এ অঞ্চলের মানুষের ভাবনাকে জানার প্রয়াস থেকেই ‘মনন খনন’

ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ের কামরুল হাসান প্রদর্শনশালায় শুক্রবার শুরু হয়েছে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের ‘মনন খনন’ শীর্ষক দৃশ্যশিল্প প্রদর্শনী।

ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ের কামরুল হাসান প্রদর্শনশালায় শুক্রবার শুরু হয়েছে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানেরমনন খনন শীর্ষক দৃশ্যশিল্প প্রদর্শনী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক আবুল মনসুর। বেঙ্গল আর্টস প্রোগ্রাম নিবেদিত স্থাপনাধর্মী প্রদর্শনীতে দেশজ অস্তিত্বের খোঁজে নতুন দৃষ্টি গভীর অন্বেষায় আলোকপাত করা হয়েছে। প্রদর্শনী চলবে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রদর্শনী শিল্পচর্চার নানা দিক নিয়ে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারিহা আজমিন

আপনার শিল্পচর্চার শুরুটা জানতে চাই।

আমার শুরুটা খুব ড্র্যামাটিক ছিল না। একটা পরিবারে আমি বেড়ে উঠেছি। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ছিল। পড়াশোনার বইপত্র, লাইব্রেরি সবকিছুই ছিল। নানা ধরনের কালচারাল কার্যক্রমও ছিল ভাই-বোনদের ভেতরে। সেখানে আবিষ্কার করলাম ছোটবেলা থেকে আমার ছবি আঁকার ন্যাক আছে এবং আমি ওদের সবার তুলনায় একটু ভালো ড্রয়িং করতে পারি। আর পত্রপত্রিকা যেহেতু পড়তাম সেখানে বিভিন্ন ইলাস্ট্রেশন দেখা এবং বিখ্যাত আর্টিস্টদের লেখা, ছবি যখন ছাপা হতো সেগুলো দেখা, একটু খোঁজ রাখা, এগুলো করেছি। ম্যাট্রিক পাসের পর পরিবারের কোনো বাধা না থাকায় আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিই এবং পাস করে যাই। তবে বলতে হবে, একজন শিল্পীর সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন এবং শিল্প সম্পর্কে কোনো ব্যাপক ধারণা আমার ছিল না। তবে এক ধরনের রোম্যান্টিক একটা আইডিয়া ছিল। কিন্তু চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর নিজস্ব পড়াশোনা এবং যে বন্ধু-বান্ধব আমি পেলাম, সিনিয়র পেলাম তাদের সাহচর্যে ধীরে ধীরে আমি মনে হয় শিল্পে একধরনের রস পেয়ে গেলাম। সেখান থেকেই লাইব্রেরিতে প্রচুর সময় কাটে, সবকিছু নিয়ে জানাশোনা শুরু হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের কাজকর্ম দেখা শুরু করি। এভাবে মনে হয় আমার মধ্যে একধরনের নেশা তৈরি হয় ভালোলাগা জানার।

চারুকলার বাইরেরও অনেক বন্ধু ছিল যারা আমাকে আর্ট কালচারের ওপর একধরনের অ্যাক্টিভিজম তৈরি হয়। সেই সঙ্গে চারুকলার আমার যে বন্ধুরা ছিল, যারা সবাই এখন খুব খ্যাতমান আর্টিস্ট। শিশির ভট্টাচার্য, দিলারা বেগম জলি, ঢালী আল মামুন, আমরা সবাই একই ব্যাচ। তাদের সাহচর্যে নিজেদের আলাপ-আলোচনার মধ্যেই আসলে কাজের উৎসাহ জাগে।

বর্তমানে আপনার একটি একক প্রদর্শনী চলছে ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে মনন খনন নামে। প্রদর্শনীটি সম্পর্কে জানতে চাই।

একটা নিয়মিত প্রদর্শনীর জায়গা হিসেবে বেঙ্গল শিল্পালয়ের নির্দিষ্ট একটি পরিচিতি আছে। আর্টিস্টরা সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করেন। সেই হিসেবে অনেক দর্শকও আসে। বেঙ্গলে অন্যান্য কারণেও দর্শক যায়। তবে প্রদর্শনী থাকলে দেখা যায় প্রদর্শনী দেখতেও দর্শক আসে। এবারের আয়োজনটিও সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে ভালো চলছে। যেহেতু জুলাই কেবল শুরু হয়েছে, সে হিসেবে ভালো যাচ্ছে।

