বাজেটের আকার বাড়ছে। সে তুলনায় বাড়ছে না রাজস্ব আহরণ। ঘাটতি পূরণে ঋণনির্ভরতা বাড়ছে সরকারের। ২০২৪-২৫ থেকে ২০২৬-২৭ অর্থবছরের জন্য প্রণীত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে তুলে ধরা এক প্রক্ষেপণে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী তিন অর্থবছরে সরকারের ঋণ বাড়বে ৯ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি (চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত স্থিতির তুলনায়)। এতে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণ স্থিতি ২৭ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
সরকারি ঋণের এ চিত্রকে উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, ঋণ বাড়তে থাকায় সরকারের মোট পরিচালন ব্যয়ে সুদ পরিশোধের অংশ ক্রমেই বাড়ছে। ব্যয় নির্বাহ করতে সরকার এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়ছে। একদিকে রিজার্ভের ক্ষয় অব্যাহত রয়েছে, অন্যদিকে রফতানি ও রেমিট্যান্সে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি মিলছে না। ফলে সরকারের ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। এর পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও দেখা দিয়েছে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা। এ অবস্থায় সরকারের ঋণনির্ভর প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বাড়ানোয় মনোযোগ দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা পরের অর্থবছরে (২০২২-২৩) বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৬০ হাজার ১০০ কোটি টাকায়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের স্থিতি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দাঁড়ানোর কথা জানানো হয়েছিল। আর গত বৃহস্পতিবার উত্থাপিত বাজেটে আগামী অর্থবছরে সরকারের ঋণ স্থিতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ২১ লাখ ৬২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আগামী ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এ স্থিতি যথাক্রমে ২৪ লাখ ৪৫ হাজার ১০০ কোটি ও ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় দাঁড়ানোর প্রক্ষেপণ রয়েছে।
সরকারের ক্রমবর্ধমান ঋণনির্ভরতায় বাড়ছে সুদ ব্যয়ের পরিমাণ, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এরই মধ্যে সরকারের পরিচালন ব্যয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়ের খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে ঋণের সুদ। সরকারের দায়দেনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যয় আরো বাড়বে। এ দায়দেনার চাপকে আরো বাড়িয়ে তুলছে রিজার্ভের ক্রমাগত ক্ষয়।
জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরে ঘাটতি পূরণের জন্য দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি। আর সরকারের পরিচালন ব্যয় খাতে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় সোয়া ১৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেভাবে ঋণ পরিশোধের দায়দেনা বাড়ছে, তা অর্থনীতির জন্য একটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন উন্নয়ন ব্যয়ের পুরোটাই দেশী ও বিদেশী ঋণের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। রাজস্ব আয় বাড়িয়ে এখানে বরাদ্দ দিতে হবে। কারণ এরই মধ্যে জনপ্রশাসনের পর সুদ ব্যয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে চলে এসেছে। রিজার্ভ কমতে থাকায় এটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে। আর ঋণের আসলও এখন ঋণ করেই পরিশোধ করতে হচ্ছে। এটা কোনো টেকসই ব্যবস্থা নয়। তাই নতুন ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। ব্যয়ের অগ্রাধিকারগুলোও পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।’
গত কয়েক বছরে বিদেশী ঋণের ভিত্তিতে বেশকিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন এরই মধ্যে শেষ হয়েছে বা হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে বড় কয়েকটির গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হতে যাচ্ছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, ঢাকা পাওয়ার নেটওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ ও প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন (পিইডিপি-৪) প্রকল্প। এছাড়া আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বৃহৎ প্রকল্পগুলোরও গ্রেস পিরিয়ড আগামী দুই বছরের মধ্যে শেষ হতে যাচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে জোরালো হতে যাচ্ছে সরকারের ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের চাপও।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সরকারি ঋণের স্থিতি এভাবে বেড়ে যাওয়া উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। একদিকে রিজার্ভ কমছে। অন্যদিকে রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও কম। তাই ঋণ পরিশোধে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। আবার বড় ঋণে নেয়া বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নেও রয়েছে ধীরগতি। ফলে বিদেশী বিনিয়োগ না বাড়লে এখন উদ্বেগ আরো বাড়বে। তাই প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা করা উচিত। অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে নতুন করে কোনো বড় ধরনের প্রকল্পের জন্য ঋণ গ্রহণ করাও উচিত হবে না।’
সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাংক খাতের সুদহারও এখন বাড়ছে। বছর দুই আগেও ৯১ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল আড়াই শতাংশের কম। স্বল্পমেয়াদি এ ঋণের সুদহার এখন ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মেয়াদ বেশি হলে ঋণ নিতে সরকারকে আরো বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এখন ব্যক্তি খাতের চেয়ে সরকারকে ঋণ দেয়াকেই বেশি লাভজনক মনে করছে।
এতে বেসরকারি খাত ঋণ পেতে সমস্যায় পড়বে বলে আশঙ্কা উদ্যোক্তাদের। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়লে অর্থনীতিতে একটি ‘ক্রাউডিং আউট’ প্রভাব তৈরি হতে পারে। এর ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।’
এ অবস্থায় সরকারের ব্যয় সংকোচনে নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকেই। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, ‘সরকারের ব্যয় কমিয়ে এবং বিদেশী উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ঘাটতি মেটানোর দিকে জোর দেয়া উচিত, যাতে করে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে তুলনামূলক কম হারে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হয়। বিপুল অর্থ যদি ব্যাংক ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া হয়, তাহলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে চাপ তৈরি হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন বিনিয়োগ না এলেও বর্তমান শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে অর্থ প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।’
স্থানীয় উৎসগুলোর মধ্যে সরকার ব্যাংক খাত ছাড়াও ট্রেজারি বিল, বন্ড ও সুকুকের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে থাকে। এর বাইরে সঞ্চয়পত্র ও সরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের মাধ্যমে ব্যাংক-বহির্ভূত উৎস থেকেও ঋণ নেয়া হয়। বাজেট প্রণয়নের সময় প্রতি বছরই বড় অংকের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যদিও প্রকৃত রাজস্ব আহরণ হয় তার চেয়ে অনেক কম। সরকারকে প্রতি বছরই ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ বাবদ বড় অংকের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। মূলত রাজস্ব আয়ের অর্থ থেকে স্থানীয় ঋণ এবং রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে বিদেশী ঋণ শোধ করা হয়ে থাকে।
সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান ও সাবেক নীতিনির্ধারকদের অনেকেই মনে করছেন ঋণ গ্রহণের দিক দিয়ে এখনো খুব একটা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়েনি বাংলাদেশ। সরকারের সাবেক অর্থ সচিব ড. মোহাম্মদ তারেক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঋণ গ্রহণ বাড়ছে। তবে এটা এখনো চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। ঐতিহাসিকভাবেই বাজেটে সরকারের সুদ ব্যয়ের বরাদ্দ বেশি থাকে। আরো এক দশকেও ঋণ গ্রহণের দিক দিয়ে আমাদের সমস্যা হবে না বলে আমি মনে করি।’