বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস

ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে উঠছে

জনমিতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন মানব বা মনুষ্যসত্তা বলতে মানব জনসংখ্যাকে বোঝানো হয়ে থাকে। জনসংখ্যা একটি সক্রিয় ও যেকোনো অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একই সঙ্গে জনসম্পদ ও কর্মদক্ষতার উৎস হলো জনসংখ্যা। একটি দেশ পর্যাপ্ত কার্মিক জনশক্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন,

জনমিতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন মানব বা মনুষ্যসত্তা বলতে মানব জনসংখ্যাকে বোঝানো হয়ে থাকে। জনসংখ্যা একটি সক্রিয় ও যেকোনো অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একই সঙ্গে জনসম্পদ ও কর্মদক্ষতার উৎস হলো জনসংখ্যা। একটি দেশ পর্যাপ্ত কার্মিক জনশক্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, নিজস্ব সম্পদ ও জ্ঞান ব্যবহার করে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসম্পদ উভয়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনৈতিক গতি ত্বরান্বিত হয়। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যাকে যেকোনো উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। যদিও  ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।

ধারণা করা হয়, ৭০ হাজার বছর আগে যখন সর্বশেষ বরফ যুগ শুরু হয় তখন বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ হাজার। ১৮০৪ সালে বিশ্বে জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১০০ কোটি এবং ১২৩ বছর পর ১৯২৭ সালে জনসংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ২০০ কোটিতে পৌঁছে। ১৯৬১ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০ কোটি। জাতিসংঘ প্রদত্ত হিসাবে, ৩১ অক্টোবর ২০১১ সালে প্রতীকী দিনে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৭০০ কোটিতে। ১৮০০ সালের পর গত দুই শতকে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বেড়েছে সাত গুণ। বিশ্ব জনসংখ্যা ৫০০ কোটি থেকে ৭০০ কোটি হতে সময় লেগেছে ১২ বছর এবং ৭০০ কোটি থেকে ৮০০ কোটিতে উপনীত হতে সময় লেগেছে ১১ বছর। ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্বের জনসংখ্যা প্রথমবারের মতো ৫০০ কোটিতে উপনীত হয়। এ বিশালসংখ্যক জনসংখ্যার বিষয়ে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের তৎকালীন গভর্নিং কাউন্সিল জনসংখ্যাবিষয়ক ধারণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪৫/২১৬ নং প্রস্তাব পাশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর থেকেই পরিবেশ ও উন্নয়নের সঙ্গে জনসংখ্যার সম্পর্ক বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী একযোগে (১১ জুলাই) বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। পৃথিবীব্যাপী জনসংখ্যা কোনো অঞ্চলের জন্য সম্পদ আবার কোনো অঞ্চলের জন্য সমস্যা বা বোঝা। তবে বিজ্ঞানের অগ্রগতি, প্রযুক্তি ও উন্নত শিক্ষার মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। জনসংখ্যাবিষয়ক সমস্যা সমাধান, সবার সচেতনতা বৃদ্ধি ও গুরুত্ব অনুধাবনে সচেষ্ট করাই জনসংখ্যা দিবসের মূল লক্ষ্য। দিবসটি বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মহিলার পরিবার পরিকল্পনা প্রয়োজন। এর মধ্যে ২৭০ মিলিয়নের জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) তাদের সহায়তার জন্য কাজ করে। যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং জন্ম পরিকল্পনা নীতি প্রণয়নে সাহায্য করে। এছাড়া লিঙ্গবৈষম্য, দারিদ্র্য হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্য, মানব পাচার ও মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা এবং কীভাবে সেগুলো সমাধান করতে হয় তার ওপর আলোকপাত করা হয় জনসংখ্যা দিবসে। বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও তাদের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে ভরাট হচ্ছে কৃষিজমি, ব্যাপক হারে বন উজাড়, জলাশয় ভরাট হচ্ছে, দ্রুত হারে পরিবর্তন হচ্ছে ভূমি ব্যবহার। যার ফলে সমগ্র বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ধরনের প্রভাব লক্ষণীয়। অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে বেড়ে চলেছে দুর্যোগ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ ও তাপপ্রবাহ, অগ্নিকাণ্ড। যে কারণে সামগ্রিক উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বেড়ে চলেছে অবৈধ অভিবাসী, উদ্বাস্তু আর দেশান্তরী হওয়ার হার এবং অনেক জায়গায় এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়।

১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়, সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দেশের মানুষের এসব অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে আসছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম যে পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-৭৮) পরিকল্পনা করা হয়, সেখানে দেশের জনসংখ্যাকে এক নম্বর জাতীয় সমস্যা বলে চিহ্নত করা হয়। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটিতে সীমাবদ্ধ রাখতে গুরুত্ব দেয়া হয়। সে প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম জনসংখ্যা নীতির একটি রূপরেখা প্রণীত হয়। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে একটি জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয়। ওই জনসংখ্যা নীতির রূপরেখায় মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পরিবারের কল্যাণ ও উন্নত জীবন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনাকে অত্যাবশ্যক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি ২০০৪-এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নিট প্রজনন হার ১ (এক) অর্জন করা, যাতে ২০৬০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছে। কিন্তু ২০১০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নিট প্রজনন হার ১ (এক) অর্জন করা সম্ভব হয়নি বিধায় বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি ২০১২ প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে এটি আরো যুগোপযোগী করে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মৃত্যুহার কমানো এবং জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়।

জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম এবং আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে ৯০তম। ১৯৭৪ সালে দেশের প্রথম আদমশুমারিতে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭১ জন এবং পরবর্তী শুমারিতে (১৯৮১) জনসংখ্যা হয় ৮ কোটি ৭১ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৫। ১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হয় ১০ কোটি ৬৩ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২ এবং ২০০১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১২ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৩ জনে। ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭ জন এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা (২০২২) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১১১৯ জন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে নগরে বসবাস করা মানুষের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যার ৫ কোটি ৩৯ লাখ (প্রায় ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ) মানুষ নগরে বাস করে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ নগরে বাস করত। ধারণা করা হয়, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ নগরে বাস করবে। কিন্তু এ বিশালসংখ্যক জনসংখ্যার চাপ নিতে আমাদের প্রধান নগরগুলো প্রস্তুত নয় বলে নগরায়ণের সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়ছে রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউএনএফপির তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকা এবং দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ বসবাস করে এ শহরে। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালে ঢাকা হবে বিশ্বের তৃতীয় জনবহুল শহর এবং এ সময় ঢাকার জনসংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। জাতিসংঘের Economic and social Affairs এর Population Division কর্তৃক প্রকাশিত World Urbanization Prospects-2019 এর হিসাবে সমগ্র পৃথিবীতে ৫৫ ভাগ (৪ দশমিক ২ বিলিয়ন) মানুষ শহরে বসবাস করে। নগর বা শহরের জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের প্রথম দশটি শহরের মধ্যে ঢাকা শহরের অবস্থান নবম। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে যদি শহরের জনসংখ্যা বাড়তে থাকে ২০৩০ সালে জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের দিল্লি হবে বিশ্বের বৃহত্তম শহর এবং বাংলাদেশের ঢাকা হবে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শহর (জনসংখ্যা হবে ২ কোটি ৮ লাখ)। জনঘনত্ব, দূষণ, অব্যবস্থাপনাসহ নানাবিধ কারণে দিন দিন অবাসযোগ্য হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকা। সম্প্রতি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স (ইআইইউ) কর্তৃক প্রকাশিত দ্য গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৪ অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭৩টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৬৮তম এবং ২০২৩ সালে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৬৬তম। বিশ্বের শহরগুলোর বাসযোগ্যতা নির্ধারণে যে আন্তর্জাতিক প্যারামিটারগুলো দেখা হয় তা হলো স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনপরিসর, সাংস্কৃতিক বিকাশ ইত্যাদি। 

সামগ্রিকভাবে বাসযোগ্য নগরজীবনের জন্য এখন থেকেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যানবাহন, সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন, গণপরিবহন ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি নগর পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত জরুরি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব যাতে নগর পরিবেশের ওপর না পড়ে সেজন্য পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার, পুকুর-জলাশয় সংরক্ষণ এবং নগরায়ণ নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য টেকসই জীবন ব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন—যুগোপযোগী ও মানসম্পন্ন শিক্ষা, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, দারিদ্র্য হ্রাস করে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী গড়তে যথাযথ পরিকল্পনা, দুর্যোগ মোকাবেলায় উন্নত প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি, সকল প্রকার দূষণ রোধ এবং মোট জনসংখ্যা ও বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়ন পরিকল্পনা।   

ড. মো. ইকবাল সরোয়ার:  অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও