আলোকপাত

ফেনী-কুমিল্লাসহ পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা: কারণ কী, দায় কার?

২১ আগস্ট ২০২৪ থেকে দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চলছে ভয়াবহ বন্যা। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে কয়েকটি জেলা, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর। এর মধ্যে ফেনী ও কুমিল্লার বন্যা ৩৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে জানা গেছে। আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ে ২৬ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৩ জনের মৃত্যুর

২১ আগস্ট ২০২৪ থেকে দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চলছে ভয়াবহ বন্যা। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে কয়েকটি জেলা, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর। এর মধ্যে ফেনী ও কুমিল্লার বন্যা ৩৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে জানা গেছে। আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ে ২৬ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৩ জনের মৃত্যুর খবর এবং প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বানভাসি মানুষকে উদ্ধার ও খাদ্যদ্রব্য সরবরাহে কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষ। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও দেখা দিয়েছে ব্যাপক বন্যা। ত্রিপুরা রাজ্য প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যায় ২৬ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৩১ জন মারা গেছে এবং ১৭ লাখ মানুষ সেখানে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিন দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে ভারতের ত্রিপুরায়। একদিকে বন্যার্তদের সাহায্য ও তাদের জন্য প্রার্থনা করছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং একই সঙ্গে এ বন্যার কারণ ও দায় নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোয় চলছে নানা মতামত, যার মধ্যে অনেক ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তিও ছড়ানো হচ্ছে। কেউ কেউ এ বন্যার একমাত্র কারণ হিসেবে ভারতের ত্রিপুরার গোমতী নদীর ওপর অবস্থিত দুম্বুর বাঁধের গেট খুলে বাংলাদেশের দিকে পানি ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ করছেন। চলমান এ বন্যার কারণ কী ও দায় কার—এ দুই বিষয় তুলে ধরার জন্য এ লেখা। 

তুলনামূলকভাবে কম বন্যাপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ফেনী ও কুমিল্লাসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায় চলমান এ প্রবল বন্যার কারণ বিশ্লেষণ করতে হলে এ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, নদ-নদী, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও গত কয়েক দিনের আবহাওয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। এ-সম্পর্কিত কিছু বিষয় নিচে তুলে ধরা হলো। 

ভৌগোলিক অবস্থান ও নদ-নদী: উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের মধ্যে একটি হলো ত্রিপুরা রাজ্য, যা বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত। রাজ্যটি মূলত পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে তিন হাজার ফুট পর্যন্ত উঁচু পাহাড় রয়েছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তঘেঁষে রয়েছে বাংলাদেশের সাতটি জেলা, যথা ত্রিপুরার উত্তরে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ, পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা, দক্ষিণে ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং পূর্বে খাগড়াছড়ি জেলা অবস্থিত। পাহাড়বেষ্টিত ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়গুলো থেকে উৎপন্ন হয়ে বেশ কয়েকটি নদী ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ১৫টি নদী ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যেগুলো হলো জুরি, মনু, ধলাই, লংলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হাওড়া, বিজনী, সালদা, গোমতী, ডাকাতিয়া, সিলোনিয়া, মুহুরী ও ফেনী। এর মধ্যে ত্রিপুরা থেকে ছয়টি নদী উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে, ছয়টি নদী পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে এবং তিনটি নদী দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। অর্থাৎ ত্রিপুরা রাজ্যটি পাহাড়বেষ্টিত হওয়ায় এ রাজ্যের বৃষ্টির পানি এ ১৫টি নদী দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে প্রবল গতিতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আর এ বৃষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি হলে তা ত্রিপুরা রাজ্যসহ এ-সংলগ্ন বাংলাদেশের সাতটি জেলায় বন্যা সৃষ্টি করতে পারে–যাকে বলা হয় আকস্মিক বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড। ত্রিপুরা ছাড়াও সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলের উত্তরে উঁচু উঁচু পাহাড়বেষ্টিত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অতি বৃষ্টির পানিও বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই আকস্মিক বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড তৈরি করে। গত মে-জুনে সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে কয়েক দফায় ভয়াবহ আকারে আকস্মিক বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড হয়েছিল। ভারত থেকে যে অঞ্চল দিয়েই বন্যার পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করুক না কেন সে পানি দেশের প্রধান নদীগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে এ বন্যা দেখা দিলে বঙ্গোপসাগরের অতিমাত্রার জোয়ারের (ভরা কোটাল) কারণে সেই বন্যার পানি ধীরগতিতে সাগরে নামতে থাকায় বন্যার প্রকোপ বেড়ে যায় ও বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। 

আবহাওয়া পরিস্থিতি: ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বর্ষাকাল মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বর্ষা ঋতুতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারি বৃষ্টি নিয়ে আসে, যা বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ত্রিপুরার গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা বেশি। সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলের উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বৃষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি হলেও সে তুলনায় ত্রিপুরা রাজ্যের গড় বৃষ্টির পরিমাণ কম। কিন্তু আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ আগস্ট ২০২৪ থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও তদসংলগ্ন বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে শুরু হয় মেঘ বিস্ফোরণ। পশ্চিম দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস দেশের পূর্বাঞ্চলের আকাশে প্রবেশ করে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা লঘুচাপ কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে কুমিল্লা-নোয়াখালীর সীমানায় চলে আসে। মৌসুমি বায়ুও এ সময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ তিন মিলে বিপুল পরিমাণ মেঘ কুমিল্লা-নোয়াখালীর আকাশে স্তরে স্তরে জমা হয়। একসময় তা বিস্ফোরিত হয়ে জনপদে নেমে আসে। আবহাওয়াবিদরা এটাকে বলছেন মেঘ বিস্ফোরণ বা ‘ক্লাউড ব্লাস্ট’। এরপর টানা তিনদিন প্রবল বর্ষণ আর উজান থেকে আসা ঢল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলকে বন্যায় বিপর্যস্ত করে ফেলে। মেঘ বিস্ফোরণ বিস্তৃত ছিল ভারতের ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের কুমিল্লা-ফেনী পর্যন্ত ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ১৯, ২০ ও ২১ আগস্ট এ এলাকায় অতিভারি বৃষ্টি হয়েছে। ১৯-২২ আগস্ট–এ চারদিনে শুধু ফেনীতে ৪৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, একই সময় কুমিল্লায় বৃষ্টি হয়েছে ৫৫৭ মিলিমিটার, নোয়াখালীতে হয়েছে ৬০৫ মিলিমিটার বৃষ্টি (সূত্র: প্রথম আলো), যা স্বাভাবিক বৃষ্টির তুলনায় অনেক বেশি। একই সময়ে ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলায় ৩৭৫ মিলিমিটার, গোমতী জেলায় প্রায় ৩৫০ মিলিমিটার এবং আগরতলা ও এডিনগরে ১৮০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আগস্টের স্বাভাবিক বৃষ্টির তুলনায় এই বৃষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি। 

চলমান বন্যার কারণ: ফেনী ও কুমিল্লায় ভয়াবহ বন্যাসহ ত্রিপুরা রাজ্যসংলগ্ন বাংলাদেশের অন্যান্য আরো পাঁচটি জেলা মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি এবং ভাটিতে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বন্যার কারণ মূলত প্রাকৃতিক–অর্থাৎ এ অঞ্চলগুলোয় একটানা অতিবৃষ্টি। এটি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। উজানে ত্রিপুরা থেকে আসা অতিমাত্রার পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে একটানা অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। একই সঙ্গে ১৯ আগস্ট পূর্ণিমা তিথি হওয়ায় সাগরে সৃষ্টি হয়েছে অতিমাত্রার উঁচু জোয়ার, যা নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বন্যার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং উজানের জেলাগুলোর বন্যার পানি সাগরে নেমে যেতে বিলম্ব হচ্ছে। এ বন্যা এ অঞ্চলগুলোর জন্য অস্বাভাবিক হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাঝে মাঝে এ রকম ভয়াবহ ঘটনা বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে হতে পারে বলে জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সবসময়ই সতর্ক করে আসছেন। 

এ বন্যার দায় কার? এ বন্যার কারণ ও দায় নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোয় চলছে নানা রকম মতামত, যার মধ্যে অনেক ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তিও ছড়ানো হচ্ছে। কেউ কেউ এ বন্যার একমাত্র কারণ হিসেবে ভারতের গোমতী নদীতে অবস্থিত দুম্বুর বাঁধের গেট খুলে বাংলাদেশের দিকে পানি ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ করছেন। অন্যান্য অঞ্চলের কিছু বড় ড্যামের পানি নিষ্কাশনের ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে এটিকে ত্রিপুরা রাজ্যের ড্যাম বলে প্রচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে এ বন্যায় ভারতের দায় (বিশেষ করে গোমতী নদীতে অবস্থিত দুম্বুর ড্যামের বাঁধের গেট খুলে দেয়া) নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে তা কতটুকু সত্য সেটি পরিষ্কার করে বলতে চাই। আগেই বলেছি, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়গুলো থেকে নেমে আসা ১৫টি নদী ত্রিপুরা সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশর সাতটি জেলা দিয়ে প্রবেশে করেছে এবং এ নদীগুলো উজানের বৃষ্টির পাহাড়ি ঢল বাংলাদেশে নিয়ে এসে বন্যার সৃষ্টি করে। এ ১৫টি নদীর মধ্যে একটি নদী হলো গোমতী নদী, যা ত্রিপুরার ডুম্বুর লেক (খাগড়াছড়ি সীমান্তের ঠিক উত্তরে) হয়ে উৎপন্ন ত্রিপুরার ভিতর দিয়ে ১২০ কিলোমিটারের বেশি প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করেছে। তারপর এ নদী কুমিল্লা শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বুড়িচং উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মুরাদনগর, গৌরীপুর হয়ে দাউদকান্দিতে এসে আপার মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে। ১৯৭৬ সালে ভারত সরকার গোমতী নদীটির উৎসমুখ দুম্বুর লেক হতে তিন কিলোমিটার ভাটিতে দুম্বুর ড্যাম নামে একটি জলবিদ্যুৎ তৈরির বাঁধ (ড্যাম) নির্মাণ করে। বাংলাদেশের কাপ্তাই ড্যামের তুলনায় এটি ছোট ড্যাম। দুম্বুর ড্যামের উচ্চতা ৩০ মিটার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ মেগাওয়াট এবং স্পিলওয়ে বা ইমার্জেন্সি গেটের সংখ্যা তিনটি, যেখানে কাপ্তাই ড্যামের উচ্চতা ৪৫ মিটার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট এবং স্পিলওয়ের বা ইমার্জেন্সি গেটের সংখ্যা ১৬ট। জলবিদ্যুৎ ড্যাম হচ্ছে নদীর দুই পাড়ের মধ্যে আড়াআড়িভাবে নির্মিত একটি উঁচু দেয়াল বা বাঁধ, যা বর্ষাকালে উজানের পানি জলাধারে আটকিয়ে রাখে এবং সেই জমানো পানি টারবাইনের ভিতর দিয়ে ছেড়ে দিয়ে সারা বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু জলাধারের পানির উচ্চতা ডিজাইন উচ্চতার চেয়ে বেশি হলে সেই পানি ড্যামের ওপর বা পাশে নির্মিত স্পিলওয়ে বা ইমার্জেন্সি গেট খুলে ছেড়ে দিতে হয়। কিছু ড্যামে এই স্পিলওয়ে বা ইমার্জেন্সি গেট পানির চাপে অটোমেটিক খুলে যায়। মনে রাখতে হবে যে, এই ছেড়ে দেওয়া পানি কিন্তু পুরো জলাধারের পানি নয়, বরং জলাধার পূর্ণ হবার পর উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি এবং এই অতিরিক্ত পানি ছেড়ে না দিয়ে গেট বন্ধ রেখে আটকানোর চেষ্টা করলে ড্যাম ভেঙ্গে পুরো জলাধাধারের পানি তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ভাটি অঞ্চলে মারাত্নক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। তাই জলাধার পূর্ণ হবার পর সর্বোচ্চ লেভেলের অতিরিক্ত পানি স্পিলওয়ে বা ইমার্জেন্সি গেট দিয়ে ছেড়ে দেয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে উজান হতে অতিরিক্ত পানি আসার কারণে বাংলাদেশের কাপ্তাই