কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশে সৃষ্ট বিক্ষোভ, সংঘাত-সহিংসতা দেশবাসীকে অস্থিরতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে দুই শতাধিক মানুষ। সারা দেশে এখনো জারি আছে নির্ধারিত সময়ের কারফিউ। মাঠে নিয়োজিত আছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে চলমান বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া; আটক হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। শিক্ষার্থীদের শুরু করা এ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বর্তমানে শিক্ষকরাও পালন করছেন নানা কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিতে সরব শিক্ষকদের মধ্যে অগ্রগামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সাক্ষাৎকার
ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সিনেট সদস্য। ২০২০ সালে ভারতের নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন (ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ) বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দিদারুল হক
কোটা সংস্কার আন্দোলনটি শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু তা সহিংস রূপ নিল কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোয় আন্দোলনটি শান্তিপূর্ণভাবেই শুরু হয়েছিল। এরপর আন্দোলনটি একটি পর্যায়ে সহিংস হয়ে যায়। সহিংস হয়ে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। নানাজন নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। তবে আমার দৃষ্টিতে কয়েকটি বিষয় মনে হয়েছে। আমাদের মাথায় রাখা দরকার, আন্দোলনটি করছে শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষার্থীদের যে বয়স সেটি ভীষণ আবেগপ্রবণ। তাদের বিশ্বাস ও ভাবনার জায়গাগুলো খুব স্বচ্ছ। ফলে তাদের বলা ও বিশ্বাসের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। তারা যেটি বিশ্বাস করে, সেটি পূর্ণ শক্তি দিয়েই বলে। এ আন্দোলন সরকার সহনশীল ও নিরপেক্ষভাবে মোকাবেলা করতে পারেনি। এক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
কীভাবে মোকাবেলা করা যেত? কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে?
আমরা যদি আমাদের পরিবারের দিকে তাকাই, পরিবারে কাদের কথা সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনি? পরিবারের যারা কনিষ্ঠ সদস্য বিশেষ করে শিশু-কিশোর তাদের কথা আমরা গুরুত্ব দিয়ে শুনি। তাহলে সরকার যেখানে দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষকে নিয়ে কাজ করে, সেখানে সরকারের অগ্রাধিকারে থাকা উচিত দেশের শিক্ষার্থীরা। যেকোনো অবস্থায় শিক্ষার্থীদের নমনীয়ভাবে মোকাবেলা করা দরকার। তাদের ভয় কিংবা হুমকি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আমার মনে হয়েছে, এ বিষয়ে সরকারের নীতিগত ভুল ছিল। প্রধানমন্ত্রী চীন থেকে দেশে ফিরে আসার পর যে সংবাদ সম্মেলন হয়েছে, সেখানে দুই-তিনজন সাংবাদিকের ‘প্রশ্ন’ নিয়ে বলতে চাই। কারণ এ কথাগুলো আলোচনায় থাকা উচিত। সম্ভবত দুই-একজন সাংবাদিকের বিশেষ কিছু প্রশ্নকে কেন্দ্র করে এ আন্দোলনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর যে উত্তর, সেই উত্তরগুলো একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সঠিক ছিল বলে মনে করি না। তিনি যদি সেভাবে শিক্ষার্থীদের স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে আশ্বস্ত করতেন, তাহলে হয়তো বিষয়টি এ রকম হতো না।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমরা পড়াচ্ছি। এমনকি গ্রামের স্কুল-কলেজেও পড়ানো হচ্ছে। সেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধা এবং এর বিপরীতে রাজাকার—তাদের যে বর্ণনা আমাদের শিক্ষার্থীরা জানে, সেই বিষয়েই যখন সরকারের পক্ষ থেকে ভুল বার্তা দেয়া হয়, সেটি খুব ক্ষতিকর হয়ে যায়। এখানে একটি বড় ভুল হয়ে গেছে।
কোটা সংস্কারের বিষয়টি যখন এসেছে তখন প্রধানমন্ত্রী বলতে পারতেন শিক্ষার্থীরা দাবি করছে, আমরা এটি গুরুত্ব দিয়ে দেখব। এ বিষয়ে একটি দ্রুত কমিশন করে দেব। তাছাড়া কোটা সংস্কারের আন্দোলন নতুন নয়। ২০১৮ সালেও এটি নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন শিক্ষক হিসেবে এ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দিয়েছি। কারণ শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের দাবি জানায়নি। ২০১৮ ও ২০২৪—দুবারই তারা কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়েছিল। শিক্ষক হিসেবে মনে করছি, কোটা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা পক্ষপাতমূলক। কিন্তু একটি দেশের নির্বাহী প্রধান কোনো পক্ষভুক্ত হয়ে কথা বলতে পারেন না। তাকে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে বলতে হবে। এছাড়া তিনি সবকিছুতে সরাসরি সম্পৃক্ত হবেন কেন? কারণ কাজ তো করবে সরকার। যেকোনো সংকটে একজন সরকারপ্রধানের এমনভাবে কথা বলা উচিত যে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ও প্রশাসনে যারা আছেন, তারা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবেন। সরকারের আচরণ যদি এমন হতো তাহলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ নাও হতে পারত। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের দূরদূর্শিতার অভাব লক্ষ করা গেছে।
