অর্থ নেই, পাইপলাইন নেই, বাড়তি এলএনজি কেনাবেচার চুক্তি হয়ে যাচ্ছে

জাতীয় গ্রিডে এলএনজির সরবরাহ বাড়াতে ২৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পাইপলাইন (মহেশখালী/মাতারবাড়ী-বাখরাবাদ) নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ প্রকল্প এখন পরিকল্পনা কমিশনে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৪০ কোটি ডলার। এ অর্থের উৎস নিয়ে এখনো নিশ্চিত নয় সরকার। যদি চলতি বছরও কাজ শুরু হয়, পাইপলাইন নির্মাণ শেষ হতে সময় লেগে যাবে অন্তত ২০২৯ সাল। পাইপলাইন বা

জাতীয় গ্রিডে এলএনজির সরবরাহ বাড়াতে ২৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পাইপলাইন (মহেশখালী/মাতারবাড়ী-বাখরাবাদ) নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ প্রকল্প এখন পরিকল্পনা কমিশনে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৪০ কোটি ডলার। এ অর্থের উৎস নিয়ে এখনো নিশ্চিত নয় সরকার। যদি চলতি বছরও কাজ শুরু হয়, পাইপলাইন নির্মাণ শেষ হতে সময় লেগে যাবে অন্তত ২০২৯ সাল। পাইপলাইন বা অর্থের জোগান নিয়ে নিশ্চিত না হলেও এরই মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি তিনটি এলএনজি সরবরাহ চুক্তি সই করেছে পেট্রোবাংলা। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এলএনজি আমদানি ও পাইপলাইনের কাজে সমন্বয় না থাকলে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে পেট্রোবাংলাকে।

পেট্রোবাংলার নতুন ও অপেক্ষমাণ চুক্তিগুলোর আওতায় ২০২৬ সাল নাগাদ দেশে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন টন অতিরিক্ত এলএনজি আসার কথা রয়েছে। এ পরিমাণ এলএনজি আনতে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার গুনতে হবে সংস্থাটিকে। যদিও এমন এক সময় এসব চুক্তি করা হচ্ছে, যখন সংস্থাটি বিদ্যমান চুক্তির আওতায়ই এলএনজি আমদানির অর্থ সংস্থান করতে পারছে না। আমদানির অর্থ পেতে কখনো গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ), আবার কখনো বিদেশী ঋণের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। এলএনজি আমদানিতে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান ও পরিকল্পিতভাবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণকেই এখন পেট্রোবাংলার বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও। 

যদিও সংস্থাটির দাবি, নতুন চুক্তিগুলোর আওতায় দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হলে তা বিদ্যমান পাইপলাইন দিয়েই সরবরাহ করা যাবে। পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান দাবি করেন, ‘এলএনজি সরবরাহের বিদ্যমান পাইপলাইনের সক্ষমতা ১ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত। বর্তমানে দুটি ভাসমান টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে ৭৫০-৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ হচ্ছে। নতুন এলএনজি আমদানিতে যে চুক্তি হয়েছে, সে গ্যাস এ পাইপলাইনে সরবরাহ করবে পেট্রোবাংলা। এলএনজি ল্যান্ড বেজ টার্মিনালের জন্য একটি পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটির ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ হয়েছে। এ পাইপলাইন নির্মাণ শেষ হলে চুক্তির এলএনজি পূর্ণ মাত্রায় সরবরাহ করা সম্ভব হবে।’

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এলএনজি আমদানির কার্যক্রম বাড়াতে গত বছরের জুনে দৈনিক ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। কক্সবাজারের মহেশখালীতে জ্বালানি খাতের স্থানীয় কোম্পানি সামিট গ্রুপের এ টার্মিনাল নির্মাণের কথা। এটি নির্মাণের কার্যক্রম এখনো চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সামিট গ্রুপের পরিচালক ফয়সাল খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বর্তমানে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য আমরা টিইউএ (টার্মিনাল ইউজ এগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছি।’

এছাড়া মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির পটুয়াখালীর পায়রায় আরেকটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণের কথা রয়েছে। দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার এ টার্মিনাল নির্মাণে এখনো পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি সই করতে পারেনি কোম্পানিটি। যদিও এরই মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি সরবরাহের জন্য নতুন করে জিটুজির আওতায় দুটি এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে ফেলেছে পেট্রোবাংলা। অপেক্ষমাণ রয়েছে বেসরকারি খাতে এলএনজি আমদানিতে আরেকটি নতুন চুক্তি। ওই চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি শুরু হতে পারে ২০২৬ সাল নাগাদ। আমদানির প্রক্ষেপণের হিসাব অনুযায়ী, তখন জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ হওয়ার কথা দৈনিক ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

দেশে বৃহদায়তনে এলএনজি সরবরাহের জন্য বড় সক্ষমতার কোনো পাইপলাইন নেই। এলএনজি আমদানিকে ঘিরে নতুন যে পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটিও চালু হতে সময় লাগবে অন্তত ২০২৯ সাল। এখনো এ প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদন হলেও এর অর্থায়ন কীভাবে আসবে সেটিও এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারেনি সঞ্চালন কোম্পানি গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)।

এ বিষয়ে জিটিসিএলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এলএনজি সরবরাহে বৃহৎ একটি প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) এরই মধ্যে নীতিগত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদনের পর বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছে ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হবে।’

জিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ২৯৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মহেশখালী/মাতারবাড়ী-বাখরাবাদ পাইপলাইনটি নির্মাণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। মূলত মহেশখালীর ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের সঙ্গে সমন্বয় করে এ পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার এ টার্মিনাল নির্মাণের ক্ষেত্রেও এখন পর্যন্ত শুধু প্রয়োজনীয় জমিসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা গেছে। 

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার ও আরপিজিসিএলের দুই কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌দেশের বিদ্যমান পাইপলাইন দিয়ে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক সর্বোচ্চ দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব। গ্যাসের আমদানি বাড়লে বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়ে তা যথাযথভাবে সরবরাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

গ্যাসের সরবরাহ সংকট কাটাতে এরই মধ্যে সরকার তিনটি দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে গত বছরের জুনে ওমানের ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেডের (ওকিউটি) সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, দেশটি থেকে বছরে আমদানি হবে দশমিক ২৫ মিলিয়ন টন থেকে সর্বোচ্চ দেড় মিলিয়ন টন এলএনজি। ১০ বছর মেয়াদি এ চুক্তির আওতায় ওমান থেকে কার্গো আমদানি শুরু হবে ২০২৬ সালে।

গত বছরের জুনে কাতার এনার্জি ট্রেডিং এলএলসির সঙ্গে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে পেট্রোবাংলা। ১৫ বছর মেয়াদি এ চুক্তির আওতায় বছরে দেড় মিলিয়ন টন এলএনজি কিনবে পেট্রোবাংলা। 

গত বছরের ৮ নভেম্বর মার্কিন বেসরকারি খাতের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে সংস্থাটি। চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন কোম্পানিটি বছরে এক মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহ করার কথা। এ সরবরাহ শুরু হবে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে। 

এছাড়া দেশীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি সামিট গ্রুপের সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় বছরে আরো দেড় মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহ পাওয়ার কথা রয়েছে। এর আওতায় সরবরাহ শুরু হবে ২০২৬ সালের অক্টোবরে। এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে সম্প্রতি সামিটের পক্ষ থেকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে নিশ্চিত করা হয়েছে।

বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি দুটি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আনছে পেট্রোবাংলা। চুক্তিগুলোর আওতায় দেশ দুটি থেকে বছরে চার মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির সুযোগ রয়েছে। নতুন চারটি চুক্তি সই হলে আসবে আরো সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন টন। তবে ২০২৬ সালে ওমানের সঙ্গে বিদ্যমান চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে বছরে সাড়ে আট মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি হবে।

বর্তমানে দেশে আমদানীকৃত এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের জন্য দেশে ভাসমান টার্মিনাল আছে দুটি। সামিট ও এক্সিলারেটের মালিকানাধীন টার্মিনাল দুটি থেকে দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা। তবে এ সক্ষমতা এখন ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট (সংস্কারের মাধ্যমে এক্সিলারেটের টার্মিনালটির দৈনিক সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট)। 

জানা গিয়েছে, টার্মিনালের নকশা অনুযায়ী দুটি এফএসআরইউ সরবরাহ সক্ষমতা দৈনিক ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও গ্যাসের স্বল্পচাপের কারণে এ ধরনের ক্যাপাসিটিতে কখনোই গ্যাস সরবরাহ করা যায়নি।

এলএনজি আমদানি ঘিরে সরকারের নতুন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ‌পণ্যটি আমদানির জন্য অর্থের যথেষ্ট জোগানের পথ এখনো সুনিশ্চিত নয়। আবার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াই চুক্তি সইয়ের কারণে সামনের দিনগুলোয় তা বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠার জোর আশঙ্কা রয়েছে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এলএনজি আমদানি চুক্তির সঙ্গে সরবরাহ সক্ষমতাটিও জরুরি। বিশেষ করে দেশে যখন থেকে এলএনজি আমদানির কথা বলা হচ্ছে, সে সময় টার্মিনালগুলো প্রস্তুত করা যাবে কিনা, সেটাও দেখার বিষয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাবরই দেখা গেছে প্রকল্পের কাজের সঙ্গে সমন্বয় থাকে না। যে কারণে ক্যাপাসিটি বসিয়ে রাখতে হয়, যেমনটি বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এমনটি হলে চুক্তির আওতায় বড় অংকের অর্থ গুনতে হয়। এতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।’

দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হলেও সমন্বয়হীনতার কারণে বড় এ খাতের অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য পাচ্ছে না। বিশেষ করে মেঘনাঘাটে তিনটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও গ্যাসের পাইপলাইনের অভাবে এসব কেন্দ্র প্রায় বছরখানেক ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া গ্যাসের দীর্ঘ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করেও দেশের দক্ষিণাঞ্চল খুলনায় গ্যাস দেয়া যায়নি। বড় পরিসরে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না রংপুর, বগুড়া ও সৈয়দপুরে।

প্রসঙ্গত, দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয় ২০১৮ সালের এপ্রিলে। এ আমদানি কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) মাধ্যমে। আর জ্বালানি বিভাগের উইং হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য দেখা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্টের পর থেকে গত জুন পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ২ বিসিএফের কিছু বেশি এলএনজি আমদানি হয়েছে। এ এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে আর্থিক ও দায়দেনার চাপ বেড়েছে পেট্রোবাংলার। প্রায় দেউলিয়াত্বের কাছাকাছি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে এক সময়ের লাভজনক কোম্পানিটি। বৈদেশিক মুদ্রা ও অর্থের সংকটের কারণে বিভিন্ন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ও গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। এমনকি এলএনজি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর কাছেও বিভিন্ন সময় বকেয়া জমেছে সংস্থাটির। 

আরও