থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মগত রোগ। অর্থাৎ একজন শিশু জন্মের সময়ই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। দেশে যে হারে থ্যালাসেমিয়া বাহকের হার বাড়ছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় থ্যালাসেমিয়া জরিপ ২০২৪ অনুসারে, বাংলাদেশে জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। দেশের বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রংপুরে। সচেতন ও সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার বাহক শনাক্ত করে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। দেশে বাহকের সংখ্যা বাড়লেও হাসপাতালগুলোয় এ রোগের পর্যাপ্ত ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর থ্যালাসেমিয়ার রোগী এক নয়। বাহকের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না, তেমন কোনো চিকিৎসাও লাগে না। তবে একজন বাহক পরবর্তী প্রজন্মে রোগ বহন করতে সক্ষম। অথচ সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা যায় যে একজন ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করার কারণে অনেকেই জানেন না যে তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক। অজান্তেই থ্যালাসেমিয়া বাহকদের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে এবং দিনদিন থ্যালাসেমিয়া রোগী বাড়ছে। অথচ পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করে প্রতিরোধের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার হার কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশ্বের অনেক দেশ পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত একটি রোগ। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। মূলত জিনগত ত্রুটির কারণে এ রোগে দেহে অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। এ কারণে লোহিত রক্তকণিকা নির্ধারিত সময়ের আগেই ভেঙে যায়। ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। মা-বাবা উভয়ই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি ২৫ শতাংশ, বাহক হওয়ার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ আর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। মা-বাবা যেকোনো একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ, তবে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার আশঙ্কা নেই। চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হলে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের সারা জীবন চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। থ্যালাসেমিয়ার প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে নিয়মিত রক্ত স্থানান্তর করা। এ পদ্ধতিতে সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ পরপর আক্রান্ত রোগীর দেহে শ্বেতকণিকা বাদে লোহিত কণিকা দেয়া হয়ে থাকে। রক্ত স্থানান্তরের ফলে শরীরে তৈরি হওয়া অতিরিক্ত লৌহ কণিকার কারণে রোগীর যকৃৎ, হৃৎপিণ্ড আর অগ্ন্যাশয়ে সমস্যা তৈরি হয়। এসব শারীরিক সমস্যার সমাধানে রক্ত স্থানান্তরের পাশাপাশি বিশেষ ওষুধও গ্রহণ করতে হয়। অন্যদিকে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে এ রোগের একমাত্র স্থায়ী চিকিৎসা। কিন্তু নানা ঝুঁকি থাকার কারণে খুব কম ক্ষেত্রেই বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন করা হয়ে থাকে। রোগীকে সুস্থ রাখতে ব্যয়বহুল চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়।
থ্যালাসেমিয়া আগে থেকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন রোগের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের প্রধান উপায় হচ্ছে স্বামী ও স্ত্রী থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা তা বিয়ের আগে পরীক্ষা করা। পরীক্ষায় যদি দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক শনাক্ত হন, সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বিয়েকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কেননা একজন সুস্থ মানুষ যে কাউকে (বাহক বা রোগীকে) বিয়ে করতে পারবে। কারণ তাদের সন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ সন্তানের রোগী হওয়ার ঝুঁকি আছে। অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া বাহকদের মধ্যে বিয়ে না হলে পরবর্তী প্রজন্মে থ্যালাসেমিয়া রোগী জন্ম নেয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করেই বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনতে পেরেছে। এর অন্যতম উদাহরণ ইরান, গ্রিস ও সাইপ্রাস। এসব দেশে একসময় রোগীর সংখ্যা অনেক ছিল।
দেশে থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও নির্ণয়ের পদ্ধতি এখনো অনেকেরই অজানা। যার কারণে ক্রমেই বাড়ছে বাহকের সংখ্যা। মানুষ যাতে সহজেই দেশের সব হাসপাতালে বাহক নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারে সে বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে হবে। বাহক নির্ণয়ের পাশাপাশি থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য দেশে পর্যাপ্ত ও উন্নত মানের সহজলভ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এছাড়া মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে। যাতে তারা তাদের বাহক নির্ণয় পরীক্ষা করে এবং বাহকে বাহকে বিয়ে বন্ধ করে। এর মাধ্যমেই আমরা থ্যালাসেমিয়ার হার কমিয়ে এনে সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে পারি। থ্যালাসেমিয়া রোগ ও বাহক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ব্যাপক হারে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করি।