নিরাপত্তায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি

বঙ্গবন্ধু টানেল প্রথম শ্রেণীর কেপিআই স্ট্রাকচার হওয়ায় এর পরিচালনা, ব্যবহার ও মেইনটেন্যান্স সূক্ষ্ম ও জটিল। অবকাঠামোটির নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে থাকছে নানান প্রযুক্তির ব্যবহার। সার্বক্ষণিক টানেলকে ঘিরে নিয়োজিত থাকবে বিপুলসংখ্যক কর্মী বাহিনী। একাধিক নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি পরিচালনা কর্মীরা হবেন প্রশিক্ষিত। দেশী-বিদেশী এ কর্মীদের কাজই হবে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে

বঙ্গবন্ধু টানেল প্রথম শ্রেণীর কেপিআই স্ট্রাকচার হওয়ায় এর পরিচালনা, ব্যবহার ও মেইনটেন্যান্স সূক্ষ্ম ও জটিল। অবকাঠামোটির নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে থাকছে নানান প্রযুক্তির ব্যবহার। সার্বক্ষণিক টানেলকে ঘিরে নিয়োজিত থাকবে বিপুলসংখ্যক কর্মী বাহিনী। একাধিক নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি পরিচালনা কর্মীরা হবেন প্রশিক্ষিত। দেশী-বিদেশী এ কর্মীদের কাজই হবে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে কিংবা তার আগেই ব্যবস্থা নেয়া, মানুষ কিংবা যানবাহনের সমস্যা হলে সেটি দ্রুত নিরসন করা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে মানব সুরক্ষার চেয়ে টানেলে প্রযুক্তির নানান উপাদান ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হবে। 

সিসিটিভি ক্যামেরা 

টানেলের দুটি টিউবকে ঘিরে রয়েছে ১১০টি অত্যাধুনিক ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরা, যা সার্বক্ষণিক যানবাহন ও মানুষকে পর্যবেক্ষণ করবে। শুধু সিসিটিভি ক্যামেরায় ভিডিও চিত্র ধারণই নয়, কন্ট্রোল রুম থেকে যেকোনো ধরনের অসংগতি চোখে পড়লেই রেসপন্স টিমকে সংকেত দেয়া হবে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ মিনিটের মধ্যেই টানেল অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত রেসপন্স টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে। সিসিটিভিগুলো ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে যেকোনো ছবি তোলায় সক্ষম। এক্ষেত্রে টানেলের পিচে কোনো একটি আলপিন পড়লেও সেটি ক্যামেরায় ধরা পড়বে বলে জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। 

স্ক্যাপ চ্যানেল 

সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে টানেলে দুর্ঘটনার হার খুবই কম। তবে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে ওঠে টানেল। তাই দুর্ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা-পরবর্তী অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধই টানেল ব্যবস্থাপনার মূল চ্যালেঞ্জ। এজন্য সিংহভাগ কাঠামোই থাকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত আগুন প্রতিরোধী। এর পরও অগ্নিকাণ্ড ও অগ্নিকাণ্ড থেকে নির্গত ধোঁয়ার কারণে প্রাণহানি হলে ভেতরের লোকজনকে দ্রুত সরিয়ে নিতে রাখা হয়েছে স্ক্যাপ চ্যানেল প্রযুক্তি। টানেলের ৮০ মিটার পর পর রাখা হয়েছে অত্যাধুনিক স্ক্যাপ চ্যানেল। এ হিসাবে প্রতি টিউবে ৩০টি করে মোট ৬০টি স্ক্যাপ চ্যানেল রয়েছে। সুইচে চাপ দেয়ার পর একটি বিশেষ হাতল খুললেই চ্যানেলটি খুলে যাবে। সুইচটির ওজন মাত্র ১০ কেজি। মূল সড়ক বা পিচ দুই ভাগ হয়ে একটি সিঁড়ি উন্মুক্ত হবে। ২ দশমিক ২ মিটারের এ সিঁড়ি দিয়ে একজন একজন করে টানেলের নিচে নেমে যাওয়া যাবে জরুরি ভিত্তিতে। নিচে নেমে সুড়ঙ্গপথ ধরে হেঁটে টানেল মুখে পৌঁছে যাওয়া যাবে। তাছাড়া কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে উদ্ধারকারী দলও পৌঁছে যাবে দুর্ঘটনাকবলিতদের সহায়তায়। 

টেলিফোন

টানেলের দুটি টিউবেই রাখা হয়েছে বেশকিছু টেলিফোন। প্রতি ২০০ মিটার অন্তর একটি টিউবে ১৬টি করে সর্বমোট ৩২টি টেলিফোন সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে। টানেলের মূল দেয়ালে সাঁটানো টেলিফোনের একটি বাটন চাপলেই কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন বিপদগ্রস্ত যে কেউ। ২৪ ঘণ্টাই কন্ট্রোল রুমের টেলিফোন অপারেটর জরুরি এসব ফোন রিসিভ করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ঘটনাস্থলে পাঠাতে সাহায্য করবেন। অনেক সময় কন্ট্রোল রুম থেকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সংকট নিরসনে সহযোগিতা দেয়া হবে। সেটি কার্যকর না হলে ঘটনাস্থলে পাঠানো হবে রেসপন্স টিম। 

