অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রাচীন পর্যায়ে বিনিময় প্রথায়, অর্থাৎ পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বেচাকেনা হতো, এ কথা সবারই জানা আছে। মুদ্রার প্রচলন ঘটে আরো পরে। সে সময় থেকেই জন্ম নেয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এ সময় সম্পদশালী মানুষের সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়। আবার বিভিন্ন কারণে, বিশেষত ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কিছু মানুষের অর্থের দরকার হয়। এ প্রয়োজন মেটানোর উৎস ছিল ঋণ। এই দুই বিপরীতমুখী চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। ব্যবহারিক প্রয়োজন, আস্থা, সম্পদের নিরাপত্তা—এসব কারণে হাজার বছর আগে যে অসংগঠিত ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, সেটিই তৈরি করেছিল আধুনিক ব্যাংকিংয়ের ভিত্তিভূমি।
প্রাচীনকালে মানুষের অর্থ আমানত রাখা এবং ঋণ দেয়ার কাজ করতেন মহাজন এবং গির্জা বা মন্দিরের পুরোহিতরা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকেই এ ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু ছিল সিন্ধু, গ্রিস, রোম ও মিসরীয় সভ্যতায়। এ ব্যবস্থায় উপাসনালয়গুলোর পুরোহিতরা সমাজের সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন বলে তাদের ওপর আস্থা রাখত তখনকার মানুষ। গির্জা কিংবা মন্দিরের নিরাপত্তাও মানুষকে তাদের সম্পদ ও আমানত সেখানে গচ্ছিত রাখতে উদ্বুদ্ধ করত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস মধ্যবর্তী অববাহিকা) ছিল আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার পথিকৃৎ। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে গির্জা বা মন্দিরকেন্দ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থার নজির পাওয়া যায়। এ সময় গির্জা বা মন্দিরগুলো উপাসনালয়স্থল ছাড়াও ছিল সামাজিক যোগাযোগ ও মিলনের কেন্দ্রবিন্দু। ঈশ্বর সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি ধনসম্পদও—এমন বিশ্বাসই উপাসনালয়গুলোকে ব্যাংকিংয়ের মতো আস্থানির্ভর কার্যক্রমের পীঠস্থানে পরিণত করে। উপাসনালয়ের পুরোহিতরা এ সময় খাজনা আদায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের তদারকি, দরিদ্র মানুষের মধ্যে সম্পদ বণ্টন এবং ব্যাংকিং—সব দায়িত্বই পালন করতেন। এখানে গচ্ছিত রাখা হতো খাদ্যশস্য, মূল্যবান সম্পদ এবং আরো বিভিন্ন মহার্ঘ দ্রব্যসামগ্রী। একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় সব ধরনের আমানত ও ঋণ লেনদেনের সঠিক হিসাব রাখা হতো এখানে। সাধারণত পণ্য কিংবা অর্থের আকারে ঋণ দেয়া হতো কৃষক, বণিক ও বিভিন্ন পণ্যের কারিগরদের, আদায় করা হতো নির্দিষ্ট হারে সুদ। বর্তমানের ব্যাংকের মতো জমা রসিদ, চেক বই ইত্যাদিরও প্রচলন ছিল তখন। উপাসনালয়কেন্দ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মানুষকে অর্থ ও বিনিয়োগ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেয়া হতো। সর্বমান্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের বিভিন্ন ধরনের বিবাদ-বিসম্বাদ মেটানোর কাজটিও করতেন পুরোহিত কিংবা তাদের প্রতিনিধিরা। এসব কার্যক্রমের পরিশীলিত