সমৃদ্ধি কেবল মেগা প্রকল্পে নয়, নাগরিক স্বাধীনতায়ও থাকতে হবে —পিটার হাস

এখানে এসে আমার বেশ ভালো লাগছে। সত্যি বলতে কি, আমি নিজেও বেড়ে উঠেছি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে, শিকাগোয়। নিউইয়র্কের পরেই ছিল এর অবস্থান। সুতরাং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বলতে কী বোঝায়, তা আসলে কিছুটা বুঝতে পারি। এখানে এসে ভালোই লাগছে। নৌঘাঁটি থেকে শুরু করে জাহাজ ভাঙা শিল্পসহ বেশকিছু জিনিস দেখলাম। এখানে অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং চট্টগ্রামের

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে স্থানীয় জাহাজ ভাঙা শিল্প পরিদর্শনসহ কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি তিনি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাশেদ এইচ চৌধুরী

চট্টগ্রামে এটা কি আপনার প্রথম সফর? বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে এসে আপনার কেমন লাগছে?

এখানে এসে আমার বেশ ভালো লাগছে। সত্যি বলতে কি, আমি নিজেও বেড়ে উঠেছি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে, শিকাগোয়। নিউইয়র্কের পরেই ছিল এর অবস্থান। সুতরাং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বলতে কী বোঝায়, তা আসলে কিছুটা বুঝতে পারি। এখানে এসে ভালোই লাগছে। নৌঘাঁটি থেকে শুরু করে জাহাজ ভাঙা শিল্পসহ বেশকিছু জিনিস দেখলাম। এখানে অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বেশকিছু খাবারও চেখে দেখেছি। 

আপনি এখানে একাডেমি ফর উইমেন অন্ট্রাপ্রেনিউর এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের প্রাক্তন ছাত্রদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ ধরনের উদ্যোগকে গুরুত্বপূর্ণ কেন মনে করছেন?

একাডেমি ফর উইমেন অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপের নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক ছিল। কারণ এতে একদিকে তাদের বিক্রি করা পণ্যগুলো দেখেছি, আবার এ ধরনের কার্যক্রম তাদের ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কীভাবে কাজে লাগছে তাও জানতে পেরেছি। সবচেয়ে মজার কথা হলো, তাদের প্রায় সবাই জানিয়েছেন যে তারা পণ্যের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে নিজেদের সময় ও প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিতে শিখেছেন। কার্যক্রমটি পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের থান্ডারবার্ড স্কুল অব গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট। অংশগ্রহণকারীদের কেউ কেউ দ্বিতীয় দোকান খোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আবার কেউবা রফতানি বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। এছাড়া উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সমাজ ও পরিবারের কাছ থেকে তারা কেমন বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন সে বিষয়েও কথা বলেছেন তারা। জেনেছি কীভাবে তারা সেসব প্রতিকূলতা অতিক্রম করেছেন। সারকথা, পুরো বাংলাদেশে নারীর আর্থিক ক্ষমতায়নের স্বরূপ দেখেছি। বাংলাদেশ এ বিষয়ে বেশ ভালো অগ্রগতি করেছে। পরিপূর্ণভাবে নারীর আর্থিক ক্ষমতায়নের জন্য যেসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করা জরুরি, বাংলাদেশ এখন সেগুলো করছে। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রকৃতপক্ষেই অনুপ্রেরণামূলক ছিল।

জাহাজ ভাঙা শিল্পে কী কী দেখলেন? কোন বিষয়গুলো আপনার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল? 

বাংলাদেশে যে শিল্পটি পুরো পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটি হলো জাহাজ ভাঙা শিল্প। বিগত বছরগুলোয় দুর্নাম ছিল, বাংলাদেশ পরিবেশের যত্ন নেয় না এবং শিল্পটিও নিরাপদ না। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের একটি ফ্যাসিলিটি (কারখানা) সব আন্তর্জাতিক শর্ত মেনে রিসাইকেল করছে, যা পরিবেশ ও সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ। সুতরাং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রদর্শন এবং অন্যান্য ফ্যাসিলিটিও যেভাবে নিরাপত্তার ওপর জোর দিচ্ছে তা বেশ চিত্তাকর্ষকই বটে। আমাদের জাহাজ ভাঙা শিল্পের কিছু শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এছাড়া নিরাপত্তার মানোন্নয়নে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দানকারী এনজিও ‘‌ঈপ্সা’র সঙ্গেও কথা বলেছি। এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, পরিবেশ ও শ্রমিকদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হচ্ছে। তবে শ্রমিকদের মজুরি, তাদের সমাবেশ ও বিক্ষোভ করার অধিকারের ক্ষেত্রে উন্নতির জায়গা রয়েছে। সব মিলিয়ে জাহাজ ভাঙা শিল্পে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অগ্রগতি দেখার মতোই ব্যাপার। 

