হত্যা, গণগ্রেফতার, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা এ কর্মসূচিতে কোথাও কোথাও পুলিশি বাধা, লাঠিচার্জ, ধস্তাধস্তি ও আটকের খবর পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ঘটেছে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনাও। এসব ঘটনায় আটক করা হয়েছে শতাধিক বিক্ষোভকারীকে। আহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। এর মধ্যে বরিশালে সাংবাদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন।
মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জমায়েত হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। জড়ো হতে থাকেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। দুপুর ১২টার দিকে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা হাইকোর্টের মাজার রোডে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন।
এদিকে সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ দুই শিক্ষার্থীকে আটকের চেষ্টা করলে ঢাবি লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রভাষক শেহরীন আমিন ভূঁইয়া বাধা দেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বোরহানুদ্দীন কলেজের একজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি ও আমার সহকর্মী নুসরাত জাহান গিয়ে বাধা দিই। পুলিশকে বললাম, তার অপরাধ কী? পুলিশ বলল, তল্লাশি চালাবে। তখন আমি পুলিশকে বলি, তল্লাশি করার থাকলে এখানে করেন। পুলিশ তখন বারবার বলপ্রয়োগের কথা বলে এবং একপর্যায়ে ধস্তাধস্তি করে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি ওই শিক্ষার্থীর হাত শক্ত করে ধরে রাখছিলাম। তখন একজন পুলিশ আমার হাত মুচড়ে দেয় ও আমাকে ধাক্কা দেয়। আমি হাতে বেশ ব্যথা পেয়েছি।’
এদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটা অংশ আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ তাদের বাধা দেয়। তখন ভেতরে আইনজীবীদের একটি দল মিছিল করছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আদালতে প্রবেশ করতে না পেরে দোয়েল চত্বরে কিছুক্ষণ অবস্থান নেন। পরে শহীদ মিনারে গিয়ে গতকালের কর্মসূচি সমাপ্ত করেন।
সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকায় ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে বাধা দেয় পুলিশ। বাধা অমান্য করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
আন্দোলনকারীরা জানান, শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টা থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকেন। পরে তারা অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে। শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টার দিকে সিলেট শহরের দিকে পদযাত্রা নিয়ে এগোতে থাকেন। সুবিদবাজার মোড়ে পৌঁছলে পুলিশ সদস্যরা তাদের পথ রোধ করেন। শিক্ষার্থীরা সুবিদবাজার মোড় সড়কে কিছু সময় অবস্থান করেন। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সামনে যেতে থাকেন। পুলিশ সদস্যরা সড়কের পাশে অবস্থান নিয়ে হঠাৎ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়েন। শিক্ষার্থীরাও ইটপাটকেল ছোড়েন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার ওপর নির্যাতন ও গণগ্রেফতারের প্রতিবাদে শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা।
খুলনায়ও ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে বাধা দেয় পুলিশ। তারা লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শিক্ষার্থীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। নগরের রয়্যালের মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে আল শাহরিয়ার বলেন, ‘পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতে অন্তত ৬০ জন আহত হয়েছেন। অসংখ্য শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে।’
বরিশালে আদালত চত্বরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হন। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত নগরীর ফজলুল হক এভিনিউর কাকলির মোড়, আদালত চত্বর ও নগর ভবন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কলেজের সমন্বয়ক সুজন আহম্মেদ বলেন, ‘পুলিশ চার শিক্ষার্থীকে আটক করেছে।’
চট্টগ্রামে বেলা ১১টার দিকে জেলা পরিষদ চত্বরে বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। পরে তারা পুলিশের বাধা ভেঙে আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আদালত প্রাঙ্গণের বদিউল আলম স্মারক ব্রিজের নিচে অবস্থান নেন। পরে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা এসে পাল্টা বিক্ষোভ করতে থাকেন। তারা সোনালী ব্যাংকের সামনে অবস্থান নেন।
বেলা আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীরা বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। কিন্তু সেখানে কেউ না থাকায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
নগর পুলিশের উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) এএনএম হুমায়ুন কবির সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘কোনো ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়া হয়।’
গাজীপুরে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। শহরের রেলগেট থেকে শুরু করে শিববাড়ী মোড় পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তারা। আন্দোলনকারীরা জানান, শিববাড়ী মোড়ে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়।
গাজীপুর সদর মেট্রো থানার ওসি রাফিউর রহমান জানান, পুলিশের বাধায় আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। তবে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
দিনাজপুরে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি থেকে ১০ জনকে আটক করার খবর পাওয়া গেছে। দিনাজপুরের শহীদ ময়দানের শহীদ মিনারের পাদদেশে কর্মসূচি পালনের সময় তাদের আটক করা হয়। দিনাজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোমিনুল করিম জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েকজনকে আনা হয়েছে এবং তাদের অভিভাবকদের খবর দেয়া হয়েছে।
‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ফরিদপুরে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। সকালে শহরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মিছিলটি বের হয়। শেষ হয় শামসুল উলুম মাদ্রাসার সামনে।
লক্ষ্মীপুরে আদালত চত্বরে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভের চেষ্টা করলে পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে যায়। পরে আন্দোলনকারীদের পক্ষে কিছু আইনজীবী বিক্ষোভের চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা বাধা দেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং হট্টগোল সৃষ্টি হয়।
এছাড়া শহরের বাগবাড়ী এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা সড়কে জড়ো হয়ে বিক্ষোভের চেষ্টা করেন। সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের বাগ্বিতণ্ডা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীকেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা করতে দেখা যায়। ফলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরে সেখান থেকে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয় পুলিশ।
যশোরে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এরপর অন্তত ছয়জনকে আটক করা হয়।
রাজশাহীতে আদালতের প্রধান ফটকে জড়ো হন আন্দোলনকারীরা। পরে পুলিশের গাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৫ জনকে আটক করা হয়। ঠাকুরগাঁওয়ে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এতে আহত হন দুই শিক্ষার্থী। হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজের সামনে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। পুলিশের বাধা অমান্য করে মিছিল হয় নরসিংদীতে। বগুড়া শহরেও মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। ময়মনসিংহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হয় পুলিশের বেষ্টনীতে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, যশোর, নরসিংদী ও ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি