ইরানের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি ভেঙে দেয়ার সঙ্গে দেশটিতে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার কোনো সম্পর্ক নেই। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাবি, এই হামলার সময়সূচি ২০২৪ সালের নভেম্বরেই নির্ধারিত হয়েছিল। বাস্তবে এই ‘জিরো আওয়ার’ শুরুর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সম্ভাব্য কূটনৈতিক কাঠামোকে ব্যাহত করা। যে কূটনৈতিক তৎপরতায় ও আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বৈধতা পেতে পারত।
এই যুদ্ধ ইরানের বিরুদ্ধে কোনো আগাম আঘাত নয়—এটি কূটনীতির বিরুদ্ধেই একটি আগাম হামলা। ইরানের সঙ্গে আলোচনা চলার সময়েই এ সম্পর্কে অগ্রগতির ব্যাপারে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের অবহিত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই বিশেষ সুবিধা ইসরায়েলকে সুযোগ দিয়েছে কৌশলগতভাবে হামলার সময় নির্ধারণ করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে।
বেশ কিছু নিরপেক্ষ সূত্রের ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ওমানের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছিল—যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির পরিদর্শন, সমৃদ্ধকরণের সীমাবদ্ধতা এবং কঠোর নজরদারির অধীনে তেল রফতানি পুনরায় শুরু করা। আর এ ধরনের একটি চুক্তি ইসরায়েলের বহু দশকের সেই নীতিকে অকার্যকর করে দিত, যেখানে তারা দাবি করে, শুধু জবরদস্তির মাধ্যমেই ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা সম্ভব। নেতানিয়াহুর পক্ষে এমন একটি নিয়মভিত্তিক কূটনৈতিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণ বা ভেটো দেয়া সম্ভব নয়। তার পক্ষে সম্ভব ছিল এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সেই সম্ভাব্য চুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করা। তিনি সেটাই করেছেন।
এই যুদ্ধ আরো একটি বৃহত্তর ইসরায়েলি কৌশলের অংশ—মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তির একচেটিয়া অধিকার বজায় রাখা। এটি নিছক কোনো প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল, যে কোনো আঞ্চলিক শক্তিকে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং সেই জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত রাখা।
ইরানে প্রথম বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা পরেই মার্কিন কর্মকর্তারা গম্ভীর মুখে ঘোষণা করেন, আমেরিকা তাতে অংশ নেয়নি। কিন্তু এই অস্বীকৃতি ছিল কৌশলগত, নীতিগত নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসন আশা করেছিল, তারা আলোচনার টেবিলে একটি আসন ধরে রাখতে পারবে এবং ইসরায়েলের হামলাকে চাপে পরিণত করা যাবে। এই হামলাকে ‘চমৎকার’ বলা, ইরানকে হুঁশিয়ারি দেয়া এবং একইসঙ্গে তেহরানকে চুক্তি করার আহ্বান জানানো— ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বৈত বক্তব্য গোটা পরিকল্পনাটিই স্পষ্ট করে তুলেছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও যখন বলেন আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে হামলায় জড়িত নয়, তখন ইসরায়েল ঘোষণা করে যে, হামলার প্রতিটি ধাপই পেন্টাগনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। এই দুই বিপরীত বর্ণনার মধ্যে ফাঁকা জায়গাটি উভয় রাজধানীরই কাজে লেগেছে। ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা তাদের ইসরায়েলি মিত্রদের আশ্বস্ত করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধকে সক্রিয়ভাবে উসকে দিচ্ছে না। আর তেল আবিবে নেতানিয়াহু এই অস্পষ্টতাকে কাজে লাগিয়ে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা করতে উস্কে দেন—যাতে ওয়াশিংটন আরো গভীরভাবে ইসরায়েলের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
নেতানিয়াহুর এই কৌশল নতুন কিছু নয়। কূটনৈতিক পথকে ধ্বংস করা, তারপর ওয়াশিংটনকে সেই ধ্বংসস্তূপ জোড়া লাগাতে বাধ্য করার মাধ্যমে ইসরায়েল আবারও একটি নতুন কৌশলগত ছাড় পেয়ে গেছে।
যুদ্ধ এবং গণহত্যার অস্ত্র হিসেবে ইসরায়েল যখন গাজায় না খাইয়ে মারার কৌশল ব্যবহার করছে, তখন ইরানের বসতিপূর্ণ এলাকায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বেসামরিক নেতা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে মারাত্মকভাবে সীমারেখা অতিক্রম করেছে নেতানিয়াহু প্রশাসন। সশস্ত্র সংঘাতের আইনে যোদ্ধা ও বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে একটি স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সীমারেখা মুছে দিয়ে ইসরায়েল ইরানকে প্রতিশোধের নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি দিয়ে দিয়েছে। তেহরান যদি ইসরায়েলি নেতাদের ও কমান্ডারদের ব্যক্তিগত বাড়িগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানায় তবে সেই প্রেক্ষাপটে তেল আবিব নিজেদের ‘ভুক্তভোগী’ হওয়ার দাবি জানাতে পারে না।
লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলন বা গাজায় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের যেসব সংঘাত হয়েছে, তা ছিল অসম এবং খণ্ডযুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধ একটি রাষ্ট্রভিত্তিক সংঘর্ষ, যা ইসরায়েলের বহুদিনের সামরিক আধিপত্য এবং প্রতিরোধের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলায় এরইমধ্যে ফুটে উঠেছে যে, সমানতালে আরো সংঘর্ষ হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী এ লড়াইয়ের যুদ্ধক্ষেত্র আর শুধু গাজা, পশ্চিমতীর বা দক্ষিণ লেবাননেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং স্থানান্তরিত হয়ে তেল আবিবের মূল অংশেও পৌঁছাবে।
পরবর্তী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানই নির্ধারণ করবে এর পরিণতি। যদি উপসাগরে থাকা মার্কিন ডেস্ট্রয়ার কিংবা আঞ্চলিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন ধ্বংস করতে সক্রিয় হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আর শুধু একজন পর্যবেক্ষক থাকবে না, বরং সরাসরি পক্ষ হয়েই কাজ করবে। তাছাড়া, এই ধরনের তথাকথিত ‘প্রতিরক্ষামূলক’ পদক্ষেপ দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একটি প্রতিরোধ আরেকটি প্ররোচনার জন্ম দেয়, এবং প্রতিটি পাল্টা আঘাত যুক্তরাষ্ট্রকে আরো যুদ্ধের আরো গভীরে টেনে নেবে।
দিনের শেষে, কতগুলো সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস করলেন কিংবা কতজন ইরানি বিজ্ঞানীকে হত্যা করলেন তা দিয়ে নেতানিয়াহুর সাফল্য পরিমাপ করা হবে না। বরং তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের বানানো আরেকটি যুদ্ধের ফাঁদে আমেরিকাকে কতটা ফেলতে পারলেন—যার খেসারত দিতে হবে আমেরিকানদের, কৌশলগতভাবে, আর্থিকভাবে, জীবন দিয়ে এবং নৈতিকভাবে।
ওয়াশিংটন যদি সত্যিই উত্তেজনা বৃদ্ধি ঠেকাতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে এই পরিস্থিতির জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা করার যেকোনো চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এর চেয়ে কম কিছুর মানে হবে সতর্কতার মুখোশে মদত দেয়া। এবং তা আরো একবার প্রমাণ করবে, আমেরিকার নিজস্ব কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ধ্বংস করে ইসরায়েল যুদ্ধের জন্ম দিলেও ইসরায়েলের দায়মুক্তি ওয়াশিংটন থেকেই নিশ্চিত করা হয়।