রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ কর্মসূচি

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মৌন মিছিল ও দেয়াল লিখনেও পুলিশি বাধা

সারা দেশে ছাত্র হত্যা, নির্বিচারে গ্রেফতার ও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে গতকাল ছিল রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ কর্মসূচি। এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সমবেত সংগীত, মৌন মিছিল, দেয়াললিখন, গ্রাফিতি অঙ্কন ও মোমবাতি প্রজ্বালন করেছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-জনতা। এ কর্মসূচিতে কয়েকটি স্থানে পুলিশি বাধার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া বেশ

সারা দেশে ছাত্র হত্যা, নির্বিচারে গ্রেফতার ও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে গতকাল ছিল রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ কর্মসূচি। এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সমবেত সংগীত, মৌন মিছিল, দেয়াললিখন, গ্রাফিতি অঙ্কন ও মোমবাতি প্রজ্বালন করেছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-জনতা। এ কর্মসূচিতে কয়েকটি স্থানে পুলিশি বাধার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া বেশ কয়েকজনকে আটক করা হলেও প্রতিবাদের মুখে পুলিশ তাদের ছেড়ে দিয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বরে গতকাল দুপুরে গ্রাফিতি অঙ্কন করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে কর্মসূচিতে যোগ দেন কয়েকজন শিক্ষক। এছাড়া শিক্ষকরা মৌন মিছিল করেন।

সরজমিনে দেখা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বরে সামনে কাপড় বিছিয়ে গ্রাফিতির মাধ্যমে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কন করছেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবনের সামনে ও পশ্চিম পাশের দেয়ালেও বিভিন্ন প্রতিবাদী লেখা ও চিত্র অঙ্কন করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। এখানে সংবাদপত্রে ছাপা পুলিশি নির্যাতনের ছবিসংবলিত পোস্টার আঁকছেন তারা। এ সময় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ আটকের চেষ্টা করে।

পুলিশের উদ্দেশে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ. আল মামুন বলেন, ‘আপনাদের কাছে শিক্ষার্থীদের আটক করার কোনো নথিপত্র নেই। সন্দেহের বশে কাউকে আটক করা অন্যায়। আপনারা এমনটা কখনই করতে পারেন না। এরপর যদি কোনো ছাত্রের গায়ে হাত পড়ে এবং আমার সহকর্মীদের গায়ে আঘাত লাগে, এটা কিন্তু আমরা মেনে নেব না।’

এদিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) সমন্বয়ক সুজয় শুভসহ ১২ শিক্ষার্থীকে ৫ ঘণ্টা আটকে রেখে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ববির প্রধান গেট থেকে প্রবেশের সময় তাদের আটক করা হয়। শিক্ষার্থীদের আটকের পর ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। পুলিশ সদস্যদের অবস্থানের পাশাপাশি মহড়া দিয়েছেন বর্ডার গার্ড সদস্যরা। তবে পুলিশ জানায়, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ তাদের হেফাজতে নিয়ে পরে ছেড়ে দেয়।

আটক শিক্ষার্থীরা হলেন ববি আন্দোলনের সমন্বয়ক সুজয় শুভ, ভূমিকা সরকার, অনিকা সরকার, সুজন আহমেদ, সিবাত আহমেদ, রাকিব আহমেদ, আরমান জাওয়াদ আবীর, মো. ইয়ামিন, মাহফুজুর রহমান, মো. ইমন ও মাহমুদুল হাসান।

একাধিক শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ছাত্র-শিক্ষক সংহতির কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসছিলেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় যানবাহন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ প্রথমে পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটক করে। এরপর সমন্বয়ক সুজয় শুভসহ আরো সাতজন বাস থেকে ক্যাম্পাসের সামনে নামামাত্র তাদেরও আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এ ঘটনার পর ছাত্রলীগ নেতা রক্তিম হাসানের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন লাঠিসোটা নিয়ে মহড়া দেয়। এরপর ববির গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢুকে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। এ সময় ক্যাম্পাসের সামনের ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে কিছু সময় পরপর মহড়া দিতে দেখা গেছে বিজিবি সদস্যদের। পুলিশের উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়।

শিক্ষার্থীদের আটকের খবরে বরিশাল মহানগর পুলিশের বন্দর থানায় ছুটে যান ববি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তাদের থানায় ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। এরপর মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে থানার গেটে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তারা। 

হতাহতদের স্মরণে নারায়ণগঞ্জ শহরে আয়োজিত ‘মোমশিখা প্রজ্বালন’ কর্মসূচি পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে গেছে। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। এতে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে শহরের চাষাঢ়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শতাধিক শিক্ষার্থী ও তাদের কয়েকজন অভিভাবক জড়ো হলে এ ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সাংবাদিকদের বলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে শহীদ মিনারে মোম হাতে দাঁড়িয়েছিলেন। কর্মসূচি শুরু করার আগেই পুলিশ তাতে বাধা দেয়। তাদের জানানো হয়, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে নিহত সহপাঠীদের স্মরণে মোমশিখা প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করবেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পুলিশ কোনো কথা না শুনেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করতে শুরু করে। পুলিশের লাঠিচার্জের পর শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। তবে তারা আশপাশের সড়কে অবস্থান করতে থাকে। এ সময় একাধিকবার পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। 

জানতে চাইলে ওই সময় পুলিশকে নেতৃত্ব দেয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘কোনো অনুমতি ছাড়া তারা কর্মসূচির জন্য জড়ো হয়েছিল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেই।’ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

গণগ্রেফতার ও হয়রানির প্রতিবাদে গতকাল প্রতিবাদী গানের মিছিল ও সাংস্কৃতিক সমাবেশ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বেসরকারি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষকও জাবির এ কর্মসূচিতে অংশ নেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একটি প্রতিবাদী গানের মিছিল বের করেন।

মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুরনো ফজিলাতুন্নেছা হল সংলগ্ন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে নবনির্মিত ছাত্র-জনতা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে যায়। পরে আন্দোলনে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে একই পথে আবারো প্রতিবাদী গানের মিছিল নিয়ে শহীদ মিনার চত্বরে জড়ো হন তারা। সেখানে এক সাংস্কৃতিক সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারের পাদদেশে একটি প্রতিবাদী পারফরম্যান্স আর্ট পরিবেশন করেন। 

এছাড়া শিক্ষার্থীদের হত্যা, হামলা, নির্যাতন ও গ্রেফতারের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে নিজ কার্যালয় থেকে তার ছবি সরিয়ে ফেলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামীমা সুলতানা। সাম্প্রতিক এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার অর্জন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। গতকাল দুপুরে অধ্যাপক শামীমা সুলতানার কার্যালয়ের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিতে শামীমা সুলতানাকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। তার পেছনে দেয়ালের ওপরের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখা গেলেও পাশে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ছিল না।

নিরপরাধ জনসাধারণ হত্যা, নিপীড়নের প্রতিবাদ এবং বিচারের দাবিতে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে মানববন্ধন ও মৌনযাত্রা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষকরা। গতকাল দুপুরে বৃষ্টি উপেক্ষা করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদী চত্বরে শিক্ষকরা মানববন্ধন করেন। এর আগে মৌনযাত্রায় পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন শিক্ষকরা।

মানববন্ধনে আর্টিটেকচার ডিসিপ্লিনের ড. অনির্বাণ মুস্তাফা বলেন, ‘এ প্রজন্ম আমাকে শিখিয়েছে দাসত্বের শৃঙ্খল কীভাবে ভাঙতে হয়। এক্ষেত্রে আমার ছাত্ররাই আমার শিক্ষক। আমি এখানে বিচারের দাবি নিয়ে আসিনি। কারণ রাষ্ট্র যখন গুলি করে, তখন বিচার পাওয়া যায় না।’

একই দাবিতে মানববন্ধন ও মৌন মিছিল করেছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষকরা। ‘সাধারণ শিক্ষকবৃন্দে’র ব্যানারে গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা স্তম্ভ ‘দুর্বার বাংলা’ চত্বরে এ কর্মসূচি পালিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হেলাল আন নাহিয়ানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহাজান আলী, ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন কৌশল বিভাগের অধ্যাপক শেখ শরিফুল আলম, মানবিক বিভাগের অধ্যাপক রাজিয়া খাতুন, পুরকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মীর আবদুল কুদ্দুস প্রমুখ।

কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন কৌশল বিভাগের অধ্যাপক শেখ মো. রবিউল ইসলাম, গণিত বিভাগের অধ্যাপক বিএম ইকরামুল হক, যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম, একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাহিম ইসলাম প্রমুখ। মানববন্ধন শেষে শিক্ষকরা মৌন মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রদক্ষিণ করে দুর্বার বাংলার পাদদেশে গিয়ে কর্মসূচি শেষ করেন।

অন্যদিকে কুড়িগ্রাম বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা মিছিল করেছে। এর আগে সকাল ১০টা থেকে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ থেকে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে বের হন। এ সময় বিদ্যালয় গেটে বাধা দেয় পুলিশ।

গাইবান্ধায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১১টার দিকে শহরের বাস টার্মিনাল এলাকার ডিবি রোডের কাদির অ্যান্ড সন্স তেলের পাম্পের সামনে থেকে একটি মিছিল বের করেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলে পুলিশ বাধা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে বিচ্ছিন্নভাবে পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন বিক্ষোভকারীরা। এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে মিছিলটি পলাশ পাড়া মোড় হয়ে ইউটার্ন নিয়ে ডিসি অফিসের সামনে যায়। এরপর তারা বাস টার্মিনাল এলাকার আর রহমান তেলের পাম্পের সামনে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারীদের চারপাশ ঘিরে রাখে।

এছাড়া যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও নওগাঁ থেকে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালনের খবর পাওয়া গেছে।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা)

আরও