রূপ হচ্ছে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেতে থাকলে গির্জা ও মন্দিরকেন্দ্রিক ব্যাংকিংয়ের সমান্তরালে গড়ে ওঠে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক। এসব ব্যাংক স্থাপন করেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও ভূস্বামী গোষ্ঠী। স্বাভাবিকভাবে এসব ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক আমানত ও ঋণ লেনদেনের কাজ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের নতুন সেবা কার্যক্রম পরিচালিত করতে শুরু করে। যেমন আধুনিক ঋণপত্রের আদলে দেয়া এসব ব্যাংকের প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে ভিনদেশী কিংবা দূরবর্তী নগরের ব্যবসায়ীদের নগদ অর্থ বহন করে সশরীরে গিয়ে সওদা আনার প্রয়োজন পড়ত না। বর্তমান সময়ের মতোই অর্থ স্থানান্তরের জন্য এসব ব্যাংক চালু করে রেমিট্যান্স বা হুন্ডির ব্যবসা। এমনকি পণ্য পরিবহনের ঝুঁকি গ্রহণ করে এসব ব্যাংক ইন্স্যুরেন্সের মতো সেবাও চালু করেছিল বলে জানা যায়।
ব্যক্তি খাতের ব্যাংক চালু হলে ব্যাবিলনিয়ার আদর্শবাদী ও প্রজাহিতৈষী রাজা হাম্মুরাবি রাজ্য শাসনের জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ‘হাম্মুরাবি কোড’ নামে পরিচিত সেই নীতিমালায় ব্যাংকিং এবং ঋণ কার্যক্রমের বিষয়েও দেয়া হয়েছিল সুস্পষ্ট বিধান। যেমন ঋণের ওপর সুদের সর্বোচ্চ হার বেঁধে দেয়া, ঋণের জামানত হিসেবে জমি ও বাড়িঘর, গবাদিপশুর মতো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের জন্য অনুমোদিত ছিল অপেক্ষাকৃত উচ্চ সুদের হার। আমরা জানি, ঋণের বিপরীতে সুদ আদায় বিষয়ে ইসলাম, ইহুদি, খ্রিস্টান ও সনাতন ধর্মগ্রন্থেও সুস্পষ্ট বিরোধিতা রয়েছে। প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমুখ দার্শনিকও সুদের বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। ধর্মীয় অনুশাসনে সুদ আদায় যেখানে একরকম নিষিদ্ধ করা হয়, সেক্ষেত্রে খ্রিস্টপূর্ব সময়ে প্রণীত হাম্মুরাবির সুদসংক্রান্ত নির্দেশনা এমন ছিল, যাতে সেটা ঋণগ্রহীতার কাছে দুর্বহ মনে না হয়।
এতসব নিষেধাজ্ঞা ও নেতিবাচক মনোভাব সত্ত্বেও সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা যেহেতু এখনো চলমান, যা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় একটি দেশের মুদ্রানীতি ও অন্যান্য আর্থিক কর্মকাণ্ড, ব্যবহার করা হয় মূল্যস্ফীতির মতো রোগ সারানোর কাজে। সেক্ষেত্রে আমরা দেখতে পারি মহাশক্তিধর এই সুদ আসলে কী? এক কথায় বলা যায়, ঋণ হিসেবে যে অর্থ অন্যকে নির্দিষ্ট সময় ব্যবহার করার জন্য দেয়া হয়, তার মূল্যই সুদ। ঋণদাতা যখন তার মূলধন অন্যকে ধার দেয়, সেই মূলধনের বর্তমান ভোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে সে। এ ভোগ বঞ্চনার মূল্য, মাশুল কিংবা পুরস্কারই হচ্ছে সুদ। কেউ যদি অন্য কাউকে ধার না দিয়ে তার হাতে থাকা নগদ মূলধন ঘরে ফেলে রাখে, তার মূল্য বা সুদ তথা আয় থেকে বঞ্চিত হয় সে। প্রকৃতপক্ষে যে অর্থ বা মূলধনকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে সিন্দুকে অলস ফেলে রাখা হয়, সেই অর্থের কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই। কারণ, নগদ অর্থ ব্যবহারহীনভাবে ফেলে রাখলে সেটা দিয়ে প্রকৃত সম্পদ সৃষ্টি হয় না, ফলে অর্থনীতিতে রাখতে পারে না কোনো অবদান। অতএব ঋণ বিতরণ না করে ব্যাংকগুলোরও কোনো গতি নেই। কারণ এককালে মহাজন বা প্রাচীনকালের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ঋণ দিতেন নিজেদের সঞ্চিত অর্থ থেকে। পক্ষান্তরে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুদের বিনিময়ে মানুষের হাতে থাকা উদ্বৃত্ত সংগৃহীত অর্থ থেকেই ঋণ দেয়া হয়। ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদদের মতে সুদকে ভোগ বঞ্চনার পুরস্কার হিসেবে গণ্য করা হলেও, কেইনসের মতে বিনিয়োগের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নগদ টাকা ঘরে রেখে দেয়ার মনুষ্য প্রবৃত্তিকে পরিবর্তন করে ব্যাংকে রাখতে আকৃষ্ট করার জন্যই সুদ দেয়া প্রয়োজন।
প্রাচীন যুগে ব্যাংক ব্যবস্থা যথেষ্ট সংহত ছিল না, সুদৃঢ় ছিল না ব্যাংকগুলোর ভিত্তি, সুলভ ছিল না ব্যাংক পরিষেবা এবং ছিল না বিচিত্র ও বিভিন্নমুখী ব্যাংকিং সুবিধা। আজকাল ব্যাংক পরিষেবা বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তার অভাবের কারণেও মানুষ নগদ টাকা ঘরে ফেলে রাখে না। ফলে যেকোনোভাবেই হোক, মানুষের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংক খাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ধারায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। এভাবেই সৃষ্টি হয় ব্যাংকের আমানত।
প্রাচীনকালে একসময় যখন উপাসনালয় তথা পুরোহিতদের ওপর আস্থা রেখে গড়ে উঠেছিল ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত, পরবর্তী সময়ে গ্রাহক তথা আমানতকারীদের আচরণের ওপর বিশ্বাসও হয়ে পড়ে ব্যাংকিং কার্যক্রমের পেছনের মূল অনুমান। আমরা এখন জানি, আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থ দিয়েই পরিচালিত হয় ব্যাংকগুলোর ঋণ কার্যক্রম। ব্যাংকগুলো ধরে নেয় যে আমানতকারীরা সবাই একই সময়ে তাদের গচ্ছিত আমানত তুলে নিতে আসবে না। উপরন্তু যত টাকা তোলা হবে, জমা পড়বে তার চেয়ে কম। এ অনুমানের ওপর নির্ভর করেই ব্যাংক তার কাছে গচ্ছিত আমানতের টাকা থেকে একাংশ ঋণ দেয়। অনুমানটির ব্যত্যয় কিংবা অন্যথা ঘটলে ব্যাংকে সংকট সৃষ্টি হয়, আর এ রকম পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত আশ্রয় হিসেবে এগিয়ে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অতীতে বাংলাদেশে অনেক সংকটাপন্ন ব্যাংককে বিভিন্ন উপায়ে রক্ষা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে টাকাকড়ি অন্য সব পণ্যের মতো ভোগ করে নিঃশেষ করে ফেলা যায় না, খরচ করে ফেললে সেই অর্থ হাতবদল হলেও মূল্য সমুন্নত রেখে ব্যবহৃত হতে থাকে সেই অর্থ। এককালে যখন অর্থের ব্যবহার ছিল না, থাকলেও ছিল সীমিত, তখন পণ্য বা অন্য কোনো সম্পদ তরল অর্থের মতো অর্থনীতির শিরা-উপশিরায় প্রবেশের সুযোগ পেত না। কালের বিবর্তনে ধাতব মুদ্রা ও ব্যাংক নোট চালু হলে মানুষের হাতে থাকা সম্পদ তারল্য লাভ করে গতিপ্রাপ্ত হয়। ফলে একটি দেশের অর্থনীতিতে তরল অর্থের সামগ্রিক পরিমাণকেই সরবরাহ বলে গণ্য করা হয়। আর এ সরবরাহ গড়ে ওঠে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থ এবং ব্যাংকের আমানতের সমন্বয়ে। কিন্তু ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়নের পর অর্থ সরবরাহের মূল উপাদান হয়ে পড়ে ব্যাংকের আমানত। কারণ এ আমানত থেকে সৃষ্টি হয় ঋণ, এ প্রক্রিয়া পৌনঃপুনিকভাবে বাড়তে থাকলে বাজারে বিস্তৃত হয় অর্থের জোগান। ঋণ সৃষ্টির ফলে কীভাবে অর্থ সরবরাহ বাড়ে সেটা সাধারণ পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য একটা উদাহরণ সহকারে বর্ণনা করা যেতে পারে।
