অসুখ হলেই রোগ নিরাময়ের জন্য মানুষ ডাক্তারের কাছে ছুটে যায়। ডাক্তারের পরামর্শ কিংবা ওষুধপথ্য ছাড়া রোগ নির্ণয় বা নিরাময় কোনোটাই সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের পৃথিবীর কোনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হলে সে অসুখ সারানোর জন্য পৃথিবী কারো কাছে ছুটে যেতে পারে না। তবে পৃথিবীর এ অসুখ সারাতে ছুটে যায় মানুষ। তারা সবাই ‘পৃথিবীর ডাক্তার’। আপনি যদি ‘পৃথিবীর ডাক্তার’ হতে চান তাহলে আপনার পড়ার বিষয় হতে পারে কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে দেশের ১৯টি জেলার লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রেমাল উপকূলে আঘাত হানার পর থেকে প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করেছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেন এত দীর্ঘস্থায়ী হলো এ রেমালের তাণ্ডব? হ্যাঁ, এটিই পৃথিবীর এক অসুখ। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, ভূমিকম্প, ভূমিধস, নদীভাঙন, আর্সেনিক দূষণ ও সিঙ্কহোলের মতো বহু অসুখ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর এ অসুখ হয়তো পুরোপুরি সারানো সম্ভব নয়, তবে এর কারণ অনুসন্ধান, উপকূলের মানুষের ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে এড়ানো যায় সেসব নিয়েই কাজ করেন কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৬ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয় কোস্টাল স্টাডিজ বা উপকূল অধ্যয়নবিষয়ক বিভাগ। এ বিভাগের বিশেষত্ব কী জানতে চাইলে বিভাগটির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, ‘পৃথিবীর বুকে উপকূল অধ্যয়নসংক্রান্ত ব্যাচেলর অনার্স ডিগ্রি আমরাই শুরু করি। মানুষের যেমন অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, তেমনি পৃথিবীর জল, স্থল, বায়ুমণ্ডল ও প্রকৃতিতে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হলে এ বিভাগের শিক্ষক-ছাত্ররা সেই অসুখ সারাতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট দুটি বিষয়ের সমন্বয়ে বিভাগটির কোর্স কারিকুলাম হলেও মূলত উপকূলীয় অঞ্চলকে গুরুত্ব দিয়েই প্রকৌশল বিষয়ে কোর্সগুলো বেশি পড়ানো হয়। সব ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ কেন হয়, কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় এসব নিয়ে এখানে পড়ানো হয়। কোর্সগুলোর মধ্যে রয়েছে উপকূল প্রকৌশল, হারবার প্রকৌশল, সমুদ্রবিজ্ঞান, ডিজাস্টার সায়েন্স, আবহাওয়াবিদ্যা, পরিবেশ বিজ্ঞান, ব্লু ইকোনমি, সয়েল ম্যাকানিকস, ম্যাথস, স্ট্যাটিস্টিক, ভূতত্ত্ব, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, নিউমেরিক্যাল মডেলিং অ্যান্ড সিমুলেশন, ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন, ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডাপটেশন, জিআইএস, রিমোট সেন্সিং, কার্টোগ্রাফি এবং ম্যাপিং, অ্যাকুয়াকালচার এবং সামুদ্রিক মৎস্য, ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট, গবেষণা পদ্ধতি ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি।
চার বছরের স্নাতক কোর্সে মোট ১৪২ ক্রেডিটের মধ্যে রয়েছে ১৮ ক্রেডিট ব্যবহারিক বিষয়। একজন শিক্ষার্থীকে স্নাতক শেষ করতে তিনটি ফিল্ড ওয়ার্ক ও রিপোর্ট করতে হয়। এ ফিল্ড ওয়ার্কে শিক্ষার্থীদের উপকূলীয় এলাকা, সমুদ্র ও পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে মাঠ পর্যায়ে একাডেমিক বিষয়গুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গবেষণার ফলাফল রিপোর্ট আকারে জমা দিতে হয়। বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মুন্সি রিয়াজ রাফসান বলেন, ‘আমাদের শুধু বইয়ের তাত্ত্বিক বিষয়ে পড়ানো হয় না, বরং মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের সুযোগ সবচেয়ে বেশি পাই। আর বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান উপকূল অঞ্চলে হওয়ায় প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ একাডেমিক বিষয়ের সঙ্গে ব্যবহারিক এক যোগসূত্র তৈরি করেছে। বিষয়টি পড়াশোনায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আরো বেশি আগ্রহী করে তোলে।’
বিভাগটির আরেক বিশেষত্ব হলো শিক্ষার্থীরা সবাই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। স্নাতকোত্তরের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা জলবায়ু পরিবর্তন, উপকূল বনায়ন, তাপমাত্রার পরিবর্তন, সাইক্লোন, সাইক্লোন শেল্টার, কৃষি ক্ষেত্রে অভিযোজন, লবণাক্ততা, পানির গুণগত মান, মাটির গুণাগুণ, নদীভাঙন ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয়। আন্তর্জাতিক ও ভূরাজনীতিতেও এটি একটি নিত্য চর্চিত বিষয়। সরকারি ও বেসরকারি খাতে উপকূল অধ্যয়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গ্র্যাজুয়েটদের চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনি গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষার ব্যাপ্তিও বেড়েছে। এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ রয়েছে। স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক অন্যতম শীর্ষ গন্তব্য দেশ। ভালো ফলাফল আর গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকলে স্কলারশিপ নিয়ে বিনা খরচেই এসব দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অধ্যাপক ড. হাফিজ আশরাফুল হক জানান, যেহেতু এটি স্পেশালাইজড সাবজেক্ট তাই এ বিষয়ে অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। মৌলিক সাবজেক্টে অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থীদের তুলনায় এ সাবজেক্টের শিক্ষার্থীদের সুযোগের হারটা একটু বেশি। পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা সরকারি সংস্থা, এনজিও, আন্তর্জাতিক এনজিও, দুর্যোগ ও মানবিক জরুরি ব্যবস্থাপনা সংস্থায় কাজ করতে পারে। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস প্রোগ্রাম কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বিশ্লেষকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে।