দেশে প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হবে—এমন প্রক্ষেপণ ছিল ২০১৬ সালের বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায়। সে লক্ষ্যে দেশে ২০৪১ সাল নাগাদ বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেয় বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা তৈরি না হওয়ায় অন্তত অর্ধেক সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র সারা বছর বসিয়ে রাখতে হয়। অপরদিকে বিদ্যুৎ না নিয়েও চুক্তি অনুযায়ী দিতে হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ।
সেই সঙ্গে বিশেষ বিধানের আওতায় কেন্দ্র নির্মাণ, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি, মিশ্র জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমন্বয়হীনতায় বিগত ১৫ বছরে আর্থিকভাবে বিপুল দেনায় পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলতে অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম, যার খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তা থেকে শুরু করে বিদ্যুতের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাত গত দেড় দশকে লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ বিভিন্ন সময়ে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত, বিশেষ বিধানের আওতায় বিনিয়োগকারীদের বাণিজ্য সুবিধা দেয়া, বিদ্যুতের ভিন্ন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান না থাকা, কঠিন শর্তে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ঋণ, প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা না থাকা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ। এ সরকারকে তাই শুরুতেই বিশেষ বিধান (বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহসংক্রান্ত বিশেষ আইন) বাতিল করতে হবে।
বিদায়ী সরকার এ বিধানের আওতায় ১৫২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ৯১টি নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। এসব চুক্তি জনসাধারণের দেখার কোনো সুযোগ নেই। বিনিয়োগকারী তাই নিজের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে অনুমোদন নিয়েছে। ফলে একতরফাভাবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে গিয়ে দেনায় পড়তে হয়েছে। এ অর্থ তুলতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিপিডিবির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম।
বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ শর্ত আরোপ করে এ খাতে বিনিয়োগকারীদের টেনে আনা হলেও পরবর্তী সময়ে এ ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষা পেয়েছে। শর্ত অনুযায়ী, বিপিডিবি বিদ্যুৎ ক্রয় না করলেও বছরের পর বছর অর্থ পেয়েছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অর্থ বিদ্যুতের ট্যারিফে যুক্ত হয়ে বিদ্যুতের দামে ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ এ খাতে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ট্যারিফ না হওয়া। একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে শুরু থেকে আজ অবধি বিপিডিবি বিদ্যুৎ ক্রয় করে বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। ভিন্ন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করা গেলে বিপিডিবিকে এককভাবে বিপুলসংখ্যক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া ও বিদ্যুতের দাম বহন করতে হতো না। এতে আর্থিকভাবে চাপ থেকে মুক্ত থাকতে বিপিডিবি। প্রতিবেশী দেশ ভারতে বিদ্যুতের এক্সচেঞ্জ মার্কেট রয়েছে। সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান নিজেই কেন্দ্র নির্মাণ করে এক্সচেঞ্জ মার্কেটে সেই বিদ্যুৎ প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিক্রি করছে। তাতে ভারতের বিদ্যুতের ক্রেতারা সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে পারছেন।
বিদ্যুৎ খাতে লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে না পারার অন্যতম কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমন্বয়হীনতা। অর্থাৎ কোন ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানো যাবে, সেই ধরনের জ্বালানির জোগান না থাকা। এতে বিদ্যুতের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কারণেও বেড়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের মূল্য।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে বিদ্যুৎ খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। কারণ দেশের বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি। আর এজন্য প্রয়োজনীয় যে বরাদ্দ রাখা দরকার সেটি দিতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক যেসব পরিকল্পনা সেগুলো রিভিউ করা জরুরি। মধ্যম মেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। বিদ্যুতের প্রধান সমস্যা এখন জ্বালানি। এক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতার ওপর বসে না থেকে স্থানীয় গ্যাসের দিকে নজর দিতে হবে। এছাড়া বিশেষ বিধানের আওতায় যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে সেগুলোর চুক্তিতে কী আছে তা জনসাধারণের জানার সুযোগ করে দিতে হবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ৩১ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। অথচ বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। বাকি সক্ষমতা বসিয়ে রেখে চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। এসব চুক্তি রিভিউ করার তাগিদ জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের।
তাতে কোন কেন্দ্রের প্রয়োজন রয়েছে, কোনটির নেই তা নির্ধারণ করা যাবে। আর যেগুলোর প্রয়োজন নেই সেগুলো অবসরে দেয়া, বিশেষ করে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবসরে দিয়ে দেয়া এখন সময়ের দাবি। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালিয়ে বিপিডিবি বিপুল পরিমাণ অর্থ যেমন গুনছে, তেমনি বিশেষ একটি শ্রেণী বিদ্যুৎ বিক্রি না করেও এ খাত থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়নে সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেছে বিদেশী দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে। অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, অন্তত ১৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরকারের ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে ৫১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ খাতের লোকসানের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা সংগঠন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সংযোজন করা হয়েছে। লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি করে এ অর্থ ব্যক্তি হয়ে মুনাফা হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পকেটে গেছে। বিদ্যুতের যেসব চুক্তি বিগত বছরগুলোয় হয়েছে সেগুলো রিভাইজ হওয়া দরকার। বিশেষ বিধানের আওতায় দেয়া এসব অনুমোদনে কী ছিল, কী ধরনের বিনিয়োগ আনা হয়েছে, কত শতাংশ সুদে ঋণ নেয়া হয়েছে, ইকুইটি বিনিয়োগ কত ছিল এসব হিসাব হওয়া দরকার। প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ সাশ্রয়ী করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের লুণ্ঠনমূলক এসব ব্যয় নিয়ে হিসাবের সময় এসেছে। সেটি করা গেলে বোঝা যাবে এ খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে। কী পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা গেলে বিদ্যুতের দাম কতটুকু কমানো যেত।’