ধরা যাক একটা দেশে কেবল দুটো ব্যাংক আছে, ড্যাফোডিল ব্যাংক ও টিউলিপ ব্যাংক। ড্যাফোডিল ব্যাংকের আমানত আছে ১ লাখ টাকা। এই আমানতের ১৭ শতাংশ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংবিধিবদ্ধ জামানত (Cash Reserve Ratio—CRR ও Statutory Liquidity Ratio—SLR) হিসেবে গচ্ছিত রাখার পর ব্যাংকটি ৮৩ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করতে পারে। ব্যাংকটির ঋণগ্রহীতা(রা) সেই ৮৩ হাজার টাকা দিয়ে যে পণ্য বা সেবা কিনবে সেই টাকা গিয়ে জমা হবে টিউলিপ ব্যাংকে। তখন ব্যাংকটির আমানত হবে ৮৩ হাজার টাকা। সেই আমানত থেকে ১৭ শতাংশ বিধিবদ্ধ জামানত রক্ষা করার পর এই ব্যাংকটি ঋণ দিতে পারবে ৬৮ হাজার ৮৯০ টাকা। সেই টাকা যদি আবার অন্য কারো মাধ্যমে ড্যাফোডিল ব্যাংকে বা টিউলিপ ব্যাংকে জমা হয়, সেই আমানত থেকে ঋণ বিতরণ করা যাবে ৫৭ হাজার ১৭৮ টাকা। এ ঋণ থেকে সৃষ্ট আমানতের বিপরীতে কোনো ব্যাংক আবার ঋণ বিতরণ করতে পারবে ৪৭ হাজার ৪৫৮ টাকা। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক আমানত ১ লাখ টাকা থেকে চারবার হাত বদলানোর ভেতর দিয়ে মোট ঋণ সৃষ্টি হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫২৬ টাকা। অর্থাৎ একটি প্রাথমিক আমানতের (১ লাখ টাকা) বিপরীতে চারবার সৃষ্ট ঋণের মাধ্যমে অর্থের সরবরাহ বেড়ে গেছে তিন গুণের কাছাকাছি। পরবর্তী ধাপে আরো কয়েকবার ঋণ বিতরণ করলে এটি চতুর্গুণ হয়ে যাবে। এভাবে অসংখ্যবার ঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে ব্যাংকের আমানত থেকে সৃষ্টি হয় অর্থের জোগান। বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের হার যদি ১৭ শতাংশ না হয়ে আরো কম হতো (বাংলাদেশে বর্তমানে সিআরআর ৪ শতাংশ এবং এসএলআর ১৩ শতাংশ মিলিয়ে মোট হার এখন ১৭ শতাংশ), তাহলে আরো বেশি পরিমাণে ঋণ বিতরণ করা যেত এবং তাতে আমানত সৃষ্টি তথা অর্থের জোগান হতো আরো বেশি। ব্যাংকের আমানত থেকে ঋণ সৃজনের এ প্রক্রিয়া ও ফলাফল থেকে একটি দেশের অর্থনীতিতে আমানতের অবদান সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং পরিস্থিতি বর্তমানে যে খুব ভালো, সেটি বলা যায় না কোনোভাবেই। ব্যাংকগুলোর কাঠামোগত দুর্বলতা, সুশাসনের ঘাটতি, অবাধ লুণ্ঠন, ঋণ খেলাপের অপসংস্কৃতি এবং জবাবদিহিতার অভাবের কারণে সাধারণ মানুষ তথা আমানতকারীদের মধ্যে কিছু সংশয় থাকলেও সেটা লাঘব হয়েছে আমাদের দুর্বল ব্যাংকগুলোরও টিকে থাকার অদম্য অদৃশ্য শক্তি এবং তুলনামূলক লাভজনক বিকল্প বিনিয়োগ ক্ষেত্রের অভাবের মধ্য দিয়ে। অতীতে দেখা গেছে অনেকবার বিভিন্ন ব্যাংক চরম দুরবস্থায় পড়লেও সেসবের পতন বা অবলুপ্তি ঘটেনি, উন্নত বিশ্বে যেটি প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা। এ অর্থে বলা যায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো গ্রাহক বা আমানতকারীদের নিরুপায় আস্থা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, সেই সঙ্গে কোনোভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে বেশকিছু পড়ো পড়ো ব্যাংককে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ এখানে উল্লেখ করা যায়। প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকে উচ্চ মুনাফার হাতছানি দিয়ে সহজেই আকৃষ্ট করা যায়, সেটি দুর্বল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ সুদ বা মুনাফার প্রতিশ্রুতি কিংবা বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এমএলএম কোম্পানির নানান লোভনীয় প্রস্তাব—যা-ই হোক না কেন। আমাদের পুঁজিবাজার দুর্বলতা বা একটা কার্যকর বন্ড মার্কেটের অনুপস্থিতির কারণে ঝুঁকির সম্ভাবনা ও কম মুনাফা সত্ত্বেও মানুষ এখনো ব্যাংককেই তাদের ভরসার জায়গা বলে মনে করে।
শত দুর্বলতা সত্ত্বেও যেসব ব্যাংক পতনের দুয়ার থেকে ফিরে এসে চালু রয়েছে, সেগুলোর পরিচালন অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। কারণ এটা এখন প্রকাশ্য যে এসব ব্যাংকের সুশাসনে মারাত্মক ঘাটতি ছিল। সেই ঘাটতি এমনই চরম যে তাদের ঋণ বিতরণ কর্মকাণ্ড ছিল লুণ্ঠনেরই নামান্তর। এ রকম আস্থাবিধ্বংসী অপকর্মের জন্য দায়ী মূল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ব্যাংক কর্মকর্তাকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে বটে, কিন্তু মূল হোতাদের কাছে কোনো কঠোর বার্তা পৌঁছায়নি। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ভুলে যান যে সাধারণ মানুষের আমানতের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয় তাদের ব্যবসা। সে কারণে অন্য যেকোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় ব্যাংক একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারিতে থাকে। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থ লুণ্ঠনের মতো অপকর্ম ঘটে গেছে একের পর এক। বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে ব্যাংকগুলোর পরিচালন দুর্বলতা ও সুশাসনের মারাত্মক ঘাটতির কথা এখন সাধারণ মানুষের অবিদিত নয়। তার পরও কোনো উপায়ান্তর না দেখে সচেতন মানুষ অপেক্ষাকৃত সবল ভিত্তি এবং সুশাসন-সংবলিত ব্যাংকগুলোকে বেছে নেন।
আমাদের ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ওপরের মূল্যায়ন থেকে এমন ধারণা করা সংগত হবে না যে দেশের সবগুলো ব্যাংকেরই এমন দুরবস্থা। দেশে এখনো কয়েকটা ব্যাংক রয়েছে, যেগুলো হতে পারে একটি সুশাসিত ব্যাংকের দৃষ্টান্ত। মানুষের আস্থার ঘাটতি মেটানোর জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করা এবং দেশে বিরাজমান ব্যাংকিং আইন ও নীতিমালার সঠিক পরিপালন। বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে তার মাধ্যমেই নানান বিষয় ও সমস্যার সমাধান সহজতর হবে এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে মানুষের আস্থা। তার জন্য নিশ্চিত করতে হবে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোর সংস্কার, স্বচ্ছতা, কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক, ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক