বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের মূল খাতগুলো হলো রফতানিযোগ্য
তৈরি পোশাক শিল্প এবং রেমিট্যান্স। তৈরি পোশাক শিল্পের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান গত
এক যুগে নিম্নগামী হয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার
রিজার্ভও কমতে কমতে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির এ বিপর্যয়কর
অবস্থায় একমাত্র লাইফলাইন হিসেবে রেমিট্যান্স ছিল শেষ ভরসা। কিন্তু সাম্প্রতিক
সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহের হার কল্পনাতীতভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশের অস্থিতিশীল
রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারি
দমন-পীড়ন, রাষ্ট্রীয় মদদে শিক্ষার্থী-জনতার ওপর
মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং বিক্ষোভ দমনের নামে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বিভিন্ন বাহিনীর হাতে নিজ দেশের নাগরিকদের জীবনহানির প্রতিবাদে দেশ ও দেশের বাইরে
থাকা বাংলাদেশী নাগরিকরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং প্রবাসে থাকা প্রায় দেড় কোটি
বাংলাদেশীর একটি বড় অংশ গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রায়
ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। গত সপ্তাহের ছয়দিনে বাংলাদেশে মোট যে পরিমাণ রেমিট্যান্স
এসেছে তা স্বাভাবিক সময়ে একদিনে আহরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণের চেয়েও কম।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে
বিশ্বব্যাংক, এডিবি,
আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশীয় গবেষণা
প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস, সিপিডি কিংবা সানেম সরকারকে বহুবার
সতর্ক করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সরকার সেই
সতর্কতাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেনি। বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান
আর্থিক তথ্য প্রকাশ সীমিত করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ
ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির ঘটনা আমরা দেখেছি। একপর্যায়ে
বাংলাদেশ ব্যাংক সাপ্তাহিকভাবে তথ্য প্রকাশ করার ঐতিহ্য থেকে সরে এসে মাসিক
ভিত্তিতে অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ
সিদ্ধান্ত ইংগিত দেয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান চিত্রের চেয়ে বাস্তবিক অবস্থা
আশঙ্কাজনক।
গত বছর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে নানা শর্তের
বেড়াজালে দুটি শ্রেণীতে ৪২ মাসের একটি ঋণ প্রোগ্রামের অধীনে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন
ডলারের একটি ঋণ লাভ করে। বাংলাদেশ সরকার আশা করেছিল যে, এ ঋণের মাধ্যমে দেশের সামষ্টিক
অর্থনীতিতে একটি ভারসাম্য অবস্থা আনতে সক্ষম হবে। কিন্তু আইএমএফের তৃতীয় কিস্তির
লোন বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করলেও সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার যে
প্রক্ষেপণ সরকার করেছিল তা সাফল্যের মুখ দেখেনি। গত মে মাসে আন্তর্জাতিক ঋণমান
যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডি’স বাংলাদেশের রিজার্ভ সাময়িকভাবে কয়েক মাসের জন্য
স্থিতিশীল থাকবে বলে পর্যালোচনা-নির্ভর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তা বাস্তবে
সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি। বাংলাদেশে ফরেন রিজার্ভ সংকটের কারণে রফতানিমুখী শিল্পের
কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়া, বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতীতের
ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রক্ষণশীল মুদ্রানীতির কারণে
তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উৎপাদন সক্ষমতা গত ছয় মাসে উল্লেখযোগ্য
পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এক ধরনের দারিদ্র্যের
দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতার পর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ বর্তমান সময়ের মতো তীব্র বৈদেশিক ঋণের
ফাঁদে আগে কখনো পড়েনি। ভারত-সিঙ্গাপুর-যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান
থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি),
বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন আমদানি ব্যয়ের মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
অবস্থা এতটাই শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের
মাধ্যমে ওইসব দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে ঋণ পরিশোধের
বার্তা পাঠাতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির দুরবস্থার পাশাপাশি চরম রাজনৈতিক
সংকট, শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকারের অক্ষমতা,
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সাম্প্রতিক ইন্টারনেট শাটডাউন
বিদেশী ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা ও
গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে আসন্ন মাসগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন
মাত্রার মন্দার সূচনা হওয়া সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উৎপাদনশীল খাতগুলোর এ দুরবস্থার সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে
রক্ষা করতে পারত প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কিন্তু কোটা সংস্কার
আন্দোলনকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা এবং সেই অনুযায়ী সরকারি নীতিমালা প্রণয়নের
গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ার ফলে শেখ হাসিনার সরকার জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহের
শুরুতে ক্রমান্বয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে সরকারের আচরণ দেশের
