ট্যুরিজম ক্লাব

পাহাড়ের সৌন্দর্যের খোঁজে...

ভাই আর পারছি না! আর কতক্ষণ! অংশৈই খিয়াং প্রতিবারের মতো এবারো উত্তর দিলেন, এই তো দাদা চলে আসছি। এই পাড়াটা পার হলেই থুইস্যাপাড়া। ১৫ বারেরও অধিক একই কথা বললেন। কেউ আর তাকে বিশ্বাসই করছে না। সবাই এরই মধ্যে বুঝে গেছে তার মুখের পাঁচ মিনিট মানে আধা ঘণ্টা। কিন্তু কিছু করার নেই, সামনে এগোতেই হবে। গহিন ও প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

ভাই আর পারছি না! আর কতক্ষণ! অংশৈই খিয়াং প্রতিবারের মতো এবারো উত্তর দিলেন, এই তো দাদা চলে আসছি। এই পাড়াটা পার হলেই থুইস্যাপাড়া। ১৫ বারেরও অধিক একই কথা বললেন। কেউ আর তাকে বিশ্বাসই করছে না। সবাই এরই মধ্যে বুঝে গেছে তার মুখের পাঁচ মিনিট মানে আধা ঘণ্টা। কিন্তু কিছু করার নেই, সামনে এগোতেই হবে। গহিন ও প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। আর পেছনে ফেরার কোনো সুযোগও নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিস্ট ক্লাবের প্রতি মাসের ইভেন্টের মতো এ ইভেন্ট ছিল আমিয়াখুম নাফাখুম রেমাক্রি ফলস ট্যুর। এ ট্যুরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ট্যুরিস্ট ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মৃণাল রায়। 

আমিয়াখুম নাফাখুমের জলপ্রপাতের সঙ্গে শাড়ি পরে ছবি তোলা বর্তমানে মেয়েদের কাছে সেরা একটি জায়গা। শাওলি, তৃষা, তিতির ট্যুরিস্ট ক্লাবের অন্যতম সদস্য। শাওলি ও তিতির মৃণালের বড় আপু এবং তৃষা বন্ধু। তারা প্রায় মৃণালকে বলত আমিয়াখুমে একটা ট্রিপ দেয়ার জন্য। তাদের অনুরোধে ট্রিপটির আয়োজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন ঝামেলার পর শেষমেশ ১৪ জন হয়ে গেল ট্যুরে যাওয়ার জন্য। ১৪ জন সুন্দর একটা দল। অতঃপর ২০ ফেব্রুয়ারি রওনা রাজশাহী থেকে নাটোর স্টেশনে। আমির, মাহিন, কাওছার ভাই, ওসমান গনি ভাই, অনিক দা, পাপন দাসহ সবাই নাটোর স্টেশনেই একত্র হন। সেখান থেকে সবাই একসঙ্গে ট্যুরের উদ্দেশে রওনা দেন।

পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টায় বাস। সবাইকে চকরিয়ায় নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে আবার যাওয়া লাগে আলিকদম। আলিকদমে সকালের নাশতা করে আগে থেকে রিজার্ভ চান্দের গাড়িতে রওনা এবার থানচির উদ্দেশে। আলিকদম থেকে থানচির দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। থানচি সদর থেকে সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে সবাই ঘাটে এসে উপস্থিত। ঘাটে ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলোয় পাঁচজন করে ওঠা যায়। সেগুলো ঘাটেই অপেক্ষা করছিল। তিনটি নৌকা নিয়ে পুরো দল রওনা পদ্মঝিরির উদ্দেশে। থানচি থেকে পদ্মঝিরি নৌকা, যেতে মোটামুটি দেড় ঘণ্টার পথ। সাঙ্গু নদীর পাড়ের পাহাড়ি বাড়িগুলো ও মাচাংয়ের ঘরগুলো কী সুন্দর লাগে তা বলতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেললেন মৃণাল। মৃণাল বললেন, ‘‌পাথুরে স্বচ্ছ সাঙ্গুর স্রোতের বিপরীতে নৌকা চলতে থাকল। যখন দুই-এক ফোঁটা জল গায়ে এসে লাগে, মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ যেন এখানেই।’

পদ্মঝিরিতে নৌকা সবাইকে নামিয়ে দিল, তখন বেলা দেড়টা। ২টার সময় দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই পদ্মমুখ হয়ে থুইস্যাপাড়ার উদ্দেশে আবার রওনা। থানচি থেকে দুই পথে আমিয়াখুম যাওয়া যায়। প্রথম পথে শুধু পদ্মঝিরিতেই প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা ট্র্যাকিং করতে হয় এবং অনেক সময় রাতের বেলায়ও ট্র্যাকিং করতে হতে পারে।

