২০২৪ সাল

তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেশির ভাগই অলস বসে থাকতে পারে

দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সাড়ে ২৭ শতাংশ জ্বালানি তেলভিত্তিক (ফার্নেস ও ডিজেল)। যদিও বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ ধরনের জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার ২২ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সামনের বছর এ ব্যবহার ব্যাপক মাত্রায় কমে আসবে। বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি না পাওয়া, ফার্নেস অয়েল আমদানিতে অর্থ সংকট ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় আগামী বছর তেলচালিত

দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সাড়ে ২৭ শতাংশ জ্বালানি তেলভিত্তিক (ফার্নেস ও ডিজেল)। যদিও বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ ধরনের জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার ২২ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সামনের বছর এ ব্যবহার ব্যাপক মাত্রায় কমে আসবে। বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি না পাওয়া, ফার্নেস অয়েল আমদানিতে অর্থ সংকট ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় আগামী বছর তেলচালিত এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সিংহভাগই বসিয়ে রাখতে হতে পারে। 

অলস বসিয়ে রাখা হলেও এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি)। বর্তমান প্রেক্ষাপটে উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয়বহুল এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশের বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এরই মধ্যে উৎপাদনে এসেছে। চাহিদা পূরণের সক্ষমতাও এখন পর্যাপ্ত। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় ব্যয়বহুল এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই ফুরিয়েছে। 

বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৩৩৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ৬ হাজার ৯৮২ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতের (আইপিপি) আছে ৩২টি, যার মোট সক্ষমতা ৪ হাজার ৩৬২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৮৯০ মেগাওয়াট গত অর্থবছরেই (২০২২-২৩) মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। তবে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনেকগুলোই আবার চুক্তি নবায়ন করে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ শর্তের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মেয়াদ শেষ হচ্ছে আরো ১ হাজার ৭৭০ মেগাওয়াটের। বিদ্যুতের তীব্র চাহিদার মৌসুমেও দেশে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ সক্ষমতার ব্যবহার হয় সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে গড়ে সর্বোচ্চ দেড় হাজার মেগাওয়াট এ শ্রেণীর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার করা হচ্ছে। 

আগামী বছর কী পরিমাণ সক্ষমতার জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু থাকবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বিপিডিবির উৎপাদন বিভাগ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির সদস্য (উৎপাদন) এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগামী বছর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানোর বিষয়ে অগ্রিম কিছু জানানো যাবে না। কারণ সেটি নির্ভর করবে বিদ্যুতের চাহিদার ওপর। তবে বিপিডিবি মেরিট ডিসপাস অর্ডারের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ গ্রহণ করে থাকে। যখন যে ধরনের কেন্দ্র চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সাশ্রয়ী হবে, তখন সেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।’

তেলভিত্তিক বিদ্যুতে অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় উৎপাদন ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। আবার অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামও এখন বাড়ছে। বিভিন্ন বাজার আদর্শে এরই মধ্যে পণ্যটির দাম ব্যারেলপ্রতি ৮০-৮৫ ডলারে উঠেছে। কোনো কোনোটিতে তা ৯০ ডলারের কাছাকাছি। বৃহৎ দুই সরবরাহকারী এলাকা মধ্যপ্রাচ্য ও কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে চলমান সংঘাতের পাশাপাশি বর্ধিত চাহিদার কারণে পণ্যটির দাম আরো বাড়ার পূর্বাভাস রয়েছে। সে হিসেবে জ্বালানি তেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় আরো বাড়তে যাচ্ছে। বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় পড়ছে ৩৫ থেকে প্রায় ৪০ টাকা। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ টাকা। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি খরচ পড়ে ১৩-১৪ টাকা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন খরচ বিবেচনায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহারে বিপিডিবিকে সবচেয়ে বেশি অনুৎসাহিত করা হয়। সামনের দিনগুলোয় জ্বালানি তেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠলে এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় আরো বাড়বে। অন্যদিকে দেশের কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোই এখন বিদ্যুতের চাহিদার প্রায় পুরোটা পূরণ করতে সক্ষম। 

দেশে সম্পূর্ণ চালু হওয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিদ্যমান সক্ষমতা (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) ৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। আর পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা হিসাব করলে তা দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াটে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা দাঁড়াবে ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। ওই সময় দেশে কয়লার বেইজ লোডভিত্তিক (সার্বক্ষণিক চালু) বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দৈনিক সরবরাহ হবে মোট চাহিদার অর্ধেক। এছাড়া গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে পাওয়া যাবে ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট। এর বাইরে ভারত থেকে আরো ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি রয়েছে। পাশাপাশি গ্রিডে নবায়নযোগ্য (সৌরবিদ্যুৎ ও হাইড্রো) বিদ্যুৎ যুক্ত হবে অন্তত ৬০০ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকে কয়লা, গ্যাস, আমদানি ও সৌরবিদ্যুৎ মিলিয়ে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ১৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের বেশি, যা দিয়ে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার পুরোটাই পূরণ করা সম্ভব। 

চাহিদা কম থাকায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই এখন অব্যবহৃত থাকছে। অলস বসে থাকায় কোনো কোনোটির যন্ত্রাংশ অকেজোও হয়ে পড়ছে। আবার উৎপাদনের মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন বিপিডিবির কর্মকর্তারা। 

ব্যবহার না করলেও এগুলোর পেছনে ব্যয় কমছে না বিপিডিবির। বসে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সক্ষমতার চার্জ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। গত ১৪ বছরে ৮২টি বেসরকারি এবং ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বলে সম্প্রতি জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। 

বিপিডিবির আর্থিক পরিস্থিতি এখন বেশ নাজুক আকার ধারণ করেছে। অর্থ সংকটে আইপিপিগুলোর সরবরাহকৃত বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি। এরই মধ্যে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিপিডিবির বকেয়া দেনার পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিপিডিবির কাছে আটকে থাকায় জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। বিদ্যুৎ ক্রয়বাবদ প্রতি মাসে বিপিডিবি অর্থ পরিশোধ করলেও বকেয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানতে পারছে না আইপিপিগুলো।

বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপি) সভাপতি ফয়সাল করিম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাত মাসের বকেয়া এখন ওভারডিউ হয়ে আছে। অর্থ না পাওয়ায় ব্যাংকে আইপিপিগুলোর এলসি জটিলতা বাড়ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঠিকমতো চালানো যাচ্ছে না। অনেক কোম্পানি দেউলিয়া ও ব্যাংকের ঋণখেলাপিতে পড়েছে।’

বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়ার মধ্যে আগামী বছরে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঠিকমতো পরিচালনা করা না গেলে এ খাতে বড় সংকট তৈরি হতে পারে বলে জানিয়েছে আইপিপিগুলো। বিশেষ করে বিপুল অর্থের ঋণ ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি ডরিন পাওয়ার জেনারেশনস অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেড। জানতে চাইলে কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোস্তফা মঈন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইপিপি খাত বকেয়া নিয়ে সংকটে রয়েছে। বকেয়ার কারণে ব্যাংকের ঋণ ও এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। তবুও আমরা বিপিডিবিকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা এখন আর তেমন একটা নেই। উৎপাদন খরচ বিবেচনায় ব্যয়বহুল এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরকারের বেরিয়ে আসা উচিত। 

বুয়েটের পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. ম তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখন আর চালানো উচিত নয়। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ অন্য যেকোনো জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে অনেক বেশি। এখন বড় পাওয়ার প্লান্টগুলো উৎপাদনে এসেছে। ফলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় থেকে বিপিডিবির সরে আসা উচিত।’

তবে এ অবস্থায়ও জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসা ঠিক হবে না বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন অনেক ব্যয়বহুল। এ অবস্থায় এসব কেন্দ্র যথাসম্ভব কম ব্যবহার করে ব্যয় সাশ্রয়ের কথা ভাবছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও এখন ঊর্ধ্বমুখী। জ্বালানি আমদানি ও ব্যয়বহুল এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে বিপিডিবি আর্থিকভাবে লোকসান করছে। যে কারণে পিক ডিমান্ড ও অতিপ্রয়োজন ছাড়া তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার করতে চাইছে না সংস্থাটি। তবে এ মুহূর্তে এগুলোর ব্যবহার থেকে একেবারে বেরও হয়ে আসা যাচ্ছে না। পিক আওয়ারে বিদ্যুতের আকস্মিক চাহিদা বেড়ে গেলে এগুলোকে ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক উৎপাদন বাড়িয়ে নেয়া যায়। 

বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের লাগবেই। কারণ পিক ডিমান্ডের সময় (সন্ধ্যায়) হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে গেলে পিকিং পাওয়ার প্লান্ট (বর্ধিত চাহিদার সময় তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক চালু করা বিদ্যুৎ কেন্দ্র) ছাড়া লোড বাড়ানোর অন্য কোনো উপায় নেই। মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৫-১০ শতাংশ এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাখার পরিকল্পনা বিদ্যুৎ বিভাগের।’

আরও