ছাত্রসমাজের সঙ্গে বৈষম্যমূলক হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে সরকারের দায়িত্বশীল মহলের
নির্দেশে নাগরিকের ওপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনী নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞ
পরিচালনা করার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের একটি অংশ রাষ্ট্রীয়
বৈধ মাধ্যম বা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে
গত দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহ কল্পনাতীতভাবে হ্রাস পেয়েছে। নিশ্চিতভাবেই
সরকার ও অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের অর্থনীতির এ মন্দার সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ
হ্রাস পাওয়ার প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছে এবং সরকারিভাবে বিদেশে বসবাসকারী নাগরিকদের
রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করতে করজোড়ে আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু নাগরিকের সঙ্গে
বর্তমান আওয়ামী লীগ বৈষম্যমূলক আচরণ,
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, বাংলাদেশের
মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা, অবিশ্বাস্য রকম দুর্নীতির প্রসার,
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী
কর্তৃক নিপীড়ন, মিথ্যা মামলা দিয়ে জনভোগান্তি ইত্যাদি সমগ্র
বাংলাদেশকে উত্তপ্ত করে রেখেছে। এ অবস্থায় সরকারের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনের অন্যতম
পন্থা হিসেবে প্রবাসী শ্রমিকদের একটি অংশ রেমিট্যান্স না পাঠানোর যে দৃঢ় সংকল্প
গ্রহণ করেছে তা থেকে সহসা প্রবাসীদের সরে আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। পাশাপাশি
মাত্র দুই সপ্তাহের রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে যে
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়েছে তা রেমিট্যান্স প্রবাহ সাময়িকভাবে স্থগিত
করার পালে আরো হাওয়া লাগাচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার শান্ত মস্তিষ্কে ও
বিবেচনাপ্রসূতভাবে কোনো নীতি প্রণয়ন এবং নাগরিকের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা
করলে তা বরং ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনত, কিন্তু সরকারের আচরণ
নাগরিকের প্রতি চরমভাবাপন্ন ও বিমাতাসুলভ হওয়ায় সে সম্ভাবনা ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে।
সার্বিক বিবেচনায় রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাস্তবিক নয়। বলা যায়,
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হওয়ার দিকেই এগোচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনে রাষ্ট্রীয় সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক
ব্যর্থতা এবং আর্থিক ঋণ লাভের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তা পূরণ হয়নি। ফলে সরকারের
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বিকল্প প্রচেষ্টাও সাফল্যের মুখ দেখেনি।
সরকারের আকাঙ্ক্ষিত ৫ বিলিয়ন ডলার সমমানের চীনা ঋণের বিপরীতে মিলেছে মাত্র ১ বিলিয়ন
ইউয়ান। এ অবস্থায় রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস কার্যত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
মূল্যস্ফীতির ঘোড়াও দীর্ঘদিন ধরে লাগাম ছাড়া। ফলে বাজারে স্বস্তি নেই।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস
তুলেছে। এ সময় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না এসে যদি বিকল্প ব্যবস্থা বা
হুন্ডির মাধ্যমে আসতে শুরু করে তাহলে মূল্যস্ফীতি আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে আগামী কয়েক
সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে আশার আলো দেখার মতো
উপাদান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
সরকারি নির্দেশে নয়দিন স্থায়ী ইন্টারনেট শাটডাউনের ফলে বাংলাদেশের কয়েক লাখ
ফ্রিল্যান্সার তাদের ক্লায়েন্ট হারিয়েছেন। এ সময়ে কেবল ফ্রিল্যান্সারদের কাজের
অর্ডার বন্ধ হওয়া বা কাজ করতে না পারার কারণে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি
টাকা। একই অবস্থা হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রেও। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ বার বার
এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে ব্রিফ করে তাদের ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরেছে।
উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি,
নিরাপত্তাহীনতা, সরকারের মাঝে অস্থিতিশীলতা,
কাঁচামাল আমদানির জন্য লেটার অব ক্রেডিট (এলওসি) খুলতে না পারা,
ডাবল ডিজিটের মুদ্রাস্ফীতি মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন
স্মরণকালের সবচেয়ে সংকটজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে এ সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক
হারে কমে যাওয়া নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। এ
অবস্থায় সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করে যদি রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক করতে
সক্ষম হয় তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে
কৌশলগতভাবে একটার পর একটা ভুল করতে থাকা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে বার বার অদক্ষতা
ও ব্যর্থতার প্রমাণ দেয়ার পর সহসাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের
সম্ভাবনা অতীব ক্ষীণ। আগামী কয়েক সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
সময়। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্যের সঙ্গে আগামী কয়েক সপ্তাহ পার করতে না পারলে সরকার ও
নাগরিক উভয়ের জন্যই অত্যন্ত বিপদসংকুল সময় অপেক্ষা করছে।
কায়সুল খান: গবেষক, নোভা ইউনিভার্সিটি অব লিসবন, পর্তুগাল