ডাক্তার ও মেডিকেল টিম

টানেলের ভেতরে নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মীর পাশাপাশি থাকবে ডাক্তার ও একটি মেডিকেল টিম। কোনো দুর্ঘটনা হলে মেডিকেল টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। 

২৪/৭ কর্মযজ্ঞ

বিশ্বের যেকোনো দেশে কিংবা বাংলাদেশে বৃহৎ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক টোল আহরণই থাকে প্রধান কাজ। তবে টানেলের ক্ষেত্রে সেটি ভিন্ন। প্রয়োজনের সম্ভাবনা কম থাকলেও সবগুলো ব্যবস্থাপনা উইংকেই যেকোনো সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। বঙ্গবন্ধু টানেল ব্যবস্থাপনায়ও পাঁচ শতাধিক লোক তিনটি শিফটে নিয়োজিত থাকবে। নিয়ম করে বিভিন্ন বিভাগের কর্মীরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণের পর শিফট পরিবর্তন হবে। টানেল অপারেশনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সীমিত কিছু কর্মী থাকলেও বেশির ভাগই থাকবে বাংলাদেশী কর্মী। 

প্যাট্রোল টিম ও তাদের কাজ

টানেলের ভেতরে ২৪ ঘণ্টাই থাকবে প্যাট্রোল টিম। কন্ট্রোল রুম থেকে নির্দেশনা পেলে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট কিংবা আরো কম সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হবে তারা। তবে কোনো অসংগতি না থাকলে প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর টানেলের উভয় পাশে টহল দেবে প্যাট্রোল টিম। এক্ষেত্রে টানেলের সিসিটিভিতে অসংগতি পেলে কন্ট্রোল রুমের নির্দেশনায় কাজ করার পাশাপাশি টহলকারী দল যেকোনো সমস্যা সমাধানে তৎপর থাকবে। কেউ যদি গতিসীমা লঙ্ঘন করে, যানবাহন থেকে বের হয়ে নির্দেশনা ভঙ্গ করে তবে তাদের আইন মানতে বাধ্য করাবেন এ দলের সদস্যরা। যদিও এখন পর্যন্ত আইন কিংবা টানেল ব্যবহারে নির্দেশনা অমান্যকারীদের জন্য কোনো শাস্তির বিধান রাখেনি সেতু কর্তৃপক্ষ। 

ইমার্জেন্সি ফায়ার সার্ভিস 

টানেলের অভ্যন্তরে নিয়মিত বিরতিতে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল থাকবে। কোনো দুর্ঘটনা হলে প্রাথমিকভাবে অপারেশন বিভাগের এ ফায়ার সার্ভিস টিমই ঘটনাস্থলে যাবে। তবে দুর্ঘটনার আকার বিবেচনায় বাইরে থাকা ফায়ার সার্ভিস বিভাগকে ডাকা হবে। উভয় প্রান্তে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো প্রয়োজন অনুসারে টানেলের ভেতর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবেশ করতে পারবে। এক্ষেত্রে ঘটনাস্থলের সবচেয়ে কাছের টিমকেই সবার আগে ডাকা হবে। 

অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র 

ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকবে ৫০ মিটার পর পর। অর্থাৎ টানেলের অভ্যন্তরে সর্বমোট ১০০টিরও বেশি ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকবে। একইভাবে ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকবে ৫০ মিটার পরপর। উভয় টিউবের মধ্যেই একইভাবে অগ্নিনিরাপত্তার এসব যন্ত্র বসানো থাকবে। তবে সম্পূর্ণ টানেলে একটি ফায়ার ট্রাক থাকবে। সার্বক্ষণিক প্রস্তুত এ ট্রাকটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছতে অপারেটর রাখা হবে। টানেলের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ দল ঘটনাস্থলে যাওয়ার সময়ই টানেলের উভয় প্রান্তের ফায়ার সার্ভিসের কাছে  অগ্নিকাণ্ডের খবর পৌঁছে যাবে। কন্ট্রোল রুমের পরামর্শ ও সহায়তায় দ্রুত সময়ের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের টিম আগুন নেভাতে টানেল প্রবেশ করবে। 

স্ক্যানার

টানেলের ভেতরে প্রবেশের আগেই ওজন স্কেলে পরীক্ষা করা হবে ভারী ও বাণিজ্যিক পণ্যবাহী যানবাহন। এক্সেল লোডের চেয়ে বেশি পণ্য পরিবহন করলে টানেলে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। কিন্তু বিস্ফোরক কিংবা দাহ্য পদার্থ বহনকারী যানবাহন শনাক্ত করতে বসানো হচ্ছে আন্ডার ভেহিকল সার্ভিল্যান্স সিস্টেম (ইউভিএসএস)। চলতি বছরের জুনে টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে দুটি এবং নদীর পতেঙ্গা প্রান্তে তিনটি ইউভিএসএস বসানো হয়। বিমানবন্দরসহ যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান, কেপিআই স্থাপনায় প্রবেশের আগে এ প্রযুক্তি দিয়ে যানবাহন পরীক্ষা করা হয়।

আরও