ঋণমান যেকোনো দেশের আর্থিক সক্ষমতার চিত্র তুলে ধরে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী ঋণমান যাচাইকারী একাধিক শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের সভরেন ক্রেডিট রেটিং (সার্বভৌম ঋণমান) অবনমন করেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষায় এতদিন দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং ছিল ‘বিবি মাইনাস’। এ ঋণমান কমিয়ে বর্তমানে ‘বি প্লাস’ করা হয়েছে। যদিও স্বল্প মেয়াদে ঋণমান অপরিবর্তিত রাখার পাশাপাশি আউটলুক ‘স্থিতিশীল’ রেখেছে সংস্থাটি।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে ঋণমান সূচকে ভালো অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এদিকে দেশের রিজার্ভ পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। বিদেশী বিনিয়োগে স্থবিরতা দৃশ্যমান। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যেও মন্দা চলছে। উপরন্তু এসঅ্যান্ডপি দেশের বহিঃস্থ চাপ মোকাবেলায় তারল্য সক্ষমতা কম এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও এতে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি, ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউ জারির প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার কথাও উল্লেখ করে দেশের ঋণমান কমিয়েছে। খুব সহজেই অনুমেয়, ঋণমান অবনমনের ফলে প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
এর আগে চলতি বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ধারণকারী সংস্থা ফিচ রেটিংসের মূল্যায়নে বাংলাদেশের ঋণমানে এক ধাপ অবনমন হয়েছে; বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) ‘বিবি মাইনাস’ থেকে ‘বি প্লাস’-এ অবনমন করা হয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কিত পূর্বাভাস স্থিতিশীল রেখেছে ফিচ রেটিংস। বিদেশী ঋণ ও তারল্য পরিস্থিতি প্রতিকূলে গেলে ঋণমান কমানো হবে বলে আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক করে দেয় ফিচ রেটিংস।
তবে আন্তর্জাতিক ঋণমান প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবার আগে বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করেছিল মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিস। ২০২৩ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ অবনমন করা হয়। বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উঁচুমাত্রার দুর্বলতা, তারল্যের ঝুঁকিসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়েছিল। তবে বাংলাদেশের জন্য মুডি’স তাদের পূর্বাভাস স্থিতিশীল রাখে। যদিও স্বল্পমেয়াদি ইস্যুয়ার রেটিংয়ের ক্ষেত্রে ‘নট প্রাইম’ বা শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন নয়, এমন মান অব্যাহত রাখার কথাও জানায় তারা।
দেশে চলমান আন্দোলনে কয়েক দিন ধরে ইন্টারনেট সংযোগ ও পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ থাকায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বণিজ্যসহ প্রায় সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এসঅ্যান্ডপির ঋণমান অবনমন পুরো দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, রেটিং ক্রমাগত অবনমন ঘটতে থাকলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করতে আকৃষ্ট হবেন না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তাছাড়া দেশে যে হারে রিজার্ভের ক্ষয় হচ্ছে, তা সহজে থামানো যাবে না। এদিকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় প্রবাসীদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যা থেকে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসার। এমন পরিস্থিতিতে ঋণমানের উন্নতি ঘটানো অতীব জরুরি। নয়তো সার্বিক পরিস্থিতি আরো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
দেশের চলমান সংকটের জন্য মূলত অভ্যন্তরীণ নানা সংকট দায়ী। অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন পরিকল্পনা, আর্থিক অব্যবস্থাপনা, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাব, কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা, অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজার—এ সবকিছু আমাদের অর্থনীতির ভিত্তিকে ভঙ্গুর করে ফেলেছে। বর্তমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেপথ্যেও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা অনেকাংশে দায়ী। কর্মসংস্থানের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজের সুযোগের অভাব, শিক্ষিত বেকার তরুণদের হতাশার প্রেক্ষাপটে এ আন্দোলনের শুরু। পরবর্তী সময়ে তা যে কারণেই সহিংস রূপ পরিগ্রহ করুক না কেন, এ কথা অস্বীকার অবকাশ নেই। দীর্ঘদিন থেকে বিদ্যমান সংকটগুলো ও চলমান পরিস্থিতির সম্মিলিত ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ।
সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে অনেকগুলো নীতিপদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্য উল্লেখযোগ্য মুদ্রা সংকোচন নীতি, ক্রলিং পেগ, বাজারভিত্তিক সুদহার ইত্যাদি। এসবের ফলে আর্থিক চাপ কিছুটা প্রশমন করা গেলেও এর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ সংকট বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ এ খাতে ক্রমশ ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে। একদিকে বেসরকারি খাত ঋণবঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের ওপর ঋণের সুদের বোঝা বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে শিল্প উৎপাদন ব্যয়ে। এর মধ্যে ঋণ মান অবনমনে উৎপাদন ব্যয় আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী তিন রেটিং প্রতিষ্ঠান হলো এসঅ্যান্ডপি, মুডি’স ও ফিচ রেটিং। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ তিন ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান একত্রে ‘বিগ থ্রি’ হিসেবে পরিচিত। এ তিন প্রতিষ্ঠানের ঋণমানের অবনমন ঘটানোর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর। বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে দেশের ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ফি গোনার পাশাপাশি আরো কঠিন শর্তের মুখে পড়তে হচ্ছে। বিশ্বের সুপরিচিত বৃহৎ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশী ব্যাংকের জন্য নিজেদের ক্রেডিট লাইন বা ঋণসীমা কমিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে বেড়েছে উৎপাদন ব্যয় ও বাড়তি দামের চাপ।
বাংলাদেশের উচিত জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার পথে হাঁটা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া। কারণ মোটাদাগে এগুলো সম্মিলিতভাবে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা ডেকে এনেছে। উদাহরণস্বরূপ শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়। এসঅ্যান্ডপির পূর্বাভাস ও রেটিংয়ের অবনমন দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের অস্থিতিশীলতা, বিশৃঙ্খলা ও ভঙ্গুরতাকেই নির্দেশ করছে। বিনিয়োগ স্থবিরতা, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে মন্দা এবং এর সরকারি পরিসংখ্যানেও বিভ্রাট, দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ও শীর্ষস্থানীয় আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি আজ এ পর্যায়ে এসেছে। বেড়েছে আয়বৈষম্য। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে শোচনীয় জীবন যাপন করছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।
দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থনৈতিক সক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা সহজ হবে না। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা নিশ্চিত করতে সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রয়োজন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি দৃশ্যমান করতে হবে।
ঋণমান অবনমন একটি বড় সতর্কবার্তা। এসঅ্যান্ডপি তাদের ঋণমান কমানোর বিজ্ঞপ্তিতে যেসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছে সেসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। ঋণমানের উন্নতি ছাড়া অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।