অনেক কাল আগের কথা। তখন মনে করা হতো অর্থনৈতিক মন্দা জীবনের একটা অংশ। এটি নিয়তি, এটি আসবেই। মানুষের লোভে পাপ, পাপে মন্দা জাতীয় একটা অনিবার্য পরিণতি। ফলে অর্থনৈতিক মন্দা এলে যেভাবে অর্থনীতি পরিচালিত হতো, সেটি এ মন্দাকে আরো দীর্ঘায়িত করত। দীর্ঘদিন ধরে একটা দেশ মন্দার দুষ্ট চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকত।
যে ঘটনার মাধ্যমে মন্দার এই দুষ্ট চক্র থেকে অর্থনীতি পরিচালনার কৌশল নিজেকে মুক্ত করতে পারল, সেটিকে অর্থনীতিতে বিশ শতকের সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে অনেকেই মানেন।
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস ১৯৩৬-এ প্রকাশিত বই জেনারেল থিওরি অব এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট অ্যান্ড মানি’-তে প্রথম এ মন্দার প্রকৃতি উন্মোচন করেন। তিনি দেখান যে মন্দার সময় অর্থনীতিতে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকরা বেকার হয়ে যান, সামগ্রিক আয় কমে যায়। ফলে ভোগ্যপণ্যের ওপর খরচ বা ব্যয় অনেক কম হতে শুরু করে। বিক্রি কমে যাওয়ার ফলে ব্যবসার অবস্থা আরো খারাপ হয়, আরো শ্রমিক বেকার হয়, ভোগ্যপণ্যের ওপর ব্যয় আরো কম হয়। তখন ব্যবসার অবস্থা আরো খারাপ হয়, আরো শ্রমিক চাকরি হারান। এভাবে এটা একটা মন্দার দুষ্ট চক্র গড়ে তোলে।
কেইনস বলেন, এ দুষ্ট চক্রকে শিষ্ট চক্রতে পরিণত করা যেতে পারে যদি মানুষজনকে আরো বেশি খরচ করতে উৎসাহিত করা যায়। এতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যবসা আরো বাড়বে, শ্রমিক ছাঁটাই কমবে, নতুন করে নিয়োগ হবে, শ্রমিকদের আয় বাড়বে, তারা তখন আরো কেনাকাটা করবে। ফলে আরো ব্যবসা বাড়বে, আরো শ্রমিক নিয়োগ হবে—এভাবে চক্র চলতে চলতে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগবে।
কেইনসের এই থিওরি এখন অর্থনীতিতে স্ট্যান্ডার্ড টেক্সটবুক তত্ত্ব হয়ে গেছে। এ তত্ত্বে অর্থনৈতিক মন্দা প্রতিহত করার জন্য দুই ধরনের নীতি নেয়া যেতে পারে। একটি হলো মুদ্রানীতি বা মনিটারি পলিসি। আর অন্যটি হলো, আর্থিক নীতি বা ফিসক্যাল পলিসি। আর্থিক নীতিতে মুদ্রাপ্রবাহ বাড়িয়ে সুদের হার কমিয়ে দেয়া হয়, যাতে সাধারণ নাগরিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে বিভিন্ন খাতে ব্যয় করতে পারে, নতুন কোনো খাতে বিনিয়োগ করতে পারে।
অন্যদিকে আর্থিক নীতিতে সরকারি ব্যয় সাময়িকভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয় অথবা কর কমিয়ে দেয়া হয় বা কিছু ক্ষেত্রে মওকুফ করা হয়। সরকারি ব্যয় বিভিন্নভাবে হতে পারে। সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে নগদ টাকা তুলে দেয়া হতে পারে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অত্যন্ত কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হতে পারে।
উপরে বর্ণিত অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার জন্য যে পদ্ধতিগুলোর কথা বলা হয়েছে, তা প্রয়োগের ক্ষেত্র এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত সারা বিশ্বে।
বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণে একটা বিরাট অর্থনৈতিক মন্দা আসছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এটা কোনো অঞ্চলে সীমাবদ্ধ মহামারী বা এপিডেমিক নয়। এটা সত্যিকারের একটা প্যানডেমিক বা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারী।
ইনিশিয়েটিভ অন গ্লোবাল মার্কেটস (আইজিএম) হচ্ছে শিকাগো বুথ স্কুল অব বিজনেস থেকে উদ্যোগ নেয়া একটা প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রথিতযশা ৫১ জন অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে তাদের কাছ থেকে নিয়মিত ভোট নেয়া হয়। করোনা মহামারীর বিষয়ে এ অর্থনীতিবিদরা একমত হয়েছেন যে ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা আসছে।
সেই বিপদের পূর্ণ আলামত সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে। আমেরিকা, ইউরোপের স্টক মার্কেটে বিশাল ধস নেমেছে। আমেরিকার সূচক স্টক মার্কেটের সূচক প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। আমেরিকা থেকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের জানুয়ারি ৬ থেকে মার্চের ৮ তারিখ পর্যন্ত ৯৮ শতাংশ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পাওয়া তথ্য থেকে জানাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় মার্চের মাঝামাঝি এসে রেস্তোরাঁয় রিজারভেশন কিংবা ওয়াক-ইন ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কমে গেছে। চীনে দেখা গেছে যে ফেব্রুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহেই গাড়ির বিক্রি প্রায় ৯২ শতাংশ কমে গেছে। এদিকে বাল্টিক ড্রাই ইনডেক্স, যেটি সারা পৃথিবীতে জাহাজে পরিবহনের পরিমাণ দেখায়, মার্চে ৪০ শতাংশ কমে গত ১২ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কমে এসেছে। একইভাবে বিমান ও পরিবহনের সূচকেও ব্যাপক পতন ঘটেছে।
এ সবকিছুই হচ্ছে একটা দীর্ঘমেয়াদি মন্দার পূর্বলক্ষণ। উপরে বর্ণিত অর্থনৈতিক মন্দার দুষ্ট চক্র তৈরি হওয়ার জন্য পরিপূর্ণ সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি।
তো কেইনস এক্ষেত্রে যেটা বলেছেন, এ অবস্থা মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্রকে দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে হবে এ চক্রের একদম শুরুতেই। অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করতে হবে। সেটা হবে আর্থিক নীতি ও খরচ নীতি—এ দুটোর যুগপৎ প্রয়োগে।
এ মুহূর্তে মুদ্রানীতি কতটুকু সাফল্য দেখাবে, এটি বলা মুশকিল। করোনাকালের আগে থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো তারল্যের সংকটে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সোয়া ১ লাখ কোটি টাকায়। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ এর দ্বিগুণেরও বেশি। আবার এদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকারকে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অনেক কমে গেছে। গত বছরের নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে গিয়ে ৯ শতাংশে এসে ঠেকেছে, যেটা ২০০৮ সালের পরে সবচেয়ে কম।
সেভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আর্থিক নীতি মন্দা মোকাবেলায় মূল ভরসা হতে পারে। এর মাধ্যমেই মন্দার দুষ্ট চক্রকে শিষ্ট চক্রতে পরিণত করা যেতে পারে। কিন্তু আর্থিক নীতির মূল সাফল্য নির্ভর করবে এটির গঠন, লক্ষ্য ও সফল প্রয়োগের ওপর।
২০১৭-এর বাংলাদেশের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণের মধ্যে কর্মরত জনবলের সংখ্যা ছয় কোটির বেশি। এদের বেশির ভাগ, প্রায় ৮৫ ভাগই, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যেখানে কোনো সামাজিক, আইনি সুরক্ষা নেই, পেনশন বা অন্যান্য ভাতার ব্যবস্থা নেই।
এই সুরক্ষাবিহীন শ্রমশক্তির মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অংশ হচ্ছে যারা দিনমজুর। এদের অংশ হচ্ছে প্রায় ১৫ শতাংশ। সে হিসাবে ৯০ লাখ দিনমজুর এই নভেল করোনাভাইরাসের আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা আসায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ দিনমজুরদের মধ্যে রয়েছেন শুধু ১০ থেকে ১৫ লাখ রিকশাচালকই। বাকিদের মধ্যে রয়েছেন ভ্যানচালক, সিএনজি ড্রাইভার, আবাসন, যোগাযোগ খাতে নিয়োজিত শ্রমিক ইত্যাদি।
বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্নভাবে এই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। আমরা যদি শুধু প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ভারতের দিকে তাকাই, ভারত প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজের ব্যবস্থা করছে দরিদ্রকে সহায়তা করার জন্য। এদিকে পাকিস্তান ঘোষণা করেছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা গত ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে যা শুনেছি তা হলো, প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়া হবে। এটি মূলত ব্যয় হবে গার্মেন্ট শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন ও ভাতা হিসেবে। কিন্তু উল্লিখিত বিরাট অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে থাকা শ্রমিকশ্রেণীর জন্য কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ‘ঘরে ফেরা’ নামে একটি কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে, যেখানে গ্রামে ফিরে যাওয়া গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ছয় মাসের খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ খাতে কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে, সেটির কোনো উল্লেখ নেই, কীভাবে এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা দেয়া হবে এর বিস্তারিত তথ্যও জানার উপায় নেই। এছাড়া শিল্প খাতে পোশাক শিল্প ছাড়াও আরো ৫০ থেকে ৬০ লাখ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ঝুঁকির মধ্যে আছে। পোশাক শিল্পের দিকে সরকারের মনোযোগ রয়েছে, কিন্তু সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে আবার পোশাক কারখানা চালু করে শ্রমিকদের শহরে আসতে বাধ্য করা এবং শেষে তাদের ঢুকতে বাধা দেয়া, পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকারের দিশেহারা ভাবকেই ফুটিয়ে তোলে।
সরকারকে খুব দ্রুত আরো কার্যকরী, আরো সবলভাবে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে, সেটির পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন ডলার এবং সেটি সেই দেশের জিডিপির ১০ শতাংশের মতো। ভারত খরচ করছে ২৩ বিলিয়ন ডলার, যেটি ভারতের জিডিপির ১ শতাংশের মতো।
সেই হিসাবে ৫ এপ্রিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার নতুন আর্থিক প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এটি একটি আশাব্যঞ্জক ঘটনা। কিন্তু কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশ যে কৃষি খাত থেকে আসে, সেই খাতের বিষয়ে এ প্রণোদনা প্যাকেজে কিছু নেই, এটি একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত।
তার পরেও বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত যা ঘোষণা করেছে, সেটি জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের মতো। এটি আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার জন্য অপ্রতুল। ভারতের অর্থনীতিবিদরা সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন জিডিপির ৪ থেকে ৫ শতাংশ খরচ করতে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রণোদনা এর চেয়ে কম কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। সে হিসাবে প্রায় সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে একটি বরাদ্দের কথা বাংলাদেশ সরকারকে ভাবতে হবে।
তবে বাংলাদেশের দুর্বল ও দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য শুধু অর্থ বরাদ্দই নয়, সেই অর্থের সঠিক ব্যবহার, সঠিক ব্যক্তির কাছে পৌঁছানোটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সরকারের সামনে এখন দুটি বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। একটা হলো নভেল করোনাভাইরাসের আগ্রাসনের ফলে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়, একই সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যাওয়ার ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়। একটির সঙ্গে আরেকটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন সরকার যদি চায় শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষজন লকডাউনে থাকবে, তাহলে অবশ্যই তাদের বাড়ি বাড়ি দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ পৌঁছে দিতে হবে। অথবা তাদের হাতে ক্যাশ টাকা তুলে দিতে হবে। তা না হলে তারা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য বাসায় বসে থেকে না খেয়ে মরার অপেক্ষায় থাকবে, এটা নিশ্চয়ই আমরা কেউ আশা করি না।
ড. রুশাদ ফরিদী: সহকারী অধ্যাপক
অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়