ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করার সাহস দেখিয়েছেন, যখন তিনি নিজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মদদে গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে গণহত্যা চালাচ্ছেন। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, ইসরায়েল এরইমধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে ১৪ দিনের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করেছে। তবে নেতানিয়াহুর এ বিষয়ে ইঙ্গিত অনির্দিষ্টকালব্যাপী যুদ্ধের দিকে।
ইরানে ইসরায়েলের বিমান হামলার পূর্বে থেকেই এ বিষয়ে অবগত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। অ্যাক্সিওস সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সাহায্য করছে। ইসরায়েলের সহায়তায় দ্রুত এগিয়ে আসার পাশাপাশি, এক মার্কিন প্রতিনিধি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে কোনো হামলা হলে, ইরানের জন্য তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।‘
এই দ্বৈত নীতি যা আজ স্পষ্টভাবে উন্মোচিত এবং এখনো এই নীতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্র সার্বভৌম রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ কিংবা আগ্রাসনকে সহায়তা করতে পারে ‘সহায়তা’র ছদ্মাবরণে, অথচ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালে তা কঠোরভাবে দমন করার হুমকি দেয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আন্তর্জাতিক বিষয়ক ব্যুরোর সিনিয়র কর্মকর্তা ম্যাকয় পিট বলেছেন, প্রতিটি সার্বভৌম দেশের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং ইসরায়েল তার ব্যতিক্রম নয়।
তবে তিনি বলেননি—ইরানও এর ব্যতিক্রম নয়। মনে রাখতে হবে, সাবেক মার্কিন জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ও বিদেশী হস্তক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা পাঁচ বছরের মধ্যে সাতটি দেশকে টার্গেট করব—ইরাক, তারপর সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান এবং শেষ করব ইরানে।‘
যুক্তরাষ্ট্র ইরানে ইসরায়েলের হামলায় গভীরভাবে জড়িত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এর পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। যেমন ফ্রান্স। প্রতীকীভাবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার চিন্তা করা দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নোয়েল বারো বলেছেন ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার পুনর্ব্যক্ত করার কথা। যদিও বাস্তবে ইসরায়েলই প্রথম ইরানে হামলা চালিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওয়ং একই কণ্ঠেই কথা বলেছেন। চেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ান লিপাভস্কিও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে বাধাদানে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানকে সমর্থন দিয়েছেন।
ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আক্রমণকে সমর্থন করা বিশ্বনেতাদের প্রতি জিজ্ঞাসা—এইসব নেতারা কি কখনো ভেবে দেখেননি যে, তাদের কূটনীতি এমন একটি জোরপূর্বক বসতি স্থাপনকারী রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখছে যারা গণহত্যা শুরু করেছে, এবং দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র ও সক্ষমতা নিয়ে অস্পষ্ট কৌশল অবলম্বন করছে?
ইসরায়েলের এই অস্পষ্ট নীতি বেড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচর্যায়। ১৯৬৯ সালের ৭ জুলাই হেনরি কিসিঞ্জারের একটি স্মারক নথিতে তা স্পষ্টভাবে উঠে আসে। সে সময় ইসরায়েলের ফ্যান্টম বিমান কেনার প্রস্তাব আলোচনা করার সময় কিসিঞ্জার উল্লেখ করেন—‘ইসরায়েল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম দেশ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। তারা পারমাণবিক অস্ত্র রাখতে পারবে। তবে সেটা পরীক্ষা, মোতায়েন বা প্রকাশ করবে না। কারণ, কোনো দেশের কাছে পরমাণু অস্ত্র আছে এটা যদি সবাই জেনে ফেলে, তবে সেটি অনেকটা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের মতোই ফলাফল ডেকে আনে।
গাজার গণহত্যা তাই প্রশ্ন তুলেছে—এই অস্বচ্ছ নীতি কি পারমাণবিক অস্ত্র প্রকাশের চেয়ে কম বিপজ্জনক?
২০২৩ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলের মন্ত্রী আমিচায় এলিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েলের উচিত গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলা। নেতানিয়াহু সেই মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করলেও ফিলিস্তিনিদের সরকারিভাবে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে ধ্বংসের হুমকি পরোক্ষভাবে দেয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মেতে মার্কিন কংগ্রেসম্যান র্যান্ডি ফাইনও গাজায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলেন।
ইসরায়েল এখনো গাজায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেনি। তবে হিউম্যান রাইটস মনিটর ২০২৩ সালের নভেম্বরে জানিয়েছিল, গাজায় প্রায় ২৫,০০০ টন পরিমাণ বোমা ফেলা হয়েছে, যা দুইটি পারমাণবিক বোমার সমপরিমাণ। উল্লেখ্য, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আঘাত হানা আমেরিকার দুটি পারমাণবিক বোমা ছিল ১৫০০০ টন।
ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্রধারী ৯টি দেশের মধ্যে একটি, যার আড়াইশো পর্যন্ত ব্যালিস্টিক ওয়ারহেড তৈরির ফ্যাসিলিটি রয়েছে। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে—ইসরায়েল যখন বিশ্বকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির হাত থেকে সুরক্ষা দাবি করছে, তাহলে ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র থেকে সুরক্ষা কে দেবে?
আরেকটি সরল প্রশ্ন—ইসরায়েলের সামরিক ও পারমাণবিক শক্তির বিপরীতে গাজায় অসহায় ফিলিস্তিনিদের সক্ষমতার যে বিশাল ফারাক, বিশ্বনেতারা কি তা লক্ষ্য করেন?
নেতানিয়াহু মূলত ইরানের মধ্যে নতুন একটি শত্রুর ইমেজ উপস্থাপন করতে চান। যেমনটি তিনি লেবাননের ক্ষেত্রেও করেছিলেন। প্রতিটি নতুন অভিযানের আগে তার পরিকল্পনা বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়। তারপর ইসরায়েল হামলা করে সেটাকে আত্মরক্ষার কৌশল বলে প্রচার করে। পশ্চিমা নেতারা তা মেনে নিয়ে শান্তিমূলক কূটনীতিক আলোচনার কথা বলেন—ঠিক যেমনটি হয়েছে গাজার ক্ষেত্রে।
তবে গাজার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি হারানো চলবে না। কারণ, জায়নবাদী দখলদার উপনিবেশবাদ এড়ানোর পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাজাবাসী। আর সেখানে সংঘটিত গণহত্যা থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ সরিয়ে নিতে ইসরায়েল প্রয়োজনে শত্রু হিসেবে কাউকে কল্পনা করে। নিজেকে ‘নিঃস্ব’ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করা বজায় রাখতে অন্য দেশের প্রতিরোধ, আন্দোলন এবং পারমাণবিক কর্মসূচির দিকে মনোযোগ দেয় ইসরায়েল।
ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে— ইসরায়েল হচ্ছে জোরপূর্বক বসতি স্থাপনকারী এমন এক রাষ্ট্র, যারা বৈশ্বিক সমর্থন দিয়ে গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। আবার, নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে ধোঁয়াশা রেখে ইরানের বৈধ কর্মসূচিতে আঘাত হানছে।
হেনরি কিসিঞ্জারের কথাগুলোর দিকে ফেরা যাক। ইসরায়েল একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়ে নিজেদের অস্ত্র নিয়ে অস্পষ্ট নীতি অনুসরণ করে নিজেকে প্রশ্নের হাত থেকে রক্ষা করছে। তাদের অবস্থান যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যই বুঝে ওঠা কঠিন হয়, তাহলে গাজার মতো দুর্বল জায়গার জন্য বিষয়টি কত ভয়ানক হতে পারে, তা রীতিমত অকল্পনীয়।