আলোকপাত

হরেদরে ব্যাংকের অনুমোদনের সিদ্ধান্ত কি আত্মঘাতী ছিল

আমাদের খেলাপি ঋণ সংকটের সমাধান খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু মনে হচ্ছে, ‘মার্জার’ই সমাধান দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘মার্জার’ মানে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে ‘‌মন্দ’ ব্যাংকের একীভূতকরণ। এরই মধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পদ্মা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক দিয়ে। ফলাফল কী হবে তা আমরা এ মুহূর্তে কিছুই বলতে পারব না। তবে এতে প্রমাণিত হলো যে হরেদরে ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল

আমাদের খেলাপি ঋণ সংকটের সমাধান খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু মনে হচ্ছে, ‘মার্জার’ই সমাধান দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘মার্জার’ মানে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে ‘‌মন্দ’ ব্যাংকের একীভূতকরণ। এরই মধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পদ্মা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক দিয়ে। ফলাফল কী হবে তা আমরা এ মুহূর্তে কিছুই বলতে পারব না। তবে এতে প্রমাণিত হলো যে হরেদরে ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল আত্মঘাতী। কী উত্তেজনায় কাজটি করা হয়েছিল তার সঠিক কারণ বোঝা দায়। এখন দেখা যাচ্ছে, ‘‌কিছু একটা’ করতে হবে—তাই ‘‌মার্জার’, ‘‌মার্জার’ আওয়াজ উঠেছে। এ সম্পর্কে এরই মধ্যে নানাজন নানা মন্তব্য করে যাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, ‘‌ভালো’ ব্যাংকও আতঙ্কে আছে। বলা যায় না কার কপালে কী আছে। কার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয় কোন ‘‌মন্দ’ ব্যাংক। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক বেশি—কার চাকরি থাকে, কারটা যায়। শত হোক ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন খুবই বড় ঘটনা। আবার মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক তাদের বোঝা কত বাড়ে। শেয়ারের ভিত্তি বড় হলে লভ্যাংশে টান পড়বে। সবকিছু নতুন করে ভাবতে হবে। আরো কতসব দুশ্চিন্তা। সবই কিন্তু একটা বিষয় কেন্দ্র করে। এটি হচ্ছে খেলাপি ঋণ বা শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ (ক্ল্যাসিফায়েড লোন)। বিরাট সমস্যা। খাতাপত্রে বলা হচ্ছে, এ মুহূর্তে সোয়া লাখ কোটি টাকার ওপরে হচ্ছে খেলাপি ঋণ। কিন্তু কথা আছে। প্রচুর ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করা হয়েছে। আবার রয়েছে প্রভাবশালীদের পুনর্গঠিত (রিস্ট্রাকচার্ড লোন) ঋণ, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ। রয়েছে অনেক লুক্কায়িত খেলাপি ঋণ। ভীষণ চিন্তার বিষয়। ৫২-৫৩ বছর ব্যাংকিং ব্যবসার একটা পরিণতি। এটাই কি শেষ পরিণতি? অবশ্যই না। কীভাবে?