পদ্মমুখ হয়ে থুইস্যাপাড়া প্রায় ৭ ঘণ্টার ট্র্যাকিং। অনেক কঠিন পথ। পাহাড়ি ঝিরি, কাদাময় রাস্তা, এক পাড়া থেকে আর এক পাড়া। পাহাড়ি রাস্তা, খুম, নদী কী নেই এই রুটে। ৪ ঘণ্টা হাঁটার পর বিকাল তখন শেষ প্রায়। ট্যুর গাইড বলল পাশের এ পাহাড়টাই তাজিংডং, সঙ্গে যে খাড়া পাথুরে পাহাড়, সেটা দ্যোতং পাহাড়। টিমের মধ্যে মাহিন একটু স্বাস্থ্যবান ও শরীরটা ভারী। সঙ্গে ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় কোথাও যায় না, বেশি মানুষের সঙ্গে কথাও বলে না সে। কিন্তু ক্লাবের গত কয়েকটা ট্রিপে মাহিন সবসময় মৃণালের সঙ্গে যাচ্ছে। কারণ সে যতটা মজা পাচ্ছে, ততটা শিখছে, নিজেকে একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে। বদ্ধ জগৎটার বাইরে গিয়ে পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করছে। সে বেচারা বারবার বলেই যাচ্ছে মৃণাল ভাই আর পারব না। কোনোভাবেই না। তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এরই মধ্যে ৫ ঘণ্টা ধরে হাঁটিয়েছে গাইড ও মৃণাল। পরে ট্র্যাকিং সু শেষ পর্যন্ত রাস্তায় রেখেই অংশৈই খিয়াং দা তার ব্যাগ ও হাত ধরে রওনা দিলেন থুইস্যাপাড়ার উদ্দেশে। 

রাত তখন ৮টা। দীর্ঘ ২৮ ঘণ্টা শেষে সবাই ক্লান্ত দেহ নিয়ে পৌঁছাল থুইস্যাপাড়াতে। মাচাং ঘরে একটা রুমে ব্যাগগুলো রেখে রাতের খাওয়া শেষে সবাই ঘুমাতে গেল। আগামীকাল সকাল ৬টায় উঠতে হবে। সকালে অনেক কুয়াশা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কিন্তু এ ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে সবাই ডিম-খিচুড়ি খেয়ে রওনা দিল দেবতাপাহাড় হয়ে আমিয়াখুম, সাতভাইখুম, ভেলাখুমের উদ্দেশে। রুমে মাহিন শুয়েই থাকল। তার পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব না। বিজয় দাদা ভাঙা পা নিয়ে সবার সঙ্গে চলা শুরু করলেন। মৃণালের জীবনে বন্ধুত্বের সেরা উদাহরণ হলো বিজয় দাদা, ওসমান গনি ভাই ও বাপ্পি ভাইয়ের বন্ধুত্ব। সেই অনেক বছর আগে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ। কিন্তু তাদের সম্পর্ক, যোগাযোগ, কোনো কমতি নেই। না দেখলে এটা বোঝানো সম্ভব না যে তাদের বন্ধুত্ব কী দারুণ।

কিন্তু বিজয় দা ভাঙা পা নিয়ে দেবতাপাড়ায় উঠে আর নামার শক্তি পেলেন না। কেননা ১৫০০ ফুট উঁচু এ দেবতাপাড়ার পুরো ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। নিচে সেই আমিয়াখুম, সাতভাইখুম, ভেলাখুম। একটা দোকানে বিজয় দা, বাপ্পি ভাইকে রেখে দেবতাপাহাড় নামা শুরু করা হলো। দেবতাপাহাড় নামতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগল। তারপর যা দৃশ্য! পরান জুড়িয়ে গেল সবার। সেই কাঙ্ক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ।

বেলা ৩টায় থুইস্যাপাড়ায় ফিরে দুপুরের খাবার খাওয়া শেষে পরের গন্তব্য নাফাখুমপাড়া। রাত ৮টায় সবাই পৌঁছে নাফাখুমপাড়ায়। তখন পূর্ণিমায় চাঁদের আলোয় পুরো পাড়া আলোকিত। বাগানবিলাসের গাছগুলো ফুলে পরিপূর্ণ ছিল। সেই রাতটা। সেখানের রাতটা মৃণালের জীবনের সেরা একটা রাত ছিল। জলপ্রপাতের পানির শব্দ, চা আড্ডা আর ক্যাম্পফায়ারে কত গান, গল্পে মেতে উঠেছিল সবাই।  কখন যে রাত ২টা বেজেছে কেউ টেরই পাইনি।

পরের দিন সকালে খিচুড়ি-ডিম ভুনা খেয়ে রেমাক্রি ফলসের দিকে চলে যাই পুরো টিম এবং সেখান থেকে নৌকা করে থানচিতে পৌঁছাই। রেমাক্রি টু থানচি আড়াই ঘণ্টার জার্নিটা ছিল মনে রাখার মতো। সাঙ্গু নদীকে বুঝি এজন্য  বাংলাদেশের সব থেকে সুন্দর নদী বলা হয়। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা, পাথুরে নদী, আর সাঙ্গু পারের মানুষের জীবন এ এক দৃষ্টিনন্দন ছবির মতো। অতঃপর থানচিতে এসে নেটওয়ার্ক পাওয়ার পর সবাই নিজের মতো বাসায় কথা বলতে শুরু করে। এ ভ্রমণের সময়টা জীবনের সেরা কাটানো সময়গুলোর একটা ছিল মৃণালের কাছে। পাহাড়ের কী মায়া, কী সৌন্দর্য, আদিবাসীদের জীবন, কত কাছ থেকে দেখা—গল্পের পর গল্প বললেও যেন শেষ হবে না। 

আরও