প্রতিক্রিয়া

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেখার আছে অনেক কিছু

সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কার নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমেই এর প্রতিফলন ঘটেছে। ২০১৮ সালে ছাত্ররা কোটাবিরোধী আন্দোলন করলে সে সময় নির্বাহী বিভাগ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিষয়টিকে যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণ না করে অনেকটা

সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কার নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমেই এর প্রতিফলন ঘটেছে। ২০১৮ সালে ছাত্ররা কোটাবিরোধী আন্দোলন করলে সে সময় নির্বাহী বিভাগ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিষয়টিকে যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণ না করে অনেকটা আবেগতাড়িত হয়ে একটি পরিপত্রের মাধ্যমে এ কোটা সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়। এ বছর মুক্তিযোদ্ধাদের কতিপয় সন্তান এ পরিপত্র বাতিলের জন্য হাইকোর্টে রিট করলে হাইকোর্ট ওই পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করলে আবারো কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে তিনি শুরুতেই বিষয়টিকে আর্থসামাজিক বাস্তবতার আলোকে বিচার না করে পুরো বিষয়টিকে মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার বিতর্কের মধ্যে ফেলে এ সংস্কারের বাস্তবতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বসলেন। আবেগতাড়িত হয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করলে আন্দোলনকারীরা খুব সংগত কারণেই অপমানিত বোধ করেন এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, ‘চেয়েছিলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার’। এ স্লোগানকেও সরকারপক্ষ সহজভাবে নিতে পারল না। একজন মন্ত্রী তো বলেই ফেললেন, নিজেদের রাজাকার বলা ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ শামিল। অন্যদিকে সেতুমন্ত্রী প্রতিক্রিয়ায় বললেন, আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। সরকারি দল প্রায়ই ছাত্রলীগকে ‘লাঠিয়াল’ হিসেবে ব্যবহার করে সরকার এবং দলের মধ্যে ব্যবধানকে গুলিয়ে ফেলে। দীর্ঘকাল ধরে ছাত্রলীগকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে, এ সংগঠনটিকে সাধারণ ছাত্রদের কাছে একটি নির্যাতনকারী, জাবাবদিহিতাবিহীন অজনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত করেছে। এর সম্পূর্ণ দায় প্রধান দল আওয়ামী লীগ নেতাদেরই। তবে ছাত্রলীগ নেতৃত্বও এ দায় এড়াতে পারে না। 

মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা কমানোর পক্ষে কথা বলায় সরকার আন্দোলনকে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আন্দোলন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। বস্তুনিষ্ঠভাবে তারা এর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করেনি। ফলে সরকার সঠিক সময়ে, সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। এ কোটা আন্দোলনকারীরা যখন কঠোর কর্মসূচি দিল, সরকার তাদের পুলিশ দিয়ে দমানোর চেষ্টা করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের ফলে কয়েক দিনের মধ্যে দুই শতাধিক প্রাণহানি হয়, যার মধ্যে ১১৩ জন অল্পবয়সী বলে পত্রিকায় উঠে এসেছে। হতাহতদের সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি বলে জানা গেছে। এর মধ্যে কারো পা নেই, হাত নেই, চোখ নেই। মোদ্দাকথা, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে তা অবশ্যই শাসনের সংকট সৃষ্টি করতে বাধ্য, যা কোটা আন্দোলনের দাবি পূরণে সরকারের প্রাথমিক সাড়া থেকে সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আরো তিন-চারজন মন্ত্রীর ভাষার ব্যবহার এ সংকটকে উসকে দেয়। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে পরিশীলিত ভাষার প্রয়োগ সংকট সমাধানে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে ভূমিকা রাখে। 

কোটা আন্দোলন থেকে বিরোধী দলের জন্যও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তারা নিশ্চয়ই এটা লক্ষ করেছেন, কোটা সংস্কারপন্থীরা কোটা ব্যবস্থার উচ্ছেদ চাননি, তারা শুধু কোটা সংস্কার চেয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা কোটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছেন। ফলে অন্য স্টেকহোল্ডাররাও এ প্রস্তাবে চরম বিরোধিতা করেননি। আমরা দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরাও এর পক্ষে কথা বলেছেন। কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা পুরো বিষয়টিকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনের ফলে সর্বস্তরের মানুষ ছাত্রদের এ দাবি সমর্থন করেছে। জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধী দল তার আন্দোলনের ইস্যু নির্ধারণে সবসময় আগ্রাসী মনোভাবের সঙ্গে সরকারের পতন দাবি করলেও এটি তারা যৌক্তিকভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে তারা তাদের দাবির পক্ষে জন আস্থা অর্জনে সফলকাম হয়নি।

