বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে যে বিদ্যুৎ কেনা হয় তার দাম নির্ধারণ হয় ডলারের হিসাবে। কিন্তু দুই বছরের বেশি সময় ধরে বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে দেশে ডলার সংকট। ফলে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদ্যুৎ বিল বাবদ সরকারকে ব্যয় করতে হয় বাড়তি অর্থ। এ অবস্থায় সংকটকালে বেসরকারি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ট্যারিফ ডলারের পরিবর্তে টাকায় নির্ধারণ করা যায় কিনা তা জানতে চেয়েছিল অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে গতকাল জানানো হয়েছে, ডলারেই নির্ধারণ করতে হবে সৌরবিদ্যুতের ট্যারিফ। মন্ত্রিসভা কমিটিও তা গ্রহণ করেছে।
তথ্যানুসারে, দেশে বেসরকারি পর্যায়ে যেসব সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে সেগুলোর ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জুলাইয়ের শুরুতে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে জানতে চাওয়া হয়। এর মধ্যে সৌরবিদ্যুতের স্ক্র্যাপগুলো পরিবেশবান্ধব কিনা, সৌরবিদ্যুতের দাম ডলারের পরিবর্তে টাকায় নির্ধারণ করা যায় কিনা এবং নবায়নযোগ্য এ বিদ্যুৎ নিয়ে নির্ধারিত কোনো লক্ষ্যমাত্রা আছে কিনা—এ বিষয়গুলো যথাযথ পর্যালোচনা করে অবহিত করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে বলা হয়েছিল। গতকালের বৈঠকে তা অবহিত করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলের ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। এক্ষেত্রে ডলারে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হয়। এসব প্রকল্পে যেসব বিদেশী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে তারাও ডলারেই বিনিয়োগ করে। তাছাড়া ভারত, ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সৌরবিদ্যুতের দাম ডলারের হিসাবেই নির্ধারিত হয়। ফলে সৌরবিদ্যুতের দাম টাকায় পরিশোধের সুযোগ নেই বলে মন্ত্রিসভা কমিটিকে অবহিত করা হয়।
সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌরবিদ্যুতের প্যানেলগুলো মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে স্থাপন করা হয়। ফলে এক্ষেত্রে মাটির কোনো ক্ষতি হয় না এবং প্যানেলের নিচে মাটিতে চাষও করা যায়। আর এসব প্যানেল অ্যালুমিনিয়াম, গ্লাস ও প্লাস্টিকের মতো উপাদানে তৈরি। ফলে এখানে তেমন কোনো স্ক্র্যাপ হওয়ার সুযোগ নেই।
মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি অনুমোদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া মন্ত্রিসভা কমিটি খানপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি পিপিপি তালিকা থেকে প্রত্যাহার এবং জিটুজি চুক্তির আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফার্টিগ্লোব ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের কাছ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইউরিয়া সার আমদানির চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টিও অনুমোদন করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের কিছু বিষয়ে মন্ত্রিসভা কমিটির পক্ষ থেকে এর আগের বৈঠকে জানতে চাওয়া হয়েছিল। সেগুলো গতকালের বৈঠকে প্রতিবেদন আকারে কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেছে।’
নগদ অর্থ সংকটের কারণে বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকি বাবদ বিপুল অংকের অর্থ বকেয়া হয়ে পড়ে সরকারের। এ ভর্তুকি পরিশোধে আলোচ্য দুই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা পরিশোধে অর্থায়নকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনুকূলে বিশেষ বন্ড ইস্যু করে সরকার। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সরকার ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতেই ইস্যু করা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বন্ড। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে ভর্তুকি পরিশোধের পরিবর্তে বন্ড ইস্যু না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনের পর সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ পরামর্শ দেয়া হয়।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্থিক বিচক্ষণতার সুরক্ষায় নতুন করে বকেয়া এড়ানোর পাশাপাশি এরই মধ্যে পুঞ্জীভূত বকেয়া পরিশোধ করা গুরুত্বপূর্ণ। স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদক (আইপিপি) ও সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বাড়তি ভর্তুকি দাবির কারণে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে জিডিপির ১ শতাংশ পরিমাণ বকেয়া জমেছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আইএমএফের কাছে নতুন করে বকেয়া পুঞ্জীভূত হওয়া এড়ানোর পাশাপাশি জমে থাকা বকেয়া পাঁচ বছরের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বাজেট থেকে পরিশোধের পরিকল্পনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও সার কোম্পানিগুলোর পাওনা পরিশোধে ভর্তুকির পরিবর্তে বিদ্যমান বাজারদরের চেয়ে কম সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ বন্ড ইস্যু বন্ধ করার কথাও বলেছে আইএমএফ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতের বড় অংকের অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে আর্থিক চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বিদ্যুতের ট্যারিফ ডলারে নির্ধারিত থাকায় টাকার অবমূল্যায়ন হলেই এ বাবদ সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়। সম্প্রতি বিশেষ বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের বড় অংকের বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে। এ অবস্থায় আইএমএফের পক্ষ থেকে নতুন করে আর বন্ড ইস্যু না করার পরামর্শ এসেছে। এতে নগদ অর্থ ছাড়া সরকারের কাছে বকেয়া পরিশোধের বিকল্পও সীমিত হয়ে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার চাইছে বিদ্যুতের ট্যারিফও টাকায় নির্ধারণের। যদিও ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের কারণে বিদ্যুতের ট্যারিফ টাকায় নির্ধারণের বিষয়টি আইপিপি ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা গ্রহণ করবে না।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের চুক্তিগুলো এখনো ডলারেই হচ্ছে। কারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ডলারেই করাকে নিরাপদ মনে করেন। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রায় চুক্তি হলে মূল্যস্ফীতি হলে তাতে বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তবে স্থানীয়ভাবে সৌরপ্যানেল উৎপাদনের সুযোগ থাকায় ভারত ও চীনে কিছু ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের ট্যারিফ স্থানীয় মুদ্রায়ও নির্ধারণ করা হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে এ পর্যন্ত সৌরসহ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের যতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে তার ১১টির মধ্যে নয়টিই বিদেশী বিনিয়োগে। বর্তমানে যেসব দেশ বাংলাদেশে সৌরসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ করছে তারা সবাই ডলারে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি রেখেই স্বাক্ষর করছে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য খাতে বেশির ভাগ বিনিয়োগ বিদেশী। এ খাতের যন্ত্রাংশগুলোর সিংহভাগই আমদানিনির্ভর। ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ডলারে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিকেই নিরাপদ মনে করেন।’