বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি স্টার’ গত ১৭ জানুয়ারি প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইনে খবর প্রকাশ করেছে যে দেশের বৈদেশিক ঋণের বার্ষিক সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ তিন বছরে ৬৩ শতাংশ বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ দাঁড়াবে ৪ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও এআইআইবির মতো আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থার পাশাপাশি জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারত এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের অন্যতম প্রধান সূত্রে পরিণত হয়েছে। ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ২০২৫ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার কথা থাকলেও এরই মধ্যে এ ঋণের বার্ষিক সুদ ৩৩০ মিলিয়ন ডলার ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকেই পরিশোধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে। তখন ঋণের বার্ষিক কিস্তি পরিশোধ করতে হবে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৫৩১ মিলিয়ন ডলার, ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৫১৯ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৮-২৯ অর্থবছরে ৫০৭ মিলিয়ন ডলার। অতএব বলা চলে, ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে যেভাবে ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ গ্রহণের হিড়িক চালিয়েছে তার ফলে ২০২৮-২৯ অর্থবছর পর্যন্ত সুদাসলে ঋণের কিস্তি পরিশোধ অর্থনীতিতে বিপদ ডেকে আনতে যাচ্ছে।
এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে নানা খামখেয়ালি প্রকল্পে যথাযথ ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ছাড়া বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের কারণে বাংলাদেশ উচ্চ ঋণগ্রহণকারী দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। দৈনিক বণিক বার্তা গত ৫ ডিসেম্বর খবর প্রকাশ করেছে যে ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এর মানে, সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণের বর্তমান স্থিতি দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। ওই পর্যায়ে বিদেশী ঋণ ছিল জিডিপির ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ওই সময় বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পর থেকে বিদেশী ঋণ গ্রহণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে উচ্চ হারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরেও বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও এরপর দ্রুত বিদেশী ঋণ বাড়তে থাকে, পাঁচ বছরে বেসরকারি খাতের ঋণ ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। ২০২৩ সালের জুনে বেসরকারি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
ওপরে বৈদেশিক ঋণের যে চিত্র দেয়া হয়েছে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রক্ষেপণকে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। এ প্রক্ষেপণ কতখানি অবাস্তব সরলীকরণ ছিল সেটা সত্যিকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক প্রমাণ করে দিয়েছে। আমাদের সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে এ ধরনের প্রক্ষেপণের যে কোনো মূল্য নেই তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ খামখেয়ালিভাবে গৃহীত নানা প্রকল্পে ইচ্ছামতো বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক, যার মাধ্যমে তিন বছরের মধ্যেই বিদেশী ঋণকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উল্লম্ফন করানো হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আরো দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতি সামান্য অংশ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। বাকি অর্থ জনগণের ওপর দীর্ঘমেয়াদি বোঝা হিসেবে চেপে বসবে।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখনো ‘সফট লোন’ পাওয়া গেলে আমরা নিতে আগ্রহী হই, কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই এখন সাপ্লায়ারস ক্রেডিট। সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের অসুবিধা হলো জোগানদাতারা প্রকল্পের প্লান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার দামের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চেয়ে বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরো গুরুতর হলো, সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে। সেজন্য সাপ্লায়ারস ক্রেডিটকে লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত মেকানিজম অভিহিত করা হয়। দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট শাসক মহলের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সবচেয়ে মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সেজন্য বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে যাচ্ছে, কারণ এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি লুণ্ঠন এখন শাসক দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের লোভনীয় ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে যেহেতু তাদের অনেক কঠিন শর্ত পরিপালনে শাসকরা জটিলতার সম্মুখীন হন তাই বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সরকার প্রধানত সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে। বিশেষত, গত পাঁচ বছর বেলাগামভাবে অনেকগুলো অত্যন্ত বাজে প্রকল্পে ঋণ গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিকটু আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি লুণ্ঠনই যে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেটা আন্দাজ করা যায়।
চীন যেহেতু এখন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উদারভাবে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট দেয়ার নীতি বাস্তবায়ন করছে তাই চীনের সাপ্লায়ারস ক্রেডিট পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত চীন থেকে মোট ১ হাজার ৮৫৪ কোটি ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ চীন থেকে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট নিয়ে মোট ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। চীনা সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে যেসব মেগা প্রকল্প এ দেশে বাস্তবায়ন হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সেগুলো হলো পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর-পায়রা রেলপথ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প। জাপানের জাইকার সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে অর্থায়িত যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সেগুলো হলো ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, যমুনা রেলসেতু এবং চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড। ঢাকা-যশোর রেলপথ এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প। কিন্তু বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’। অনেকেরই জানা নেই যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে ২ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ আমাদের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? এত বেশি ‘ইনফ্লেটেড প্রজেক্ট কস্ট’ দেখিয়ে রাশিয়া কি বাংলাদেশের বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে? বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উচ্চ মার্জিন কি এর জন্য দায়ী? (অথচ সৌরবিদ্যুতে রূপপুরের অর্ধেক খরচে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত)!
