অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক। বরেণ্য চিত্রশিল্পী ও শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান। দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার বিভাগ চালুর পেছনের গল্প, ক্যারিয়ারসহ নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ডিজাইন ইউনিভার্সিটি হিসেবে যাত্রা, পেছনের গল্পটি জানতে চাই...
প্রয়াত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত ছিলেন একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ। তার চারটা পরিকল্পনা ছিল। একটা হলো আমাদের জনসংখ্যাকে কীভাবে জনশক্তিতে পরিণত করা যায়। এতএব টেকনিক্যাল এডুকেশন দরকার। উনি জার্মানি থেকে একটা আইডিয়া পেয়েছিলেন যে ১৭ বছর বয়সে জার্মানিতে সবাই সবার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। কিন্তু আমাদের দেশে তো হচ্ছে না। এর কারণ হলো জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত না করা। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের সম্পদকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়। চামড়া, পাট, বাঁশ, বেত এই যেসব সম্পদ আছে, এ সম্পদগুলোকে কীভাবে ডিজাইন শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়।
দূরশিক্ষণের জন্য তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন এবং আন্দোলনের মতোই আমাদের সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে দূরশিক্ষণকে কীভাবে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া যায়। অনলাইন এডুকেশন আমরা যেটাকে বলি, তিনি অনেক দিন এটাকে চালু রেখেছিলেন। আরেকটি হলো আমাদের কালচারাল এডুকেশন। যে কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হয়েছে শারীরিক শিক্ষা, ফাইন আর্ট, মিউজিক, ডান্স। এসব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভারতে যেতে হতো। আমার যেহেতু চারুকলা ব্যাকগ্রাউন্ড, অতএব চারুকলা থেকে বের হয়ে আমরা যখন গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করতে গেছি তখন এ মোশন গ্রাফিকসের জন্য আমাদের ভারত বা থাইল্যান্ড অথবা চীনের সাহায্য নিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা যদি বাংলাদেশে কম খরচে এ টেকনিক্যাল এডুকেশন আমাদের ছেলেমেয়েদের দিতে পারি, তাহলে তারা দেশে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারবে। এ চার পরিকল্পনা নিয়েই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা।
দুই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন কী?
গার্মেন্ট সেক্টর আগে অনেক বিদেশী কাজ করত। এখন সে সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। আমরা গার্মেটস সেক্টরের এ জায়গায় সাপোর্ট দিতে পারছি। আমাদের শিক্ষার্থী ফ্যাশন ডিজাইনারের নাম গিনেজ বুকে উঠেছে, এটা আমাদের একটা অর্জন। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন বিভিন্ন দেশের ফ্যাশন শোয়ে অংশগ্রহণ করছে। ঢাকা শহরের ব্র্যান্ডেড শপগুলো যে তৈরি হয়েছে এগুলো প্রত্যেকটার ক্ষেত্রে আমাদের অবদান আছে। আড়ংয়ের চিফ ডিজাইনার আমাদের স্টুডেন্ট। প্রত্যেকটা হাউজে আমাদের স্টুডেন্ট আছে। তাদের কর্মসংস্থানের কোনো অভাব নাই। অ্যাডফার্ম বা টেলিভিশনে গ্র্যাজুয়েটরা কাজ করছে। সম্প্রতি অন্তর্জাল মুভির গ্রাফিক ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়াকে সাপোর্ট দিয়েছে আমাদের স্টুডেন্টরা। অ্যানিমেশন, থ্রিডি, মোশন গ্রাফিকস প্রত্যেক জায়গায় আমাদের ছেলেমেয়েরা অবদান রাখতে পারছে।
দেশের একমাত্র ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার বিভাগ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর্কিটেকচার বিভাগেই এ বিষয়ে কোর্স থাকে। কিন্তু আলাদা সাবজেক্ট হিসেবে চালুর প্রয়োজন মনে করলেন কেন?
জাপানের সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এ বিভাগ দেখেছি। শুরুতে দেশে চারুকলার ছেলেমেয়েরাই এ কাজ করত। এছাড়া আর্কিটেকচার বিভাগেও ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার কোর্স আছে। এখনো কিন্তু আমাদের দেশে ঘর সাজানো, বাগান সাজানো এ কালচার বেড়ে ওঠেনি। চীনে জাপানে বাড়ি-ঘর থেকে বাগান সাজানো পর্যন্ত একটা শৈল্পিক ব্যাপার। আমাদের এখানে সবকিছু শুরু হচ্ছে একটু দেরিতে। আজকে দেখবেন কোনো অফিস বা বাড়ি করতে গেলে ইন্টেরিয়র ছাড়া হয় না। এখন মধ্যবিত্তের মধ্যেও এ বোধগুলো জাগ্রত হচ্ছে। ফলে এটি আমাদের দেশে ধীরে ধীরে আরো বেশি জনপ্রিয়তা পাবে বলে আমার ধারণা।
বাংলাদেশের চাকরির বাজারে এ বিভাগের গ্র্যাজুয়েটদের আলাদা ক্ষেত্র কী তৈরি হয়েছে?