এবারের প্রদর্শনীর যে নাম মনন খনন তা নিয়ে যদি বলি, একটি ভাবনা থেকে শুরু করেছিলাম এটি আমি। আমাদের অঞ্চলের মানুষ বা আমরা আমাদের আবেগ বা অনুভূতি, আমাদের প্রকাশ ভঙ্গি, আমাদের কল্পনা, আমাদের চিন্তাশক্তির একটা বিশেষত্ব আছে। কিন্তু এটি কেন! তার অর্থটি হচ্ছে মনন হলো মন যে জিনিসগুলো নিয়ে ভাবে। যে জিনিসগুলো ধারণ করে তা মনন চিন্তা থেকে আসে। ভাবনাগুলো থাকে মনের মধ্যে। এটিকে আমি একটু খোঁজার চেষ্টা করেছি। অনেকটা আর্কিওলজির  মতো। এটা করতে গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের একটি দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সময় আছে, যা নিয়ে প্রচুর আলোচনা আছে। উপনিবেশের কারণে আমাদের চিন্তাভাবনা, অভ্যাস বিভিন্ন কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কখনো সেটা মনের অজান্তেই, কখনো নিয়ন্ত্রিতভাবে। জিনিসগুলো নিয়ে সমাজে শিল্প-সাহিত্যে ব্যাপক আলোচনা আছে। আমি ঠিক তার আগের অবস্থানটি জানার চেষ্টা করেছি। অনেকটা আর্টিস্টিক একটি প্রক্রিয়ায়। তবে আমি যেহেতু আর্কিওলজিস্ট নই, অ্যানথ্রোপলজিস্ট নই, আমি একজন ঐতিহাসিকও নই, আমি একজন আর্টিস্ট। তাই আমার জায়গা থেকে আমি একটু জানতে চেষ্টা করেছি আমাদের অঞ্চলের মানুষ কেন এভাবে চিন্তা করে। আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো কেন এমন। রিসার্চের মধ্য দিয়ে একটা জিনিস দেখতে পেয়েছি, মানুষ যে অঞ্চলে থাকে, তার প্রকৃতির সঙ্গে তার যে চিন্তা, প্রযুক্তি, যে বস্তুজগৎ তাদের ভাষা জিনিসগুলো একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। যদি মাইন্ড কারভেশন বা থট এক্সক্যাভেশন নিয়ে বলি, প্রকৃতি, বস্তুজগৎ, প্রযুক্তি মানুষের মনকে কীভাবে প্রস্তুত করে। আবার মন জিনিসগুলোকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। সে জায়গা থেকেই আমি প্রদর্শনীর নাম দিয়েছিলাম। এটি আসলে একটি জানার চেষ্টা। আমাদের অঞ্চলের মানুষের ভাবনাকে জানার প্রয়াস থেকেই মনন খনন।

আরো সহজভাবে বললে, উপনিবেশের আগেও তো আমাদের অঞ্চলের একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সমৃদ্ধ ইতিহাস যাকে বলে। আমাদের সাহিত্যে যেমন চর্যাপদ থেকে শুরু করে আমাদের ধর্মচিন্তা, দার্শনিক চিন্তাভাবনা, বুদ্ধিজম, তান্ত্রিক ভাবনা থেকে আমরা যত পেছনে যেতে পারি। জিনিসগুলো থেকে আমরা যে প্রমাণগুলো পাই, তান্ত্রিক বুদ্ধিজমের যে উন্নতি সেখান থেকে বিভিন্ন সহজিয়া চিন্তার মধ্য দিয়ে আমাদের ভাবনার পরিবর্তন এসেছে। সর্বশেষ আমি যদি সংগীতের কথা বলি। সংগীত অনেক বেশি ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। এটার কারণ ছিল, আমাদের সংগীতক্ল্যাসিক গানই হোক, লোকজই হোক বা বাউল অথবা ভাটিয়ালির কথাই যদি বলি, গানগুলোয় ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। তবে গানগুলো থেকেই আমাদের দার্শনিক ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। সেটা জীবজগৎ সংসারকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই হোক না কেন ভাবনায় একটা প্রভাব আছে।

প্রদর্শনীতে বেশকিছু কাজ নৌকা নিয়ে আপনি করেছেন। এর পেছনের গল্প জানতে চাই।

আমি প্রদর্শনীতে তিনটি ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করেছি। একটি হচ্ছে কাদা-মাটি। কারণ অঞ্চল মাটি-জলে ভরা। জলজ মাটি। মাটির কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। নরম মাটি হয়, এখানে পা দিলে পা ডেবে যায়, পায়ের চিহ্নটা থেকে যায়। জোয়ার আসে আবার যখন ভাটা আসে মাটির ওপর পলি পড়ে। তাই স্বাভাবিকভাবেই মাটির একটা বিশেষত্ব আছে। আমি জানি না মাটির কোনো বিশেষ প্রভাব আমাদের মনোবৃত্তিতে আছে কিনা। আরেকটি হচ্ছে পানি। বাংলাদেশ একটি নদীবিধৌত অঞ্চল। চারপাশে নদী, পুকুর ইত্যাদি অনেক ওয়াটার বডি রয়েছে। সেই জায়গা থেকে জলের প্রশ্ন এলেই কথাটি আসেমানুষ নদীকে ব্যবহারের জন্যই নৌকা আবিষ্কার করেছে। আমাদের এখানে বিভিন্ন ধরনের নৌকা আছে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এগুলো ব্যবহার হয়েছে। দেশের বাইরেও মানুষ নৌকা ব্যবহার করে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। কিন্তু অন্যদিকে আবার চর্যাপদ থেকে শুরু করে আমাদের ভাটিয়ালি পর্যন্ত সমস্ত চিন্তাভাবনা থেকে দেখা যাবে নৌকা একটা শরীর, একটা বডি হিসেবে প্রচুর ব্যবহৃত হয়েছে। একটি রূপক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। আমাদের শরীরটাকে আমরা যেভাবে চিন্তা করি এটাকে অনেকেই নৌকার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ভাবনাগুলোকে নিয়ে কাজ করেছে। ভাবনার মধ্যে একটা বিশেষত্ব আছে। যেটিকে আমি মনে করি এটি খুবই উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য। যার ফলে পারে নিয়ে যাও আমায়, ধরনের ভাবনার উদয় হয়। ধরনের ভাবনা থেকেই আমি আমার কাজে নৌকা ব্যবহার করেছি। সরাসরি নৌকা নয় একটা শরীর বা বডি হিসেবে ব্যবহার করেছি। এর মধ্যে একটা শারীরিক ভাব আছে। আমাদের প্রকাশভঙ্গিতে নৌকার বিভিন্ন ধরনের কাজ আছে। তাই আমরা মনুষ্য শরীরের মতো ব্যবহার করেছি নৌকাকে।

আরেকটি জিনিস ব্যবহার করেছি তা হলো ভাষা বা টেক্সট। আমদের বর্ণমালার মাধ্যমে যে ভাব আমরা প্রকাশ করি সেটা। এটিকে আক্ষরিক অর্থে আমি কতগুলো নৌকা সুন্দরবন এলাকা থেকে সংগ্রহ করেছি। ফেলে দেয়া এবং প্রায় ৩০-৪০ বছর মানুষ সেগুলো ব্যবহার করেছে। সেসব নৌকা আমি রিসাইকেল করেছি। এগুলোর মধ্যে অনেক সময়ের চিহ্ন আছে। অঞ্চলের মানুষের পারিবারিক ইতিহাস আছে। সে নৌকাগুলোকে সংগ্রহ করে কয়েক মাস লেগেছে সেগুলোকে প্রস্তুত করতে এবং তারপর প্রদর্শনীতে আমি সেগুলো কাজে লাগাতে পেরেছি। আমি কতগুলো শরীর তৈরি করার চেষ্টা করেছি। দাঁড়ানো, শোয়ানো বেশকিছু অবজেক্ট দিয়ে সাজিয়েছি। জার্নিটাকেই আমি নাম দিয়েছি মনন খনন। খননটা আক্ষরিক অর্থেই। 

আশির দশকে আপনার শিল্পযাত্রা শুরু। সে সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত শিল্প বিকাশ কতখানি হয়েছে বা পরিবর্তনটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আমাদের আশির দশক এবং বর্তমান, দুটো সময়ের পার্থক্য একেবারেই অন্য রকম। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সময়টা একটু হয়তো কঠিন ছিল। দেশের বাইরের এক্সিবিশন দেখার মতো সুযোগ ছিল না। বিদেশে আসলে কী হচ্ছে আমরা সেগুলো জানতামই না। তাই আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম। আর্ট কালচারগুলোয় যারা সর্বদা ছবি আঁকতেন, কবিতা লিখতেন কিংবা নাটক করতেন তাদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক ছিল। এত কিছু করার সুযোগ আমাদের ছিল না। নিজেরাই প্রশ্ন তৈরি করতাম এবং সে অনুযায়ী কাজ করতাম। এটি বেশ বড় একটা পার্থক্য বর্তমানের সঙ্গে। তবে এখন কেউ যদি শিল্পচর্চা করতে চান বা আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে চান তার সম্ভাবনা অনেক। সামাজিকভাবে অনেক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কাজের প্রয়োজনে নানা বিষয়ের মধ্য দিয়ে। তাই আমি দুটো সময়কে দুভাবে দেখি। এখন চাইলে ব্যক্তি উদ্যোগেও শিল্পচর্চা সম্ভব।

তরুণ শিল্পীদের নিয়ে কোনো ভাবনা যদি বলতে চান?

তরুণদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে আমার মনে হয় যদি ওরা আরেকটু স্থির হয় তবে আরো সুযোগ রয়েছে। চাইলে আরো ভালো ভালো কাজ সম্ভব বলেই আমি মনে করি। ইনফরমেশন কোনো বিষয় নয়। সেই সঙ্গে অর্থ উপার্জনের বহুবিধ উপায় রয়েছে এখন। ফলে আরেকটি বিষয় যা হয়েছে, তরুণরা খুব সহজেই অর্থ উপার্জনের দিকে ঝুঁকছে।

আরও