ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

‘আমি ২৪ মার্চ হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নম্বর কেবিনে ভর্তি হয়। ...২৫ মার্চের রাত ১২টার দিকে যখন আমি পেথিডিনে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন বিকট আওয়াজে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, আজহার তখন কেবিনের বারান্দায় ঘুমিয়ে। মনে হচ্ছিল সমস্ত ঢাকা শহর থরথর করে কাঁপছে। আমি আয়াকে বলার আগেই দেখি ডাক্তার নিজেই কেবিনে ঢুকে দ্রুত আমার বেডটি ওয়ালের

‘আমি ২৪ মার্চ হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নম্বর কেবিনে ভর্তি হয়। ...২৫ মার্চের রাত ১২টার দিকে যখন আমি পেথিডিনে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন বিকট আওয়াজে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, আজহার তখন কেবিনের বারান্দায় ঘুমিয়ে। মনে হচ্ছিল সমস্ত ঢাকা শহর থরথর করে কাঁপছে। আমি আয়াকে বলার আগেই দেখি ডাক্তার নিজেই কেবিনে ঢুকে দ্রুত আমার বেডটি ওয়ালের দিকে টেনে নিচ্ছেন। কারণ বেডটি ছিল জানালা বরাবর। অবিরাম বিকট গুলির শব্দে, কামানের তোপ ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দে আমি দিশেহারা, প্রায় অজ্ঞান হয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ২৫ মার্চ কালরাতের অভিজ্ঞতাকে এভাবেই স্মরণ করেছেন সৈয়দা সালমা হক। শহীদ ডা. আজহারুল হকের স্ত্রী তিনি। তার জবানে আরো উঠে এসেছে পরের দিনের ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিত্র। 

পেশাগত কারণেই চিকিৎসকদের অবস্থান জনসাধারণের কাছাকাছি। ফলে সমাজ ও দেশের সামষ্টিক প্রত্যাশার সঙ্গে তাদের যোগাযোগের সুযোগটাও সর্বাধিক। স্বাভাবিকভাবেই বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই এখানকার চলমান সংগ্রাম ও আন্দোলনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন চিকিৎসক শ্রেণী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বাংলার সব রাজনৈতিক তৎপরতার আঁতুড়ঘর; ফলে এখানকার সব ধরনের আন্দোলনই স্পর্শ করেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সেখানকার ছাত্র ও চিকিৎসকরা এগিয়ে এসেছেন সক্রিয়ভাবে। কেবল আহতদের প্রাণান্তকর শুশ্রূষার মাধ্যমে নয়, নিজেরাও জড়িয়ে পড়েছেন স্বদেশের সম্মিলিত আহ্বানের সঙ্গে।

দীর্ঘ দুই যুগে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় নিপীড়নের প্রতিবাদে নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলার মানুষ। কিন্তু ২৫ মার্চের কালরাত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত। অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনায় সারা ঢাকা যেভাবে রক্তে রঞ্জিত হয়, তার প্রভাব পড়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজেও। নিহতের সারি ও আহতদের আর্তনাদ ভারি করে ফেলেছিল সেখানকার বাতাস। সে কঠিন মুহূর্তে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে এসেছে তৎকালীন ছাত্র, কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। রেখেছে উল্লেখযোগ্য অবদান। অনেকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে মোকাবেলা করেছেন পাকিস্তানি বাহিনীর। কেউ কেউ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা ও অসহায় বাঙালিদের চিকিৎসা করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেদিক থেকে মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভূমিকা তিন ভাগে বর্ণনা করা যেতে পারে। প্রথমত, ওই সময়কার ছাত্ররা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, পাসকৃত চিকিৎসকদের একটি অংশ যারা অন্যান্য হাসপাতাল ও সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে কর্মরত ছিলেন। তৃতীয়ত, যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের চিকিৎসা করেছেন। কলেজের তৎকালীন ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তৎপর ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন, সেলিম আহমেদ, আলী হাফিজ সেলিম, আবু ইউসুফ মিয়া, ইকবাল আহমেদ ফারুক, মুজিবুল হক, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মোজাফফর আমজাদ হোসেন, ওয়ালী, ওসমান, গোলাম কবীর, জিল্লুর রহিম, ডালু, নুরুজ্জামান, শাহাদত প্রমুখ। এদের অনেকেই ঢাকা শহর কমান্ডের তত্ত্বাবধানে থেকে যুদ্ধ করেছেন। 

শহীদ অধ্যাপক আলীম চৌধুরী সে সময় সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য বেশির ভাগ সময় তিনি থাকতেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেলের তৎকালীন আবাসিক সার্জন ডা. আজহারুল হক বহির্বিভাগ দিয়ে নানা কৌশলে হাসপাতালে ঢোকাতেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। আর হাসপাতালে চিকিৎসারত মুক্তিযোদ্ধাদের তদারকি করতেন ডা. ফজলে রাব্বি। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বিখ্যাত প্রফেসর ও কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন ডা. ফজলে রাব্বি। প্রবল মেধাবী মানুষটি সে সময়ে দুবার পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশন করে রেকর্ড গড়েছিলেন। দেশের প্রতিটি স্বাধীনতা আন্দোলনেই তার ছিল অবাধ বিচরণ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ও তার পরিবার পুরোপুরিভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা করেন। পরিণত হন তাদের পরিবারের সুরক্ষাদাতায়। যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের তিনি অর্থ, আশ্রয়, চিকিৎসা প্রভৃতি প্রদান করেন। যুদ্ধের সময় তার প্রাইভেট চেম্বার ছিল ঢাকার হাতিরপুলে সায়্যিদা ফার্মেসির সঙ্গেই। তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে এখানে নিয়ে আসতেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। রাতের আঁধারে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরেও তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহরের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ বর্তমান শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি ছাত্রাবাসে রাজাকারদের ওপর হামলা চালায়। ছাত্রাবাসের ১০৭ নং রুমে সে সময় রাজাকারদের ঘাঁটি ছিল। তাদের গোপন হামলায় হোস্টেলের গেটে পাহারারত দুজন রাজাকার নিহত হয়। গুলির শব্দ শুনে ১০৭ নং রুমে অবস্থানরত অন্যান্য রাজাকার পালিয়ে যায়। একজন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকলে সেও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে নিহত হয়। একই দিনে তারা ২১৯ নং রুমে হামলা চালায়। গ্রুপটি কলেজ-ডি সেকশন হলেও বোমা চালিয়েছিল। কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী নিপা লাহিড়ী যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে যাওয়ার পথে ফতুল্লায় নিহত হন। আরেক ছাত্র সিরাজুল ইসলাম হাসপাতালে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। তিনি রাতে হোস্টেলে না গিয়ে হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে ঘুমাতেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্রের সহায়তায় তাকে ১১ ডিসেম্বর রাতে রাজাকার বাহিনী ক্যান্সার ওয়ার্ড থেকে তুলে নিয়ে যায়। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত থাকা সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের সদস্যও নেহায়েত পিছিয়ে ছিলেন না। সশস্ত্র ভূমিকা রাখেন স্কোয়াড্রন লিডার এম শামসুল হক, মেজর খুরশীদ, মেজর শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আব্দুল লতিফ মল্লিক, ক্যাপ্টেন আ. মান্নান, লে আখতার, লে নুরুল ইসলাম প্রমুখ। তাদের মধ্যে আবার মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ক্যাপ্টেন খুরশীদ বীর-উত্তম ও লে আখতার বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের যেসব সদস্য শহীদ হয়েছেন, তাদের মধ্যে ডা. লে ক এ এফ জিয়াউর রহমান, ডা. মেজর আসাদুল হক, ডা. লে আমিনুল হক, ডা. লে খন্দকার আবু জাফর মো. নূরুল ইমাম প্রমুখ ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে কর্মরত প্রায় সব চিকিৎসকই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। যোদ্ধাদের আসল নাম গোপন রেখে হাসপাতালে ভর্তি করানো হতো। এজন্য চিকিৎসকদের জন্য দেখা দিয়েছিল শঙ্কাও। আবার কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের চিকিৎসা করেছেন। 

অপারেশন সার্চলাইটের পর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বর। ডিসেম্বরে যুদ্ধ শেষ হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্যস্ততা কমেনি। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগই ভর্তি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তৎকালীন ছাত্র ও চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছিলেন। যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী দেশের অগ্রযাত্রায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের সে অংশগ্রহণ বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

আহমেদ দীন রুমি: লেখক

আরও