০ সালের মে মাস। ঐতিহ্যবহুল লর্ডসে সিরিজের প্রথম টেস্টে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের মুখোমুখি বাংলাদেশ। ওই সময় বড় দলগুলোর সামনে স্রেফ অসহায় আত্মসমর্পণ করাই ছিল বাংলাদেশ দলের নিয়মিত চিত্র। কিন্তু সেই ম্যাচে ইংলিশদের চোখে চোখ রেখে লড়লেন তামিম ইকবাল। প্রথম ইনিংসে ৫৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১০০ বলে ১০৩ রানের রাজসিক ইনিংস খেললেন ১৫ বাউন্ডার আর ২ ছক্কায়। তামিমের ধ্রুপদি সব শট একের পর এক লর্ডসের সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছিল আর ইংলিশ বোলারদের অহংকার চূর্ণ হচ্ছিল। যদিও সেই ম্যাচে জেতা হয়নি বাংলাদেশের। প্রতিপক্ষকে ১৬০ রান টার্গেট দিয়ে ৮ উইকেটে হেরেছিল সফরকারীরা। বাংলাদেশ হারলেও জিতে যান তামিম। লর্ডসের অনার বোর্ডে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে নাম ওঠে তার।

২০০৭ সালে তার অভিষেকের বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের ম্যাচে ৫৩ বলে ৫১ রানের দৃষ্টিনন্দন ইনিংস খেলেছিলেন ১৮ বছর বয়সী তামিম। এ রকম আরো বহু যুদ্ধের নায়ক তিনি। কখনো দলকে জিতিয়েছেন, কখনোবা হারের আগ পর্যন্ত লড়েছেন।

ব্যাট হাতে প্রায় দুই দশক মাতানোর পর বাংলাদেশের ক্রিকেটে তামিম ইকবাল এখন ‘সাবেক’ খেলোয়াড়। তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থেকে অবসর নিয়েছেন। লাল-সবুজ জার্সিতে কিংবা টেস্টের সাদা জার্সিতে তাকে আর কখনই দেখা যাবে না। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার আগেই শেষ। সর্বশেষ ওয়ানডে থেকেও তিনি অবসর নিয়েছেন।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের ভাতিজা তামিম ইকবাল। তবে ‘চাচার জোরে’ জাতীয় দলে খেলেছেন—এমন তকমা অন্তত তামিমের নামের সঙ্গে নেই। তিনি বরং নিজের ব্যাটের জোরেই হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অপরিহার্য নাম, ব্যাটিংয়ের কাণ্ডারি। মারমুখী ব্যাটিংয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রিয় মুখ। আগ্রাসন, সাহসিকতা, ইতিবাচক মানসিকতা, প্রতিপক্ষকে ভয় না পাওয়া, স্লেজিংয়ের পাল্টা জবাব দেয়া—এসব কারণে তামিম ছিলেন অনন্য।

২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক ঘটে ১৮ বছর বয়সী তামিম ইকবালের। একই বছর সেপ্টেম্বরে নাইরোবিতে কেনিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ও ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ডানেডিনে টেস্ট অভিষেক হয় চট্টলার এই ক্রিকেটারের। সেই থেকে তামিম মানেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক হিরন্ময় অধ্যায়। ১৮ থেকে ৩০—এই ১২ বছর দাপটের সঙ্গে খেলেছেন বাংলাদেশ দলে। ত্রিশের কোটায় এসে ইনজুরি, বিতর্ক আর মাঠের বাইরের নানা ইস্যুতে ক্যারিয়ারটা খানিকটা স্থবির হয়ে পড়ে তার।

অবশেষে বাংলাদেশ ক্রিকেটে তামিম অধ্যায়ের শেষ হলো। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আর খেলবেন না তিনি। আগামী মাসে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তার খেলার সম্ভাবনা তৈরি হলেও নিজে থেকেই সরে গেলেন এবং এখানেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সমাপ্তিরেখা টেনে দিলেন নিজেই। শুক্রবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে এক পোস্টে এ সিদ্ধান্ত জানান ৩৫ বছর বয়সী তামিম।

জাতীয় দলের সাবেক কৃতী ব্যাটার বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে আছি অনেক দিন ধরেই। সেই দূরত্ব আর ঘুচবে না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার অধ্যায় শেষ।’

কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তামিম বলেন, ‘অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত আন্তরিকভাবেই আমাকে ফেরার জন্য বলেছে। নির্বাচক কমিটির সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। আমাকে এখনো উপযুক্ত মনে করার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তবে আমি নিজের মনের কথা শুনেছি।’

