তরুণদের জন্য অর্থনীতির নতুন যাত্রা নাকি অতীতের ভুল

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় এক প্রলয়ংকরী দুর্যোগ। ‘সিডর’ নামের সেই ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আছড়ে পড়েছিল ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি গতিবেগের বাতাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের প্রায় ৩১টি জেলা। এতে প্রাণহানি হয়েছিল ১০

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় এক প্রলয়ংকরী দুর্যোগ। ‘সিডর’ নামের সেই ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আছড়ে পড়েছিল ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি গতিবেগের বাতাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের প্রায় ৩১টি জেলা। এতে প্রাণহানি হয়েছিল ১০ সহস্রাধিক মানুষের। লাখ লাখ মানুষের ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত ও সম্পদ বিনষ্টের পাশাপাশি ভেঙে পড়েছিল রাস্তাঘাটসহ যাবতীয় অবকাঠামো। 

ইতিহাসের ভয়াবহতম সেই ঘূর্ণিঝড়ের সময় দেশের শাসনভার ছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। অরাজনৈতিক সেই সরকারটি দায়িত্ব নিয়েছিল ওই বছরের ১১ জানুয়ারি। রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলে দায়িত্ব নেয়া সেই সরকারের জন্য বড় অথনৈতিক বিপর্যয় করেছিল সিডর। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদের ফসল, মাছ ও প্রাণিসম্পদ, যার প্রভাবে উসকে ওঠে মূল্যস্ফীতি। একই সময়ে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় সরকারের। 

রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি ওই সময় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যবসায়ীকেও জেলে পাঠানো হয়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্বের ফলে বাজারে তৈরি হয় সরবরাহের ঘাটতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দুর্বিষহ হয় সাধারণ মানুষের জীবন। আবার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো মেরামত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যর্থতায় সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয় জনতা। যে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট থাকেনি। বরং ২০০৯ সালের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর টানা সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। 

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন হয় শেখ হাসিনার সরকার। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে যান তিনি। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বাধীন সরকারের মেয়াদ মাত্র ২০ দিন পেরিয়েছে। এরই মধ্যে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাসহ দেশের ১২টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ভয়াবহ বন্যা। উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ভেসে গেছে অর্ধ কোটিরও বেশি মানুষের সহায়-সম্পদ। মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফল, ফসল, মাছ ও গবাদিপশু। ধ্বংস হয়ে গেছে রাস্তাঘাটসহ বহু অবকাঠামো।

এমনিতেই নাজুক পরিস্থিতি পার করছে দেশের অর্থনীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে গত দুই বছর ধরে। শেখ হাসিনা সরকারের শেষ মাস তথা জুলাইয়ে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ শতাংশেরও বেশি। কৃষির উৎপাদন, আমদানি, রফতানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক যখন ভয়াবহ চাপের মধ্যে সেই সময়েই আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ল বাংলাদেশ। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্থনৈতিক চাপ আরো বেশি তীব্র হয়েছে। বন্যায় সহায়-সম্বল হারিয়ে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে কয়েক লাখ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো সংস্কার ও পুনর্নির্মাণও এখন নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় পরিস্থিতিও বেশ নাজুক। এ পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতিকে টেনে তোলা খুবই কঠিন। তবে ব্যবসায়িক পরিবেশ দ্রুত স্থিতিশীল করার পাশাপাশি চুরি, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধ করা গেলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন কঠিন সময় পার করছে। এ সময়ে যেকোনো ভুল পদক্ষেপ অর্থনীতিতে আরো বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এ অধ্যাপক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক পদেও রয়েছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশের আর্থিক খাত তথা ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি একেবারেই নড়বড়ে। গত ১৫ বছরে এ খাতের সব নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বাজার ব্যবস্থা পুরোপুরি সিন্ডিকেট নির্ভর করে ফেলা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংক খাত সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছে। বড় কিছু ব্যবসায়ীর অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সরকারের যেকোনো পদক্ষেপই যেন বুঝেশুনে নেয়া হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো ভুল পদক্ষেপ অর্থনীতিকে আরো গভীর খাদে ফেলে দিতে পারে।’

সেলিম রায়হান বলেন, ‘অপরাধী ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করতে হবে। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে যাতে প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প-কারখানা যাতে বন্ধ না হয়ে যায়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার। আবার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বাজারে যাতে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।’

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবার আগে গ্রেফতার হন প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যানের পাশাপাশি আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদেও রয়েছেন তিনি। দেশের ওষুধ শিল্পের শীর্ষ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের পাশাপাশি বস্ত্র, সিরামিকস, রিয়েল এস্টেট, নির্মাণ, ট্রেডিং, সামুদ্রিক খাদ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মিডিয়া, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতের ৪০টিরও বেশি কোম্পানি রয়েছে বেক্সিমকোর। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে সালমান এফ রহমান এখন পর্যন্ত রিমান্ডে রয়েছেন। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এ ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেছিলেন।

সালমান এফ রহমান গ্রেফতারের পর তার ব্যক্তিক ও ব্যবসায়িক সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর আগে ৪ আগস্ট আশুলিয়ায় বেক্সিমকোর বস্ত্র কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট অগ্নিসংযোগ করা হয় সালমান এফ রহমানের গুলশানের বাসায়। বেক্সিমকো গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক হিসাব জব্দ করায় গ্রুপটির বেশির ভাগ কারখানা ও প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোয় অন্তত ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

২৪ আগস্ট রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেফতার হন সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। তার গ্রেফতারের পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী গ্রুপের সব কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গাজী গ্রুপের প্রতিষ্ঠান গাজী টায়ারের কারখানায় আগুন জ্বলছিল।

শুধু বেক্সিমকো কিংবা গাজী গ্রুপই নয়, এমপি-মন্ত্রীসহ শেখ হাসিনা সরকারঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী অনেক ব্যবসায়ীরই ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বিএফআইইউ। এরই মধ্যে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ছয়টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নতুন পর্ষদ দেয়া হয়েছে। আরো সাত-আটটি ব্যাংকের পর্ষদ দ্রুতই ভেঙে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করার দাবি জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটি কোম্পানির নামে ব্যাংকের শত শত কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোয় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ কিংবা জ্বালিয়ে দিলে ব্যাংকের ঋণ আদায় হবে না। আবার বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে যাবে। এটি কোনোভাবেই হতে দেয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই ব্যাংক খাত খেলাপি ঋণের ভারে বিধ্বস্ত। নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকলে ভালো ব্যাংকগুলোও বিপদে পড়বে। দেশের রফতানি খাতের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকেও রাষ্ট্র সংস্কারের বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সে সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে গিয়ে ব্যবসার পরিবেশই ভেঙে পড়েছিল। এ কারণে উসকে উঠেছিল মূল্যস্ফীতি। ২০০৬-০৭ অর্থবছরেও দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। পরের বছর তথা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির এ হার বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে ওঠে। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ২৮ শতাংশে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মুক্তি দিতে চালু করা হয়েছিল ‘অপারেশন ডাল-ভাত’ কর্মসূচি। পরবর্তী সময়ে যা বিডিআর বিদ্রোহের মতো মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরির সূত্রপাত ঘটিয়েছে। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে যেসব রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেগুলোও কোনো ফল বয়ে আনেনি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হয়ে উঠেছিল দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার প্রতিষ্ঠান। আর দুর্নীতি বন্ধের উদ্যোক্তারাই পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে দায়মুক্তির সনদ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে দেশের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণরা। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা তরুণদের একজন মামুন আব্দুল্লাহিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির এ সদস্য বণিক বার্তাকে বলেছেন, ‘আমরা এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চাই, যেখানে সাম্য থাকবে। ধনী-গরিবের সম্পদের বৈষম্য হ্রাস পাবে। মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। এ রাষ্ট্র ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য নিরাপদ হবে। নিশ্চিত হবে মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা। রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণী কী চায় এটা বড় কথা নয়, বরং রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে এ দেশের মানুষ কী চায় সেটা বড় কথা।’

তরুণদের এ স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব বর্তেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, এক-এগারোর প্রেক্ষাপট আর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট এক নয়। এ কারণে দুটি সরকারের কাছে প্রত্যাশার মাত্রাও ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সে সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ২০০৭ সালেও দেশের বিচার বিভাগ, ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠান অক্ষত ছিল। কিন্তু গত ১৫ বছর সব প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। দেশে এখন অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা বিচার বিভাগের কোনো প্রতিষ্ঠান বেঁচে নেই। এসব প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে গড়ে তোলাই হবে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’

পদচ্যুত হওয়ার আগে সরকারের ঘাড়ে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ রেখে গেছেন শেখ হাসিনা। দেশী ও বিদেশী উৎস থেকে এ ঋণ নেয়া হয়েছে। অথচ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। 

ঘোষিত বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় মেটানো ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে এ ঋণ নিয়েছে সরকার। যদিও শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির বেশুমার অভিযোগ রয়েছে। এ সময়ে অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। জনগণের লুণ্ঠিত এসব অর্থ পাচার হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী)। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্তও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে এসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালানোর সময় দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত ২ লাখ কোটি টাকার বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত মে মাসে দেশের আমদানি ছিল ৫১৮ কোটি ডলার। একই মাসে ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আর রেমিট্যান্স হিসাবে দেশে এসেছে ২২৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ ওই মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি ছিল। এ ধারাবাহিকতা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট দ্রুতই ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়তে শুরু করবে। 

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এখন সময় হলো আগুন নিবিয়ে ঘর গোছানোর। আগুন এখনো পুরোপুরি নেভেনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাও আগুন নেভানোর অংশ। নতুন সরকার গঠনের পর ২০ দিন পেরিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে পরিস্থিতির কিছু না কিছু উন্নতি হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হলে তরুণদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলা অসম্ভব হবে না।’

আরও