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে এখানে বেশকিছু খাতে অবদান রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। পারস্পরিক স্বার্থে ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ ওয়াশিংটন। এ দেশের মানুষের প্রত্যাশাও তেমন। সামনের দিনগুলোয় আপনারা কোন বিষয়গুলোয় জোর দেবেন?

বর্তমানে আমরা পাঁচটি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছি। আমি মনে করি, সবাই এটা জানে যে মানবাধিকার সে পাঁচটি ইস্যুর একটি। এছাড়া আমরা নিরাপত্তা সহযোগিতার ওপর জোর দিচ্ছি, যার অংশ হিসেবে আমার এখানে জাহাজ পরিদর্শনে আসা। আমরা অর্থনীতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া এখানকার রোহিঙ্গা ইস্যুর ওপরও জোর দিচ্ছি। শিক্ষাসহ রোহিঙ্গাদের অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজন কীভাবে মেটানো যায় সে ব্যাপারে দৃষ্টি রয়েছে। আমি এ ইস্যুগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে যাব। 

আপনি দুই বছর ধরে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, সামাজিক বন্ধন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং এ দেশের মানুষ নিয়ে আপনার প্রাথমিক মূল্যায়ন কী?

বাংলাদেশ এক কথায় অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি দেশ। বিশেষ করে এখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির যূথবদ্ধতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি গতকাল রাতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম। মানুষের মনোযোগ ছিল শুধু বাংলা গান, বাংলা নাচ আর ঐতিহ্যবাহী বিনোদনের দিকে। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল এবারের বাংলা নববর্ষ ও ঈদ উৎসবের ঠাস বুনন। দ্রুত বিকাশমান একটি দেশ দেখা সত্যি আনন্দের। এখনো এ দেশটা এতটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে! আমি মুগ্ধ হয়ে যাই, যখন দেখি লোকজন তর্ক করে যে কালা ভুনা নাকি মেজবান ভালো? নাকি কাচ্চি বিরিয়ানি ভালো? এসব নিয়ে মানুষ টানা কথা বলে যায়। কোন শহরের মিষ্টি সবচেয়ে সেরা? এ নিয়েও তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করে। এটা আমার কাছে গল্পের মতো মনে হয়। আমি শুনলাম গতকাল কালা ভুনা অন্য সবকিছুকে হারিয়ে দিয়েছে। আমি এর আগেই কালা ভুনার স্বাদ নিয়েছি। গতকাল রাতে আমি জলপাই দিয়ে গরুর মাংস চেখে দেখলাম। খেয়ে মনে হলো, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এটা বিশেষ একটি পদ।

সাম্প্রতিক সামরিক মহড়া নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ যদি জানান। এর এমন কোন বিশেষ দিক আছে, যা আপনার মনে দাগ কেটেছে?

এ স্বেচ্ছাসেবামূলক মহড়া ৩০ বছর পার করল। ভাবুন তো একবার, ৩০ বার আমরা আমাদের নৌবাহিনীকে একত্র করতে পেরেছি। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে আমাদের সেরা অনুশীলনগুলো শেয়ার করেছি। এগুলো আমাদের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবিক সহায়তা, দুর্যোগে ত্রাণ, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, জাহাজ ও উপকূলের নিরাপত্তার দিকে আমাদের বিস্তর মনোযোগ রয়েছে। গত ১০ বা ১৫ বছরের স্লাইড শোগুলোও তারা আমাকে দেখিয়েছে। দুই দেশের অংশীদারত্বের উত্তম নিদর্শন ছিল এ মহড়া এবং আমরা দেখিয়েছি কীভাবে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। এ যৌথ প্রয়াস আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে আবেদন করতে এডুকেশন ইউএসএ প্রোগ্রাম কীভাবে চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে পারে? 

আপনারা দেখছেন, এ মুহূর্তে আমরা চট্টগ্রামে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির আমেরিকান কর্নারে। আমরা প্রায় এক বছর আগে এ কর্নার চালু করেছিলাম। আমি জানতে পেরেছি, এখানে সবসময় ভিড় লেগে থাকে। এর একটি কারণ হলো এখানে এডুকেশন ইউএসএ (মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের শিক্ষাবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান) আছে। বিনামূল্যের পরিষেবা হিসেবে, আমি আবারো বলছি যে বিনামূল্যের পরিষেবা হিসেবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এখানে এসে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ভর্তির পরামর্শ নিতে পারেন। সেসব প্রতিষ্ঠানে কীভাবে আবেদন করতে হবে, কোন বিষয়ে কীভাবে বৃত্তি পাওয়া যায়, এসব পরামর্শ পেতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে চার হাজারের বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ফলে কোন প্রতিষ্ঠান আপনার জন্য সবচেয়ে বেশি ভালো, তা জানতে হলে পরামর্শ নিন। এ ব্যাপারে প্রত্যেকের অধিকার আছে। ফলে আমরা এখানে যে আছি, এটা সত্যি অসাধারণ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন গৃহীত হয়েছে এমন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে গতকাল আমি কথা বলেছি। এ সময় আমার সামনে ছিল কালা ভুনাসহ ডোমিনো’জের পিৎজা। তারা বলছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিষয় পছন্দ করার ক্ষেত্রে এডুকেশন ইউএসএ কীভাবে তাদের সাহায্য করেছিল। তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনে বেশ ভালো লেগেছিল। আমি আবারো জানাতে চাই, এডুকেশন ইউএসএর এ পরিষেবা একেবারে ফ্রি। এখানে প্রয়োজনীয় বই পাবেন এবং পরামর্শকদের দিকনির্দেশনা পাবেন। আপনারা এখানে আসুন, সেবা নিন। 

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০২৩- প্রকাশ হয়েছে। এ প্রতিবেদন নিয়ে কিছু বলবেন কি? 

আমরা পৃথিবীর প্রতিটি দেশের ওপর প্রতি বছর একটি প্রতিবেদন তৈরি করি। আমরা এটিকে বাস্তবসম্মত করার চেষ্টা করি। এখানে আমরা কোনো মনগড়া কথা বলি না। কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনের তালিকা করি। কারণ এ দেশগুলোর প্রতি বছরের পর বছর ধরে আমরা সজাগ রয়েছি। বাংলাদেশে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন আমরা দেখেছি, তা নথিভুক্ত করা হয়েছে। আমরা এ কথা বলি না যে আমরা নিখুঁত, তা হয়তো আমরা নইও। আমাদের মানবাধিকার ইস্যুগুলো নিয়ে লোকজন কিন্তু ঠিকই যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে। কিন্তু মানবাধিকার ইস্যু যদি খতিয়ে দেখা না হয় এবং সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা না হয় তা এমনিতে কেটে যাবে না। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে মৌলিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনগত স্বাধীনতা এবং দেশটি কতটা সমৃদ্ধ, এসবের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছে। আমি মনে করি, এ বিষয়গুলো সত্যি গুরুত্বপূর্ণ। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যে দেশের জনগণ যত বেশি স্বাধীন, সে দেশের অর্থনীতি তত বেশি উন্নত। তাই আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হতে চায়। কারণ এটি প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৪১-এর অংশ। বাংলাদেশকে বুঝতে হবে, সমৃদ্ধি কেবল মেগা প্রকল্প, এটা-ওটা করার মধ্যে নয়; এর বড় অংশই নিহিত প্রত্যেক নাগরিকের বাছাই করার স্বাধীনতার মধ্যে। কোনো দেশের উন্নয়নে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বণিক বার্তাকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আলোচনাটি বেশ উপভোগ্য ছিল।

আপনাকে ও বণিক বার্তাকেও ধন্যবাদ।

আরও