এরপর সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী একটি ছাত্রসংগঠনকে এ আন্দোলন দমন করার জন্য অনেকটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেটাও এ সহিংসতার জন্য দায়ী। এরপর সহিংসতা ছড়িয়েছে। প্রথমে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে কী হয়েছে আমরা সবাই জানি। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে কী হয়েছে আমরা সবাই জানি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা দখল করে আছে। ১৬ জুলাই বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছে। অতঃপর আন্দোলনরত প্রায় দুই-তিনশ শিক্ষার্থী উপাচার্যের বাসভবনে গিয়ে উপাচার্যের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই নিরাপত্তা দিতে হয় ব্যর্থ হয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়ে প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন আছে। শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে উপাচার্যের বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছি। উপ-উপাচার্য ও প্রক্টরের সঙ্গেও অনেকবার কথা বলেছি। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়ে তাদের বারবার অনুরোধ করেছি। কোথায় যেন কিন্তু কিসের ঘাটতি ছিল। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা পায়নি। উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে বহিরাগতরা এসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। সেখানে উপাচার্য ও তার প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে এটিও একটি বড় কারণ। উপাচার্যের বাসভবনে আশ্রয় নেয়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ওইদিন রাতে বহিরাগতদের নজিরবিহীন হামলাকে শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখলে চলবে না। দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেশের সাধারণ মানুষের সন্তানেরা পড়ে। সুতরাং ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হলগুলো বন্ধ করে দিয়ে সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ বা অন্য কেউ নির্যাতন করবে, তখন সারা দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন হবে না, সেটা ভাববার কোনো কারণ নেই। এখানে সরকারের একটি বড় ভুল ছিল।
এত প্রাণহানি নিয়ে সরকারের কী ভূমিকা হওয়া দরকার ছিল?
এত বড় ঘটনা, এত সহিংসতা, এত প্রাণহানি সরকারের কোনো পর্যায়ের কেউ কি কোনো দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে? দায়িত্ব স্বীকার করতে হবে। অস্বীকার করার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সরকার পুরো আলোচনার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ করতে চেয়েছে যে অমুক দল, তমুক দল ঢুকেছে—তারা সহিংসতা করেছে। একেক সময় একেক কথা বলছে। সরকারের ব্যর্থতা কোথায়? সহিংসতা যেই করে থাকুক, যারাই করে থাকুক—সহিংসতা হয়েছে। সরকার সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা স্বীকার করতে হবে। আজ পর্যন্ত সরকারের কোনো পর্যায় থেকে দায়দায়িত্ব স্বীকার করা হয়নি। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা দায়ী তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সব দায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিলে চলবে না। এ দেশের জনগণ কখনো সেটি মানবে না। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় হামলা থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল দেশে এবং এত প্রাণহানি ঘটল। এর দায়িত্ব কি দায়িত্বশীল মন্ত্রীকে নিতে হবে না? প্রশাসনের কি দায় নেই এখানে? অন্য দেশে এমন ঘটনা ঘটলে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা পদত্যাগ করে বা তাদের অপসরণ করা হয়। আমাদের দেশে এমন কিছু ঘটল না। তাতেও অন্তত মানুষের ক্ষোভ কিছুটা হয়তো কমত। চলমান অবস্থা প্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তিদের পেশাদারির অভাবকেই ফুটিয়ে তুলছে। এখন পেশাদারত্ব ফিরিয়ে আনার কাজে মনোযোগী হতে হবে।
ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে এ আন্দোলন দমন করার চেষ্টা হয়েছল—এটা ছিল মারাত্মক ভুল। তার পরিণতি কী হয়েছে তা সবারই জানা। এরপর দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে। তখনো আন্দোলনকে সরকার সহনশীলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া সরকারপ্রধান যেদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন সেদিনও যদি তিনি বলতেন যে তোমরা ঘরে ফিরে যাও, আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। কিন্তু তিনি সেটাও করেননি। তার সেই বক্তব্যেও কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা কিছু পায়নি। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ কোথাও থেকে কিন্তু প্রশমিত করা হয়নি।
শিক্ষার্থীরা কি শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েই ক্ষুব্ধ?