জলাধারের পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ লেভেল পৌঁছার পর অতিরিক্ত পানি কর্ণফুলী নদীতে নিষ্কাশনের জন্য কাপ্তাই ড্যামের ১৬টি জলকপাট বা স্পিলওয়ে গেটের সবগুলো গেট খুলে দিতে হয়েছিল। এমনকি কাপ্তাই জলাধারের পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ লেভেল ১০৯ ফুটের (মিন সী লেভেল) কাছাকাছি (১০৮ ফুট) আসায় গত ২৫ আগস্ট সকালে ড্যামের ১৬টি জলকপাট বা স্পিলওয়ে গেটের সবগুলো গেট খুলে দিতে হয়েছিল। কিছু পরিমাণ পানি ছেড়ে দেয়ার পর কাপ্তাই জলাধারের পানির উচ্চতা ডিজাইন লেভেলের নিচে নেমে যাওয়ায় ৬ ঘণ্টা পর ১৬টি জলকপাট বা স্পিলওয়ে গেট আবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এখন আসি ভারতের দুম্বুর ড্যামের দুটি ইমার্জেন্সি গেট খুলে দেয়ায় চলমান বন্যায় এর প্রভাব প্রসঙ্গে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, গোমতী নদীর ওপরে অবস্থিত দুম্বুর ড্যামের জলাধারটির সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৯৪ মিটার (মিন সী লেভেল)। উজানের তীব্র বৃষ্টিতে জলাধারের পানির স্তর সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতার বেশি হয়ে যেতেই জলাধারের তিনটি গেটের মধ্যে দুটি গেট পানির চাপে অটোমেটিক খুলে গিয়ে ভাটিতে পানি নেমে এসেছে, যা ভারতীয় অঞ্চলের ভিতর দিয়ে ১২০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যদিও কেউ কেউ দাবী করছেন, ড্যাম কর্তৃপক্ষ ডুম্বুর ড্যামের দুইটি ইমার্জেন্সি গেট নিজেরাই খুলে দিয়েছে। বিষয়টা যা-ই হোক না কেন, এই ছোট ড্যামের দুটি গেট দিয়ে ছেড়ে দেয়া পানি যে বাংলাদেশের ১১টি জেলায় এত বড় বন্যা সৃষ্ট করেছে বিষয়টা এমন নয়। দুম্বুর ড্যামের ইমার্জেন্সি গেট দিয়ে ছেড়ে দেয়া অতিরিক্ত পানি শুধু গোমতী নদী দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে এবং এ পানির পরিমাণ চলমান বন্যার ব্যাপকতার তুলনায় অনেক কম। আর গোমতী ছাড়া ত্রিপুরা হতে বাংলাদেশে প্রবেশ করা বাকি ১৪টি নদী দিয়ে কয়েকদিন ধরে যে প্রবল বেগে পাহাড়ি ঢলের ধারা নেমে আসছে, সেসব নদীতে ড্যামের কোনো তথ্য নেই বা গেট খুলে পানি ছেড়ে দেয়ারও কোনো ব্যাপার নেই। যেমন চলমান বন্যা সবচেয়ে বেশি ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে ফেনী জেলায়, কিন্তু ত্রিপুরা থেকে ফেনী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করা দুটি নদী মুহুরী ও ফেনীর সঙ্গে দুম্বুর ড্যাম বা গোমতী নদীর কোনোই সম্পর্ক নেই। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কয়েকটি নদীর পানির উচ্চতার তথ্য বিনিময় করার চুক্তি রয়েছে এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে সেই চুক্তি মোতাবেক ভারত কয়েকটি আন্তঃসীমান্ত নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পানির উচ্চতার তথ্য বাংলাদেশকে নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে বন্যা পূর্বাভাস দেয়ার গাণিতিক মডেলে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে জানা গেছে, দুম্বুর ড্যামের দুটি ইমার্জেন্সি গেট অটোমেটিক খুলে যাক অথবা ড্যাম কর্তৃপক্ষ খুলে দিক, সেই তথ্য সম্পর্কে ভারতীয় অঞ্চলের মাইকিং করা হলেও বাংলাদেশকে সেই তথ্য জানানো হয়নি। আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী এসব ক্ষেত্রে উজানের দেশ ড্যামের ইমার্জেন্সি গেট খোলা অথবা ড্যাম ভেঙে গেলে সে তথ্য অবশ্যই ভাটির দেশকে জানিয়ে দেবে, যাতে ভাটির দেশ বন্যার পূর্বাভাস দিতে পারে এবং বন্যার্ত অঞ্চল হতে লোকজনকে দ্রুত সরিয়ে নিতে পারে, এবার সেটির ব্যত্যয় হয়েছে এবং তার দায় ভারতের। 