স্বল্প প্রয়োজনীয় প্রকল্পে যথাযথ ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া খামখেয়ালিভাবে বিনিয়োগের হিড়িকের ব্যাপারে আমি আপত্তি জানানোয় প্রধানমন্ত্রী ব্যঙ্গ করে আমাকে ‘অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের মে মাসে জার্মান টিভি ডয়চে ভেলে আমাকে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলায় আমি বলেছিলাম, ‘২০১২ সালে যখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করেছিল তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আমিই প্রথম তাকে সমর্থন জানিয়েছিলাম নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য। আবার তার হাত থেকেই আমি একুশে পদক নিয়েছি। এখন তিনি আমাকে অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ বলছেন! তা তিনি বলতেই পারেন, কিন্তু আমি আমার অবস্থান বদলাব না’। আমার এ সাবধান বাণীকে আমলে না নেয়ার ফলে এখন যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে তা সামাল দিতে পারছে না সরকার। গত ১২ ডিসেম্বর আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৬৯ কোটি ডলার পাওয়ায় এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৪০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ায় রিজার্ভ কয়েকদিনের জন্য ২১ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পাওনা মেটানোর পর রিজার্ভ আবার ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে গেছে। দেশের ‘নিট রিজার্ভ’ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম। রিজার্ভের এ পতনের ধারাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলতেই হবে। কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙ্গা হওয়ায় ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গত আগস্টে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আগের বছরের আগস্টের চেয়ে ২১ শতাংশ কমে গেছে, সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪ দশমিক ৩৬ কোটি ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অবশ্য অক্টোবরে ১৯৭ দশমিক ৭৫ কোটি ডলার, নভেম্বরে ১৯৩ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স ফরমাল চ্যানেলে দেশে এসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে উচ্চকণ্ঠে বলেছেন রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছুই নেই, আমাদের নাকি প্রায় ছয় মাসের আমদানি বিল পরিশোধের সক্ষমতা রয়েছে। এখন আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রকৃতপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ১৩ লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে গেছে। দেশের ১ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ বিদেশে অভিবাসী থাকলেও তাদের অধিকাংশই হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই এ সমস্যার সমাধান মিলবে না, কারণ হুন্ডি ডলারের চাহিদা কাঠামো শক্তিশালী থাকলে বাজারে ডলারের দাম যতই থাকুক হুন্ডি পদ্ধতিতে ডলারের দাম তার চেয়ে ৭-৮ টাকা বেশি পাওয়া যাবেই। দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারকারীরাই এই হুন্ডি ডলারের চাহিদাকে শক্তিশালী রাখছে, যেজন্য দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার এখন দেশের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছে। সংখ্যায় দেশ থেকে পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। বাংলাদেশী সমাজের উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের বেশির ভাগের অবস্থান। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে তারা দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করতে বাধ্য হচ্ছে বলা যাবে না। এ দেশে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘এলিট’ গোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থান সত্ত্বেও আরো বেশি সুখ-শান্তির আশায় তারা দেশ ত্যাগে উদ্যোগী হচ্ছেন। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি (উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গার্মেন্টস মালিক), প্রকৌশলী ও রাজনৈতিক নেতা। তাদের বেশির ভাগের বৈশিষ্ট্যগত ‘কমন ফ্যাক্টর’ হলো তাদের সিংহভাগ ‘কালো টাকার মালিক’, ভালো মানের শহুরে সম্পত্তির মালিক কিংবা শিল্প-কারখানা-ব্যবসায়ের মালিক হওয়ায় দেশের ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। আমার সংবাদপত্রের কলামগুলোয় আমি তাদের ‘জাতির এক নম্বর দুশমন’ আখ্যায়িত করে চলেছি। আমি যাদের ‘জাতীয় দুশমন’ অভিহিত করছি তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে কালো টাকার মালিক হয়ে তাদের দুর্নীতিলব্ধ ও লুণ্ঠনকৃত অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা দুবাইয়ে পাচার করছে। এরাই কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে। পুঁজি পাচারই অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে।
ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়