বন্ধু থেকে হঠাৎই তামিমের শত্রু হয়ে যান সাকিব আল হাসান। তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের কারণে ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তামিমের। তিক্ততার শুরু তারও আগে থেকে। ওই বছর ৬ জুলাই আকস্মিক এক সিদ্ধান্তে তিনি অবসর নিয়েছিলেন। যদিও পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার পর সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন তিনি। কিন্তু ইনজুরি আর ব্যক্তিগত কারণে মাঝে আর খেলা হয়নি লাল-সবুজের জার্সিতে। অবসর নেয়ায় আর কখনই খেলা হবে না বাংলাদেশের জার্সিতে।

দেশের ইতিহাসে সেরা ওপেনিং ব্যাটার তামিম ৭০ টেস্টে ১০ সেঞ্চুরিতে ৫ হাজার ১৩৪ রান, ২৪৩ ওয়ানডে ম্যাচে ১৪ সেঞ্চুরিতে ৮ হাজার ৩৫৭ রান ও ৭৮টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১ সেঞ্চুরিতে ১ হাজার ৭৫৮ রান করেছেন। তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৩৯১ ম্যাচ আর ১৫ হাজার ২৪৯ রান নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্বিতীয় সফলতম তামিম। মুশফিকুর রহিম ১৫ হাজার ৩০০ রান নিয়ে সবার ওপরে।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশের জার্সিতে শেষবার মাঠে নেমেছেন তামিম। টেস্ট ক্রিকেটে তিনি শেষবার খেলেন ২০২৩ সালের এপ্রিল আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। মিরপুরের সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে ২১ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১ রান করেছিলেন বামহাতি স্টাইলিশ ব্যাটার। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে বিদায়ের ঘোষণা দেন ২০২২ সালের জুলাইয়ে। অবশ্য তারও অনেক আগে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় তার। ২০২০ সালের মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষবার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি। পরে জাতীয় দলে তরুণদের প্রাধান্য দেয়া শুরু হলে এ ফরম্যাট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি।

২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের হয়ে ওপেনিং করেন তামিম। তখন তার সঙ্গী ছিলেন শাহরিয়ার নাফীস। পোর্ট অব স্পেনে ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের ম্যাচেও দুজন ওপেন করেন। নাফীস বর্তমানে বিসিবির ক্রিকেট অপারেশনস বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। তামিমকে বিদায়ী অর্ঘ্য দিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে নাফীস লেখেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তোমার অবদান বাংলাদেশ সবসময় মনে রাখবে...তামিম ইকবাল।’ এরপর একটা ভিডিও প্রকাশ করেছেন তিনি, যা ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে তার সেই ফিফটির ক্লিপ। ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘তামিমের আবির্ভাব।’

জাতীয় দলে একসঙ্গে বেড়ে ওঠেন মুশফিকুর রহিম ও তামিম ইকবাল। দলের তারকাখ্যাতি ছাড়াও দুজন ভালো বন্ধুও। কাছের বন্ধু তামিমের সঙ্গে ছবি দিয়ে নিজের ফেসবুকে মুশফিক লিখেছেন, ‘তোমার অবসর ঘোষণার সময়ে তোমাকে জানাতে চাই, তুমি যা কিছু অর্জন করেছ, তার জন্য আমি বেশ গর্বিত, তামিম। দোস্ত, তুমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন অসামান্য দূত, ব্যাটার হিসেবেও বিশ্বমানের।’

ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে চলে আসা আরেক তারকা মাহমুদউল্লাহ ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘তামিম, লম্বা ও দারুণ একটা ক্যারিয়ারে তুমি যা কিছু অর্জন করেছ, তার জন্য তোমাকে অভিনন্দন। তুমি অনেক কিছু অর্জন করেছ এবং বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় অবদান রেখেছ। আমার মনে আছে আমরা যখন শেষবারের মতো বাংলাদেশের হয়ে খেলেছি, আমরা একসঙ্গে ব্যাটও করেছি। তোমার সঙ্গে খেলা, মাঠে আর মাঠের বাইরে অনেক স্মৃতি ভাগাভাগি করাটা আনন্দের ছিল। আমি তোমাকে একটা সুখের অবসর সময় চাই, তোমার ভবিষ্যৎ সব চেষ্টার জন্য রইল শুভকামনা। তোমার কথা সবসময় স্মরণে থাকবে।’

তামিমকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির অফিশিয়াল ফেসুবক পেজের এক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেয়ায় বাংলাদেশ দলের সেরা ওপেনিং ব্যাটার তামিম ইকবালের অবিশ্বাস্য এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। মহাকাব্যিক সব সেঞ্চুরি আর অবিস্মরণীয় স্মৃতিগুলো আর তোমার উত্তরাধিকার এ দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের হৃদয়ে চির জাগরূক থাকবে।’

আরও