কোটা আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন প্রদান বিরোধী দলের জন্য কোনো অন্যায় বিষয় নয়। এটি স্বাভাবিক। কিন্তু কোটা আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার তারা যদি সত্যিই সরকার পতনের আন্দোলনের সফলতা চেয়ে থাকে, তবে তা আত্মঘাতী এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আরো একবার নতুন করে পেরেক ঠুকে দেয়া হলো। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আন্দোলনের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংসের মাধ্যমে যা করা হয়েছে, একে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়ে পরিণত করেছে। এক্ষেত্রে কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য শুভ নয়। তবে এবারকার সহিংসতার ধরনটি পূর্বপরিকল্পিত এবং নতুন ধরনের। তাই বিষয়টি গোপন তদন্তে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রকাশ্যে আনা আবশ্যক। যদি বিএনপি-জামায়াত এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে তবে অবশ্যই তাদের আইনের সামনে দাঁড়াতে হবে। তবে সবসময় বিএনপি-জামায়াতকে যুক্ত করলে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে চলে যেতে পারে। তাই চলমান অপরাধের প্রকাশ্য বিচার জরুরি। ঘটে যাওয়া সহিংসতা নিয়ে দু-একটি জিজ্ঞাসার সদুত্তর জানা প্রয়োজন। প্রথমটি মেট্রোস্টেশন অথবা ইন্টারনেট ডাটা সেন্টারের নিরাপত্তার বিষয়ে গোয়েন্দাদের ভূমিকা কী ছিল? রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা যখন বারবারই কোটা আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন টের পেলেন, তাহলে তারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে, সেটি পূর্বানুমান করতে পারলেন না কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব না পেলে আরো নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপন হতে পারে, যা সরকারের জন্য বিব্রতকর হবে। 

চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর অনেক কিছুই শেখার আছে। এ প্রশ্ন থেকেই তাদের শুরু করতে হবে যে আজ তাদের সমগ্র দেশের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বিতাড়িত হতে হলো কেন? সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্যাতন ভয়ভীতি প্রদর্শন সামান্য কারণে শিবির তকমা দিয়ে হল থেকে বের করে দেয়া, ক্যাম্পাসে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, গেস্টরুম কালচার এবং এগুলোই ছাত্রলীগকে হল থেকে তাড়ানোর পেছন থেকে কাজ করেছে। এসব কারণে ছাত্রলীগের প্রতি সাধারণ ছাত্ররা বিরক্ত। কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসবের প্রতিফলনও ঘটেছে। সর্বোপরি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গুটিকয়েক গঠনমূলক কর্মকাণ্ড বাদে (যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জো-বাইক সার্ভিস চালু) তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, যা সাধারণ ছাত্রদের মনে আস্থার জন্ম দিতে পারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে ছাত্রলীগের এ শিক্ষা নিতে হবে। যে কোটা সংস্কার নিয়ে তারা ভূমিকা রাখতে পারত, সেই কাজটি করে ফেলল অরাজনৈতিক (নির্দলীয় অর্থে) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা করতে পারল না, কারণ তারা মূল সংগঠনের লাঠিয়াল হিসেবেই শুধু ব্যবহার হয়। এ আন্দোলন থেকে তাদের শিখতে হবে সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থে কাজ না করলে ছাত্রদের অন্তরের সমর্থন তারা কখনো পাবে না। অন্ধ দলদাস হওয়া তাদের সুপ্ত সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে দেবে। ছাত্রলীগকে ভাবতে হবে ছাত্ররাজনীতিতে তারা স্বাধীন সত্তা নিয়ে কার্যকর থাকবে, না শুধুই প্রধান দলের হুকুম পালনেই ব্যস্ত থাকবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের জন্য তাদের এ আন্দোলন থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। যারা এ আন্দোলনে সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করেন তারা যথার্থ অর্থেই মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হয়েছেন। কখনই আবেগতাড়িত হননি। তবে তাদের এ নেতৃত্ব প্রচেষ্টা এখানেই থেমে থাকা উচিত হবে না। তারা ইচ্ছা করলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর স্বার্থে ‘সাধারণ ছাত্র ফোরাম’ নামে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আমি এটাই বলব, তারা যেন কোনো প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার না করেন। 

পরিশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, এটি একটি সফল সামাজিক আন্দোলন যেখানে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার পরিবার থেকে ছাত্ররা এর সঙ্গে সংযুক্ত হন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারের কোটা নীতির সংস্কার। এ অর্থে আন্দোলনটির রাজনৈতিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। 

ড. সাব্বির আহমেদ: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও