রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন যেতে গতকাল দুপুরে শাহজাদপুরে সিএনজিচালিত অটোরিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আকতারুজ্জামান খান। কিন্তু কোনো চালকই ওই পথে যেতে রাজি হচ্ছেন না। প্রায় মিনিট ১৫ অপেক্ষার পর একজন চালক অতিরিক্ত ভাড়ায় যেতে রাজি হলেন। যাত্রাপথে কথা প্রসঙ্গে আকতারুজ্জামানকে ওই চালক বলেন, ‘সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের চাপ কম। তাই গাড়িতে গ্যাস ভরতেই অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। অনেক স্টেশনে তো গ্যাসই মিলছে না। তাই স্বল্প দূরত্বে ভাড়া নিলে এখন আর পোষাচ্ছে না।’
বেশ কয়েকটি সিএনজি স্টেশন ঘুরে ওই চালকের কথার সত্যতা মিলেছে। গ্যাস সংকটের কারণে বেশির ভাগ সিএনজি পাম্পই বন্ধ থাকছে। যেসব পাম্পে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোয় দীর্ঘ সময় চালকদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে চাপ এত কমে গেছে যে ২-৩ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস মিলছে না। তাই দিনে একাধিকবার গ্যাসের জন্য লাইন দিতে হচ্ছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এতে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প-কারখানায় নেমে এসেছে গ্যাসের চাপ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্যাস মিলছে না আবাসিকেও। গভীর রাত পর্যন্ত সিএনজি স্টেশনে ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহনের দীর্ঘ লাইন। উৎপাদন কমে যাওয়ায় মফস্বলে বিদ্যুৎ সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে পল্লী বিদ্যুৎ। এ পরিস্থিতিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চেয়ে এরই মধ্যে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়েছেন শিল্প মালিকরা।
পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে স্বাভাবিক সময়ে গ্যাস সরবরাহ হয় কম-বেশী ৩ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে স্থানীয় গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে সরবরাহ হয় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। বাকি ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি। বর্তমানে একটি টার্মিনাল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সংস্কারে থাকায় এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে ৬১২ মিলিয়ন ঘনফুট। বাকি ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে শিল্প, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আবাসিক ও সিএনজিতে।
দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে তার বেশির ভাগ ব্যবহার হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সেখানেও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি হওয়ায় দেশের মফস্বল এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, বিদ্যুৎ খাতে (গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র) প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২ হাজার ৩১৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে সরবরাহ হচ্ছে ৯৫০ থেকে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ৮ জুন বিদ্যুৎ চাহিদার প্রাক্কলন করা হয়েছে দিনে ১৩ হাজার ও রাতে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। তবে ঠিক কী পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়েছে তার পূর্ণ হিসাব জানা না গেলেও ঘণ্টাপ্রতি বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনে প্রায় ৫৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট, উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ২৪১ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ ঘাটতি রাজধানীতে বড় আকারে না পড়লেও দেশের মফস্বল এলাকাগুলোয় তীব্রতর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, খুলনা, পিরোজপুর, বাগেরহাটসহ পল্লী বিদ্যুতের বেশির ভাগ অঞ্চলে বিদ্যুৎ থাকছে না অন্তত ৬-৮ ঘণ্টা।
এদিকে গ্যাস সংকটে শিল্পের উৎপাদন তীব্রতর হয়ে উঠেছে। শিল্পে গ্যাসের প্রেসার শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসায় এরই মধ্যে শিল্প মালিকরা পেট্রোবাংলাকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। সংগঠনটি ওই চিঠিতে জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, সাভার, আশুলিয়া, মাওনাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত বিটিএমএর সদস্য মিলগুলোয় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রাপ্ত গ্যাসের গড় পিএসআই শূন্য থেকে ২-এ নেমে এসেছে। ফলে মিলগুলোর অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কম্পিউটারাইজড মেশিনারিজ নষ্ট হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে কয়েক মাস ধরে মিলগুলো উৎপাদন ক্ষমতার গড়ে ৪০-৫০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে। নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে বারবার অনুরোধ করেও গ্যাস সরবরাহে কোনো অগ্রগতি হয়নি, বরং কয়েক দিন ধরে মিলগুলোয় গ্যাস সরবরাহ প্রায় নেই বললেই চলে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে মিলগুলো কতদিন চালু রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’
গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় আবাসিকেও তীব্রতর হয়ে উঠছে সংকট। সকাল থেকে দুপুর অবধি গ্যাস না থাকার কথা জানিয়েছেন রাজধানীর আবাসিক গ্রাহকরা। তাদের ভাষ্য, খুব ভোরে ঘণ্টা দুয়েক গ্যাস পাওয়া গেলেও সকাল থেকে দুপুর অবধি গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। রাতেও অনেক সময়জুড়ে গ্যাস পাওয়া যায় না। ঠিকমতো গ্যাস না পাওয়ায় রান্নাসহ অন্যান্য কাজে করতে পারছেন না তারা।
রাজধানীর মিরপুর-১-এর বাসিন্দা রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাস পাই না ঠিকমতো। সিলিন্ডার কিনে রান্নার বিকল্প কাজ চলছে। অথচ প্রতি মাসে গ্যাস না পেয়েও বিল দিতে হচ্ছে নিয়মিত। এ পরিস্থিতি আর কতদিন চলবে?’
গ্যাসের প্রেসার না থাকায় গণপরিবহনগুলো ঠিকমতো চালাতে পারছেন না বাস মালিকরা। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত গাড়িগুলোর দিন-রাত স্টেশনের সামনে দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘ লাইনের কারণে রাস্তায় তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে। ৫-৭ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও গ্যাস নিতে পারছেন না তারা। গ্যাসের প্রেসার না থাকায় মেশিনগুলো নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে, গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের প্রেসার না থাকায় সিএনজি স্টেশনগুলোয় গাড়ির দীর্ঘ লাইন পড়ছে। ঢাকার ভেতরের স্টেশনগুলোয় ১৫ পিএসআই থাকার কথা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে ১-২ পিএসআই। আর ঢাকার বাইরে ২-৩ পিএসআই প্রেসার পাওয়া যাচ্ছে। গ্যাসের প্রেসার না থাকায় পাওয়ার নষ্ট হচ্ছে, মেশিনের ক্ষতি হচ্ছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, তিন সপ্তাহ এ পরিস্থিতি থাকবে।’
সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে সারা দেশে মোট ৫২৫টি সিএনজি স্টেশন রয়েছে। সিংহভাগ স্টেশন গ্যাসের প্রেসারজনিত সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে শিল্প এলাকায় যেসব স্টেশন রয়েছে, সেখানকার অবস্থা তুলনামূলক কিছুটা ভালো। দেশে মোট গ্যাস চাহিদার ৪ শতাংশ ব্যবহার হয় সিএনজি খাতে।
গ্যাস সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে গত সপ্তাহে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নষ্ট হয়েছে। সেটি সংস্কার করতে তিন সপ্তাহ লাগবে। তার আগ পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ এ রকম থাকবে। আমরা সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।’