কোটা আন্দোলন নিয়েই শুধু শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়েছে? তা তো নয়। আমরা যদি গত এক-দুই দশকের বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র দেখি এবং চাকরি ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে যা খুব ভয়াবহ—একদিকে বেকারত্ব, অন্যদিকে আমরা বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী কিংবা সৃজনশীল মানুষ তৈরি করছি না। দেশে কোনো পেশাজীবী মানুষের মর্যাদা নেই। মর্যাদা ও সুবিধা শুধু তাদের, যারা প্রশাসনে চাকরি করে। সুতরাং আমাদের শিক্ষার্থীরা ভীষণভাবে ভুল পথে পরিচালিত। তারা এখন ডাক্তার, বিজ্ঞানী কিংবা প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখে না। অনেক প্রকৌশলী কিংবা ডাক্তার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। অথচ চীন কিংবা জাপানের প্রকৌশলীরা দেশের পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেল করে দিচ্ছে। দেশের প্রকৌশলীরা বিসিএস গাইডের সেই তথ্য পড়ে বিসিএস দিচ্ছেন। কেন বুয়েট থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলী বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসনে যেতে চায়? একজন ডাক্তার হওয়ার পরও তিনি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পররাষ্ট্র কিংবা প্রশাসন ক্যাডারে যেতে চান। কারণ ডাক্তার হিসেবে তিনি তার মর্যাদা পান না। এ জায়গাগুলো চিহ্নিত করা জরুরি।
সব শিক্ষার্থীকে বিসিএসমুখী করা হয়েছে। এ আন্দোলনের কয়েক দিন আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্ন ফাঁসের যে ভয়াবহ তথ্য বেরিয়েছে সেটা নিয়ে সরকারের বক্তব্য কী? এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর শক্ত পদক্ষেপ দরকার ছিল। অথচ সরকারের কোনো পর্যায় থেকেই কেউ কোনো দায়িত্ব নেয়নি। আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের হতাশার জায়গাগুলো কোথায় তৈরি হচ্ছে সেগুলো বের করা দরকার। যে বিসিএস শিক্ষার্থীদের একমাত্র স্বপ্ন, সেখানে ৫৬ শতাংশ কোটা এবং বাকি পিএসসির দুর্নীতি। শিক্ষার্থীদের এ হতাশার জায়গাটি শনাক্ত করেছে সরকার? করেনি। শনাক্ত না করে বা সমস্যার সমাধান করতে না চাওয়া হয়, তাহলে সমস্যা থেকে যাবে। কত বড় বড় দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচারের খবর বেরিয়েছে—তারা সরকারি দল বা প্রশাসনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। এসব বিষয়ে সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছে? এসব বিষয়ও আন্দোলনে রসদ জুগিয়েছে।
দমন-পীড়নের মাধ্যমে ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?
সমস্যার সমধান না করে যদি দমন-নিপীড়নের পথ বেছে নেয়া হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বা ক্ষোভ প্রশমন করা যাবে না। এ বিষয়গুলো আন্দোলনকে বেগবান করেছে। সেই আন্দোলনে যখন হামলা এসেছে তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা কী করেছে সবাই অবগত। আমি মনে করি, এখানে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে।
বর্তমানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শিক্ষকরাও যুক্ত হচ্ছেন। এর কারণ কী?
আপিল বিভাগের রায়ের পর কোটার বিষয়টিতে ফয়সালা হয়। এ-সংক্রান্ত গ্যাজেট প্রকাশ করার সময় সরকারের দুজন মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কোনো শিক্ষার্থীকে প্রশাসনিক বা একাডেমিক কোনো হয়রানি করা হবে না। একজন শিক্ষক হিসেবেও আমি আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কী দেখলাম?
দক্ষ মানবসম্পদ গঠন করতে পারছি না কেন?
দেশে কর্মসংস্থানের সমস্যা আছে। সরকার সেই বিষয়টি কতটুকু কমিয়ে আনতে পেরেছে, সেটি দেখার বিষয়। একটি জনবহুল দেশে আমরা চাইলেই রাতারাতি এ সমস্যার সমাধান করতে পারব না। কর্মসংস্থানের কিছু সংকট থাকবেই। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে বাস্তবতার নিরিখে সরকার কীভাবে কতটা দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা করছে। দেশে কি দক্ষ জনশক্তি রফতানি করার মতো সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে? যারা বিদেশ যেতে চায় তারা কীভাবে ও কতভাবে প্রতারিত হয়? সরকার কি মালয়েশিয়ায় শেষ পর্যন্ত লোক পাঠাতে পেরেছে? পারেনি। এ মুহূর্তে আমরা মানবসম্পদে সমৃদ্ধ। কিন্তু এ সম্পদ ব্যবহার করার মতো পরিকল্পনা কি আছে? অথচ জনমিতি লভ্যাংশের সুযোগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ জনমিতি লভ্যাংশের সুবিধা কীভাবে নিয়েছে বা সুফল ভোগ করছে, সেগুলো নিয়ে আমরা কোনো গবেষণা করেছি? করিনি। গ্রাম পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিল থেকে এত বেশি রাজনীতিমুখী করা হয়েছে, এখন তাদের স্বপ্নই হচ্ছে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। এখন তারা পড়াশোনার চেয়ে দলীয় কর্মকাণ্ডকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এখানেও তারা ভুল পথে পরিচালিত। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে দক্ষ মানবসম্পদ যেমন সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, তেমনি দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎও আশা করা যায় না।
ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে অন্যরাও যুক্ত হয়েছে, কেন?