পরিশেষে বলতে চলতে চাই, কয়েক দিন ধরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যসহ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় চলছে ব্যাপক বন্যা, যা ফেনী ও কুমিল্লা অঞ্চলে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এ বন্যার কারণ মূলত এ অঞ্চলগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-প্রকৃতির গঠন, নদ-নদীর অবস্থা, কয়েক দশকের মধ্যে অস্বাভাবিক অতিবৃষ্টি, মেঘ বিস্ফোরণ বা ‘ক্লাউড ব্লাস্ট’ এবং একই সময়ে পূর্ণিমা তিথির কারণে সাগরে সৃষ্ট অতি উচ্চতার জোয়ার। ত্রিপুরা রাজ্যের ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপর অবস্থিত দুম্বুর ড্যামের দুটি ইমার্জেন্সি গেট খোলার প্রভাব এ ভয়াবহ বন্যায় খুবই কম। তবে ড্যামের গেট খোলার তথ্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে না জানানোয় বন্যা ব্যবস্থাপনায় তার প্রভাব ব্যাপক না হলেও তা নেতিবাচক এবং তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। 

অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে ভারতের দায় কী: বাংলাদেশকে উপেক্ষা করে অভিন্ন নদীগুলোয় ভারত বহু বছর ধরে একতরফাভাবে ড্যাম, ব্যারাজ নির্মাণসহ শুকনো মৌসুমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে আসছে এবং পানি আটকে রাখছে, যা আন্তর্জাতিক পানি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমনকি বাংলাদেশ তার নিজের অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে পানি ব্যবস্থাপনার জন্য রাজবাড়ী জেলার পাংশায় গঙ্গা নদীর ওপর গঙ্গা বাঁধ (Ganges Barrage) নির্মাণের পরিকল্পনা ও ডিজাইন চূড়ান্ত করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণে তার বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অথচ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানি আটকিয়ে রেখে তা গড়াইসহ আরো কয়েকটি নদী দিয়ে সরবরাহের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা ও মরুকরণ প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখত। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে যে, গঙ্গা ছাড়া বাকি ৫৩টি অভিন্ন নদীগুলোতেও পানি চুক্তি করবে দুই দেশ, কিন্তু ভারতের অসহযোগিতার কারণে গত ২৮ বছরে আর একটি নদীতেও কোনো পানি চুক্তি হয়নি। ২০১১ সালে তিস্তা নদীর পানি চুক্তির খসড়া দুই দেশ অনুমোদন করলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে ভারত সরকার আজও সেই চুক্তি করতে সম্মত হয়নি। পানি চুক্তি না থাকায় শুকনো মৌসুমে গজলডোবায় নির্মিত ব্যারাজের মাধ্যমে ভারত তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প পানিশূন্য হয়ে পড়ে এবং তিস্তা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। কয়েক বছর ধরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নামে তিস্তা নদীর খনন ও নদীর দুই পাড় বাঁধাইয়ের মাধ্যমে নদীকে নিয়ন্ত্রণের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কথা শোনা গেলেও তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। 

এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তার অতীতের নতজানু ভাব পরিত্যাগ করে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক, উন্নত কূটনৈতিক যোগাযোগ (হাইড্রো-ডিপ্লোম্যাসি) এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং আগামীতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকারের কাছে দেশের জনগণের এ প্রত্যাশা।

ড. মো. আতাউর রহমান: অধ্যাপক, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

আরও