বর্তমানের খেলাপি ঋণ যেমন ভীষণ চিন্তার বিষয়, তেমনি চিন্তার বিষয় ভবিষ্যতের খেলাপি ঋণ। ভবিষ্যতের খেলাপি ঋণ মানে কী? ভবিষ্যতের খেলাপি ঋণ মানে হচ্ছে ‘‌খেলাপি’ একটি চলমান প্রক্রিয়া। নানা কারণে ঋণখেলাপির ঘটনা ঘটে। ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয় ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা। আবার ব্যবসায়িক কারণে তারা খেলাপি হয়। এখন অবশ্য একটি নতুন দুটো উপাদান যোগ হচ্ছে বলে মনে হয়। একটা উদাহরণ দিই। ২৪ মার্চের একটা খবর। খবরের শিরোনাম ‘‌ট্রান্সকমের সিইওসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা’। খবরের প্রকাশ এখানে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এর আগে একই ‘‌গ্রুপে’ প্রতারণা, জালিয়াতি ইত্যাদি অভিযোগের আরো তিনটি মামলা হয়েছে। মামলাগুলো নিজেদের মধ্যে—ভাই-বোন, মায়ের মধ্যে। দৃশ্যত এ খবরে সাধারণ পাঠকের কোনো মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। এটা নিতান্তই পারিবারিক বিষয়—নিজেদের মধ্যকার বিবাদ। কিন্তু এখানে ইস্যু দুটি: প্রথমত, ‘‌ট্রান্সকম গ্রুপ’ বাংলাদেশের বিশাল একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। এর সমস্যা ব্যবসার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, রয়েছে ব্যাংকের কথা। আমরা জানি না তাদের ঋণের তথ্য। এত বড় গ্রুপ। ধারণা করা যায় তাদের ব্যাংক ঋণ আছে। থাকলে ভালো পরিমাণেই আছে। না থাকলে তো বাঁচোয়া। কিন্তু থাকলেই ব্যাংকগুলোর মাথাব্যথা। এ ব্যবসায়ী গ্রুপে যদি সমস্যার সৃষ্টি হয়, যদি ব্যবসার অবনমন ঘটে, তাহলে ব্যাংক ঋণের কী হবে? যথেষ্ট বন্ধকি সম্পত্তি আছে তো? থাকলে হবে কী—এর দায়দায়িত্ব কে নেবে? হাজার সমস্যা সম্পত্তি ও দায়দেনার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে সৃষ্টি হতে পারে খেলাপি সমস্যা। শুধু ‘ট্রান্সকম গ্রুপ’ নয়, বণিক বার্তায়ই ১৪ মার্চে একটি দুশ্চিন্তার খবর প্রকাশ হয়। দুশ্চিন্তার বিষয় ব্যাংকারদের জন্য। ওই খবরে দেখা যাচ্ছে, অন্তত পাঁচটি বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপে ভাঙন ধরেছে। মালিকদের মধ্যে বিবাদ, অংশীদারদের মধ্যে বিবাদ। সহায়-সম্পত্তি, ব্যবসা, দায়-দেনা নিয়ে বিবাদ। পারিবারিক ব্যবসায় যা হয়। ‘হস্তান্তর, উত্তরাধিকার, পরিকল্পনা, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা, পেশাজীবীদের মধ্যে কার কী ভূমিকা’ ইত্যাদি বিষয় নিয়েই বিবাদ। বলাই বাহুল্য, এসব খুবই বড় ‘গ্রুপ’। এদের ব্যবসা-বাণিজ্য হাজার হাজার কোটি টাকার। আমদানি ও রফতানি প্রচুর। লাখ লাখ লোক এসবে চাকরি করে সংসার চালায়। সরকারের রাজস্বেও তাদের অবদান আছে। আরো বলা বাহুল্য যে এদের প্রত্যেকেরই বিশাল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ আছে। ব্যাংকাররা ‘ভালো’ গ্রুপ বলে ‘দেদারছে’ তাদের ঋণ দিয়েছে—অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক বিবেচনা না করেই। এখন প্রশ্ন এসব গ্রুপ যদি ভাঙে, ব্যবসা ভাঙে, বিঘ্নিত হয় তাহলে ব্যাংক ঋণের কী হবে? এখানে কি খেলাপি ঋণের বিশাল ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে না? মুশকিল হচ্ছে, শুধু এ হাউজগুলোই নয়, অনেকদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে, অনেক বড় হাউজ ধসে পড়ছে। সিনহা গ্রুপ এর মধ্যে একটি। তারা খেলাপি ছিল। কারখানা ছিল বন্ধ। কারখানা কিনে নেয়ার মতো কোনো ক্রেতা নেই। বিদেশী ক্রেতাও পাওয়া যায়নি। এত সম্পদ এত দেনা নিয়ে কেউ এগোতে চায় না। রয়েছে চট্টগ্রামের অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী প্রুপ। একসময়ে তারা হাজার হাজার কোটি টাকার আমদানি ব্যবসা, ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা করত। টাকা বানিয়ে নানা খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। ওইসব পুরনো ব্যবসার অনেক মালিক প্রয়াত হয়েছেন। ছেলেমেয়ে-স্ত্রীদের মধ্যে এখন বিবাদ। অনেকে দেশের বাইরে। অনেকে ব্যবসা জানে না। ব্যবসা করে না। কিন্তু সম্পদ ভোগ করছে। শতশত মামলা চট্টগ্রামে। কবে এসবের ফয়সালা হবে কেউ জনে না। বন্ধকি সম্পত্তি আছে তো? থাকলেই কী, ব্যাংকের সম্পত্তি আদালতের মাধ্যমে কেউ কিনতে চায় না। দরদাতা পাওয়া যায় না। পেলেও সম্পত্তির দাম এক-তৃতীয়াংশও হয় না। কে জানে এক চট্টগ্রামেই এসব কারণে কত শতশত হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপির ঘটনা ঘটবে। এ ঘটনা সারা দেশেই।

পুরনো দিনের বড় বড় ব্যবসার মধ্যে অনেকগুলো বিলীন হয়েছে। পাকিস্তান আমলের বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ আজ আর সেভাবে নেই। ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক অবজার্ভার’, ‘দৈনিক পূর্বদেশ’, এরপ গ্রুপ, একে খান গ্রুপ, মহসিন গ্রুপসহ রয়েছে ডজন ডজন উদাহরণ। কেউ বিলুপ্ত। কেউ কোনো মতে টিকে আছে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে ব্যাংক ঋণ নিয়ে। যেমন ইসলাম গ্রুপ। বিশাল একটি গ্রুপ। পাকিস্তান আমলের শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ী গ্রুপ। এ গ্রুপের ব্যবসা ভাইদের মধ্যে ভাগাভাগি হয় অনেকদিন আগে। কেউ টিকে আছেন। আবার তাদের একটি অংশ আজ দিশেহারা। ব্যাংক ঋণ নিয়ে হাবুডাবু খাচ্ছে। নানা গুজব তাদের নিয়ে। মাঝারি ধরনের অনেক ব্যবসায়ী, সফল ব্যবসায়ী আছেন যাদের অনেকেই আজ মৃত। অথচ ছেলেমেয়েরা ব্যবসায় নেই। দায়দায়িত্ব নিতেও রাজি নয়। কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসা। চামড়া ব্যবসাতেও একই সমস্যা। পাটের ব্যবসাতেই একই সমস্যা। সর্বত্রই ব্যাংকের সঙ্গে ঋণের সমস্যা। তফশিল, পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফ চলছে। নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে অবিরাম। এই তো সেদিন দেখলাম ইস্পাত ও লৌহ ব্যবসায়ীদের দুঃখ-কষ্টের ওপর একটা স্টোরি। বড় বড় মেগা প্রকল্পের কাজে টান পড়ায় তাদের চাহিদা কমে গেছে। অনেকেই পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। ডলার নেই। আমদানি বিঘ্নিত। 

ব্যাংকের সুদের হার অনেক বেড়েছে। তারা এখন বাঁচতে চান। স্বল্পমেয়াদি ঋণকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তর করতে চান। নানা সুবিধা চান। না হলে হয়ে যেতে পারেন ঋণখেলাপি, এমনিতে ইস্পাত, লোহা, সিমেন্ট, চিনি ইত্যাদি খাতে তৈরি হয়ে আছে ‘অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি’। চাহিদার অভাবে পুরো উৎপাদন করা যাচ্ছে না। খেলাপি হয় হয় অবস্থা। বিশাল বিশাল পরিমাণের ঋণ। হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ তাদের একেকজনের। মোদ্দা কথা ৫২-৫৩ বছর বেপরোয়া ব্যাংকিংয়ের ফল এখন পাওয়া শুরু হয়েছে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এসব খেলাপি ঋণ, সম্ভাব্য খেলাপি ঋণ থেকে বাঁচার জন্য ছোট ব্যাংক ও বড় ব্যাংক এক করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে কি সমস্যার সমাধান হবে? বিরাট প্রশ্ন। প্রশ্ন আরো গভীর—কারণ বড় বড় হাউজের অনেকেই দেশ থেকে সব টাকা পাচার করে নিয়ে গেছে। তারা দুবাই, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় ব্যবসা করছে। বেশ বড় বড় ব্যবসা। শোনা যায়, কেউ কেউ নাকি চীনেও কারবার করছে, ভিয়েতনামেও করেছে। কীভাবে? এর কোনো উত্তর নেই। সরকারিভাবে ডলার নিয়ে বিদেশে কিছু করা যায় না বাংলাদেশের ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া। দেখা যাচ্ছে, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। যাক এ সমস্যা, ইদানীং মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন একটি বিষয়। অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে কারো ব্যবসা বাড়ছে, কারো ব্যবসা নষ্ট হচ্ছে। যেমন পদ্মা ব্রিজ। বিশাল ঘটনা। এর ফলে দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ দৃঢ় হয়েছে। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হারে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর হয়েছে বিপদ। খেলাপি ঋণের ঝুঁকি তাদের বেড়েছে। ঢাকা-বরিশাল অঞ্চলের মধ্যে চলাচল করত শতশত জাহাজ। একতলা, দুতলা, তিনতলা, চারতলা সব বিশালাকার জাহাজ, লঞ্চ, বিশাল ব্যবসা। কিন্তু এখন তাদের ব্যবসা নেই। অর্ধেক ব্যবসাও নেই। তারা এখন ‘রোটেশনে’ জাহাজ চালায়। ব্যাংকের কাছে তাদের দাবির শেষ নেই। অনেক মালিক খেলাপি হচ্ছেন। কোনো মতে ঠিক থাকার চেষ্টা করছেন। সর্বশেষ সমস্যা দেখা দিয়েছে বাস ব্যবসা নিয়ে। বাসের মালিকরা চুটিয়ে ব্যবসা করছিলেন। টঙ্গী, উত্তরা থেকে ঢাকার কেন্দ্রবিন্দুতে চলত শত শত বাস। যাত্রীবোঝাই বাস। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর তাদের ব্যবসায় ছেদ পড়েছে। ব্যবসা এক-তৃতীয়াংশ কমছে। এ ব্যবসায় রয়েছে প্রচুর ব্যাংক ঋণ। ব্যবসা কমলে, বন্ধ হলে ব্যাংক ঋণের টাকার কী হবে? দুশ্চিন্তা ব্যাংকারদের। তাহলে কী দেখা যাচ্ছে। যে খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধানে ‘মার্জার’ আসছে, সেই খেলাপি ঋণের ঝুঁকি দিনদিন বাড়ছে। বাড়বে। চলমান এ সমস্যার সমাধান কী? ‘মার্জার অব ব্যাংকস’ কী এর সমাধান দেবে?

ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

আরও