বিভিন্ন ফার্ম আমাদের সঙ্গে এমওইউ করছে। তারা চাচ্ছে, চাহিদামতো গ্র্যাজুয়েট যেন আমরা তৈরি করে দিই। ইন্টেরিয়র ফার্ম, আর্কিটেকচারের পাশাপাশি ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও গার্ডেনিং সেক্টরেও কিন্তু লোকজন দরকার। তারা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করে, এটাই ফার্মের কাজ। সেখানেও আমাদের ছেলেমেয়েরা সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা বেকার নেই।
একাডেমিয়ার সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির কোলাবোরেশন নাই—এমন কথা প্রায়ই আলোচিত হয়। কেন এমন হচ্ছে?
ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা আমাদের কাছে আসে। আমরা বলেছি, আপনাদের কী ধরনের কারিকুলাম লাগবে আমাদের বলেন। তাহলে অবশ্যই আমরা কারিকুলাম পরিবর্তন করে ইন্ডাস্ট্রিবান্ধব করে গড়ে তুলব। বর্তমানে যে ওবিই কারিকুলাম আছে, এ কারণে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আমাদের লিংকেজ করতেই হবে। ফলে এটাকে আমরা সেভাবেই ডেভেলপ করেছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফল দেখতে পাবেন।
এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য কী কী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে?
আমাদের ল্যাব আছে, স্টুডিও আছে। এছাড়া হাতে-কলমে শিক্ষার জন্য সাইট ভিজিটে নেয়া হয়। কনস্ট্রাকশন ফ্যাক্টরি, ফার্নিচার ফ্যাক্টরিতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাচ্ছি। এতে আমাদের দুটি কাজ হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশন তৈরি হচ্ছে এবং শিক্ষকদের সঙ্গে ফিল্ডে গিয়ে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কাজ শিখছে। এছাড়া ফ্যাক্টরিগুলো আমাদের প্রপোজাল দিয়েছে, তারা শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেবে। এর বাইরে লাইব্রেরি, ই-লাইব্রেরি বা কম্পিউটার ল্যাব থেকে সফটওয়্যার যা যা প্রয়োজন দিচ্ছি। পাশাপাশি অ্যাপ্রিসিয়েশনের জন্য তাদের বারবার ফ্যাক্টরি ভিজিটে নিয়ে যাচ্ছি। যে যে সাবজেক্টে পড়ছে তাদের সে ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাচ্ছি। ফাইনাল ইয়ারের আগেই আমাদের শিক্ষার্থীরা চাকরি পাচ্ছে। আমরা তাদের সেভাবেই তৈরি করে দিচ্ছি। দুই-তিন বছর চাকরি করার পর তারা নিজেরাই ফার্ম প্রতিষ্ঠা করছে। ডিজাইন কনসালট্যান্ট হিসেবে তারা দেশের বাইরেও কাজ করছে।
আপনার যদি কিছু বলার থাকে...
আমি মনে করি, আমাদের প্রজন্মকে যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে কালচারাল এডুকেশন খুবই জরুরি। আমাদের কারিকুলামে এরই মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। মুখস্থ বিদ্যা নয়। এঁকে এঁকে তাকে শেখানো হয়। একটা বিল্ডিং নির্মাণ হয় ৫০-৬০ বছরের জন্য। কিন্তু ইন্টেরিয়র ডিজাইন মানুষ চেঞ্জ করে চার-পাঁচ বছর পর পর। ফলে আমাদের এ শিক্ষার চাহিদা কিন্তু বাড়ছেই। চাকরির পদ খালি আছে, কিন্তু আমাদের এত শিক্ষার্থী দিতে পারছি না। আমাদের এ সেক্টরের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
দেশে এখনো আর্ট কালচারাল বেশি নেই। যদিও সম্প্রতি আমাদের কারিকুলামের মধ্যে এগুলো সংযুক্ত করা হচ্ছে। মুখস্থ নয়, প্র্যাকটিক্যালি শেখা। এগুলো এখন খুব দরকার। শিক্ষার্থীরা রান্না শিখবে, ওয়াশরুম ক্লিন করবে, মাঠে গিয়ে কৃষিকাজে যুক্ত হবে, আর্ট কালচার নিয়ে কাজ করবে। কারণ এগুলো এডুকেশনের একটা পার্ট। কারিগরি বা টেকনিক্যাল এডুকেশনের কোনো বিকল্প নেই।