এ আন্দোলন কি এখন ছাত্রদের আন্দোলন আছে? এটি এখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়ে গেছে। আন্দোলনে অংশ নেয়া অনেকেই আছেন, যারা ছাত্র নন। ঢাকা শহরের আন্দোলনের হটস্পটগুলোয় হতদরিদ্ররা রয়েছে। একেবারে দরিদ্র ও শিশু-কিশোররা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। কেন? এ প্রশ্নগুলো তোলা দরকার। দেশের উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু দুর্নীতি কি বন্ধ করা গেছে? যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়নের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে দেশের মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হয়েছে, সেগুলো অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হয়েছে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও প্রকৃত উন্নয়ন হয়নি। কারণ উন্নয়নের জন্য প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমবণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। যে বিষয়ে সরকার কখনই মনোযোগী হয়নি। বাজারের ওপর সরকারের কি কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে? নেই। এ দেশের সাধারণ মানুষ কীভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে আছে? সরকারকে মেগা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে না। এ জায়গাগুলোয় আলোকপাত করা দরকার। মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ন্যূনতম সম্পর্ক থাকা দরকার। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকার উদাসীন। ফলে এই মানুষদের মাঝে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আছে। যার বহিঃপ্রকাশ এ আন্দোলনে ঘটে থাকতে পারে।
আন্দোলনে সারা দেশে শিশু-কিশোরসহ দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত ও বিচার হতে হবে। এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার নিয়ে কোনো রাজনীতি হবে না সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এটি কীভাবে করা হবে তা সরকারের দায়িত্ব। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে বা যারা জড়িত থাকুক না কেন তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সরকার চাইলে পারবে। এটি সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে এখনো পর্যন্ত সরকারের সদিচ্ছা দৃশ্যমান হয়নি। একটা স্বাধীন কমিশন গঠন হতে পারে। তার আগে জনগণের মনে আস্থা ফেরাতে হবে।
গণগ্রেফতার ও হয়রানির বিষয়ে আপনার মতামত কী?
একটি স্বাধীন দেশে এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণগ্রেফতার চলতে পারে না।
আপনারা দেখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে কোনো কারণ ছাড়াই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরো ছয়জনকে নেয়া হয়েছে। আর সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তারা কি সত্যি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কিনা তা তো পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারছেন না। এ সময় তো দুষ্কৃতকারীরাও এসে বলতে পারে যে সে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। ফলে যে ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা এখনই বন্ধ করতে হবে। সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করা হয়েছে—জড়িতদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় খুঁজে বের করুন। এ দেশের মানুষ সেটা চাইবে। যারা অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করেছে এ দেশের মানুষ তাদের বিচার চাইবে না, তা হতে পারে না। কিন্তু তা না করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। এ মুহূর্তে কী করা উচিত? সরকারের প্রথম পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অচলাবস্থা চলছে, যা আমাদের জন্য খুব উদ্বেগজনক। শিক্ষার প্রতিটি স্তরে এক ধরনের অস্থিরতা ও অচলাবস্থা বিরাজ করছে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ের কারিকুলাম নিয়ে কী করা হচ্ছে! নতুন কারিকুলামে আমি একটি বইয়ের রিভিউ কাজে জড়িত ছিলাম। সেখানে ভয়াবহ অবস্থা। তা নিয়ে এখন কথা বলছি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকরা একটা আন্দোলন করছেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরাসরি ডেকে নিয়ে কথা বলতে পারতেন। তা তিনি করেননি। শিক্ষকরা যে আন্দোলন করছেন সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং পুরো শিক্ষক সমাজকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। এরপর কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশকিছু দিন ধরে বন্ধ আছে। ভাবতে পারছেন? এটা যে কত বড় ক্ষতি! জনগণ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে এনে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে হবে। আমি আবারো বলছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখে দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আলাপ-আলোচনার দ্বার খুলে দিতে হবে। আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।