দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে প্রথম সড়ক ও সুড়ঙ্গপথ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। কর্ণফুলী নদীর দুদিকের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যুক্ত করতে এ পথ নির্মাণকে অত্যন্ত সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসেবেই দেখছেন ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করছেন, এখন কৌশলগত সব বিষয় নিশ্চিত করা গেলে চট্টগ্রামকে আন্তর্জাতিক লজিস্টিকস হাবে দাঁড় করাতে এ টানেল হতে পারে উপযুক্ত অবকাঠামো। যোগাযোগ করিডোর তখন রূপান্তর হবে অর্থনৈতিক করিডোরে। টানেলকে অর্থনৈতিকভাবে টেকসই করতে আঞ্চলিক যোগাযোগ সহজ ও সম্প্রসারণসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু মতামত তুলে ধরেছেন দেশের প্রথম সারির শিল্পোদ্যোক্তারা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বণিক বার্তার চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান রাশেদ এইচ চৌধুরী
মো. মাহবুবুল আলম
প্রেসিডেন্ট
এফবিসিসিআই
ব্যবসা সহজ ও সম্প্রসারণে কানেক্টিভিটি হলো মূল কথা। যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম এমনিতে অবহেলিত জনপদ। এখন সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ কনসেপ্ট ধরে টানেল নির্মাণের ফলে ওই অঞ্চলে আরেকটি সিটি গড়ে উঠবে। হবে শিল্পায়ন। তবে এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান খুবই জরুরি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে হাটবাজার কিংবা অন্য যেসব প্রতিবন্ধকতা, সেগুলো একদিকে যেমন দুর্ঘটনার কারণ অন্যদিকে পণ্য পরিবহন খরচকে বাড়িয়ে তুলছে। তাই চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বাড়াতে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ের কোনো বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং ভারতের সেভেন সিস্টারসের মধ্যে সংযোগ হিসেবেও কাজ করবে। আবার টানেল নির্মাণ হলেও কক্সবাজার কিংবা মাতারবাড়ীর যে সংযোগের কথা বলা হয়েছে তাতে শুধু সড়কপথে আনোয়ারার উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু কক্সবাজারের সঙ্গে অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো তেমন ভালো নয়। ফলে টানেলের সুফল শুরুর দিকে কতটা পাওয়া যাবে সেটিও বিবেচনায় আনতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এ বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া গেলে দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতু যেভাবে ভূমিকা রেখেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলও অনেক বড় ভূমিকা রাখবে।
আমীর আলীহুসাইন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
বিএসআরএম গ্রুপ
বঙ্গবন্ধু টানেল নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। কিন্তু এ ধরনের প্রকল্পের সঙ্গে যে কানেক্টিং সেটা প্যারালালি ডেভেলপ করাটা খুবই জরুরি। যেমন সেখানে কীভাবে ইকোনমিক জোন কিংবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া তৈরি হচ্ছে এবং সেগুলোর সঙ্গে সড়কপথে কতটা দ্রুত যোগাযোগ গড়ে উঠছে। আর ওয়ান সিটি টু টাউন কনসেপ্টটা বাস্তবিক অর্থেই গড়ে তুলতে হবে। এখনো যেটা বুঝতে পারছি, শুরুর দিকে টানেলটি সাধারণ লোকই ব্যবহার করবে। বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের তেমন একটা সুযোগ নেই। তাই যতটা দ্রুত সম্ভব বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযুক্ততা গড়ে তুলতে হবে। যেমন পদ্মা সেতু। এর বাণিজ্যিকভাবে অনেক বেনিফিট রয়েছে, আবার জনসাধারণও প্রকল্পটি থেকে দারুণ উপকৃত হচ্ছে। তাই বলব কক্সবাজার সড়ক প্রয়োজনমতো প্রশস্ত করা, মাতারবাড়ীর সঙ্গে কানেক্টিভিটি তৈরিসহ এসব পদক্ষেপেই মূলত আসল বেনিফিট আসবে। আবার ঢাকা-চট্টগ্রাম একটা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে খুব বেশি দরকার। এটার যে বেনিফিট আসবে অন্য আরেকটা প্রকল্পে সেটা দেখানো দুরূহ। যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়ক ও রেলকে অনেক বেশি ফোকাস করতে হবে। আরেকটা ব্যাপার হলো ওয়ান সিটি টু টাউন কসসেপ্ট বাস্তবায়নের জন্য আরো ব্রিজ বানিয়ে মূল শহরের সঙ্গে আনোয়ারা অংশকে পুরো কানেক্ট করে নিতে হবে। এতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে দক্ষিণ অংশে।
মো. আমীরুল হক
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড
মাতারবাড়ী আমাদের জন্য একটা ইকোনমিক হাব হবে। কক্সবাজার থেকে যে রাস্তাটা আসবে সেটা মাতারবাড়ীর সঙ্গে সংযোগ করতে হবে। তাহলে টানেল হয়ে এটা মিরসরাই ইকোনমিক জোনে যেতে পারবে। সেই সঙ্গে ঢাকা পর্যন্ত যদি আলাদা একটা ১০ লেনের সড়কের উদ্যোগ নেয়া হয়, এক্সপ্রেসওয়ে যদি হয় এতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব ২ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা সম্ভব। এভাবেই আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। টুইন সিটির যে কনসেপ্টটা বলা হচ্ছে সেটা কার্যকর করার জন্য এখনো কিন্তু কোনো প্ল্যান দেখতে পাচ্ছি না। ৩০ অথবা ৫০ বছরের জন্য নদীর ওপারটাকে একটা মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় আনা বেশি জরুরি। কোথায় আবাসিক, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে, আবার কোথায় শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হবে এ সবই একটা নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী করতে হবে। এক্ষেত্রে পর্যটনকেও আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। নদীর ওপারে একটা ট্যুরিজম স্পট করা দরকার। যেনতেনভাবে যেন এত বড় একটা অপরচুনিটি ধ্বংস করা না হয়। কারণ একবার অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা গড়ে উঠলে ওই অংশ আর ডেভেলপ করা যাবে না। এছাড়া টুইন সিটি কনসেপ্ট বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য নদীর দুইপারের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরো বেশি সংযোগ তৈরি করতে হবে।
সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ
চট্টগ্রামের মূল শহর থেকে নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল গিয়ে উঠেছে আনোয়ারায়। কানেক্টিভিটির চিন্তা করলে টানেলটি খুব প্রয়োজনীয় একটা প্রকল্প। কারণ কর্ণফুলীর অন্য পাশ অর্থাৎ দক্ষিণাঞ্চল এতে যুক্ত হলো। উপযুক্ত সড়ক সংযোগের মধ্য দিয়ে মাতারবাড়ীর সঙ্গে যখন এ টানেল যুক্ত হবে তখন অর্থনীতিতে একটা ভালো ফল আসবে। কেননা গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে মাতারবাড়ী হবে ইকোনমিক হাব। আর এসব প্রজেক্টকে পুরো দেশের সঙ্গে সংযোগ করানো হবে চট্টগ্রামের মূল শহরে প্রবেশ না করেই। লোকেশনটা খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এটা শহরকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যুক্ত হবে। বঙ্গবন্ধু টানেল শুধু কর্ণফুলী নদীর উভয় পাশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকেই যুক্ত করেনি। বরং একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে এ অঞ্চলের জন্য একটি বিশাল পরিকল্পনা হলো ‘এক অঞ্চল এক পথ’, যেটি পরবর্তী সময়ে নামকরণ হয় বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ)। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংযোগ পরিকল্পনার কারণে এসব অঞ্চলের মধ্যে উপযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণ করে বাণিজ্য বৃদ্ধিও প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এ উদ্যোগে রফতানিরও বড় ক্ষেত্র তৈরির সুযোগ হয়েছে। তবে এজন্য খুব বেশি প্রয়োজন এ টানেলের সঙ্গে একদিকে কক্সবাজার-মাতারবাড়ী অন্যদিকে রাজধানী পর্যন্ত শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা।
শাহরিয়ার জাহান রাহাত
উপব্যবস্থাপনা পরিচালক
কেএসআরএম গ্রুপ
আমাদের আছে বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক উন্নয়নে যারা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য দরকার একটি শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে আঞ্চলিক যোগাযোগ সহজ ও সম্প্রসারণে একের পর এক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে চলেছেন। তাই আমি বলব যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের উদ্যোগটি বাস্তবায়ন চট্টগ্রামকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিনিয়োগ হাব হিসেবে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা। এখন বড় প্রকল্পের সঙ্গে অবকাঠামোসহ কৌশলগত অন্য সব বিষয় যেন ঠিক থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই কর্ণফুলীর দক্ষিণ পারে বড় বিনিয়োগ আসবে। বড় প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা নিশ্চিত করতে এর সঙ্গে যোগাযোগ অবকাঠামোসহ কৌশলগত অন্য সব বিষয় নিশ্চিত করাটা জরুরি। ফলে টানেলের সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের যোগাযোগ যত শক্তিশালী হবে আমাদের বাণিজ্য সক্ষমতা ততই বাড়বে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় কমানো ছাড়াও আরো অনেক বেশি রফতানির ক্ষেত্র তৈরির সুযোগ হবে। তাছাড়া দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের যে যোগাযোগ করিডোরের কথা বলা হচ্ছে এটাকে অর্থনৈতিক করিডোরে রূপ দিতে হবে। তাহলেই টেকসই হবে শিল্প ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি।
জহির উদ্দিন আহমদ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেড
ব্রিজের কারণে নদীর নাব্যতা কমে যায়। এটা একটা সাধারণ রসায়ন। তাই বন্দরের কথা চিন্তা করলে কারিগরি দিক থেকে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ একটা সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম শহরের যে ভৌগোলিক অবস্থান—একদিকে পাহাড় অন্যদিকে সমুদ্র। তাই শহরটাকে সম্প্রসারণের আর কোনো জায়গা নেই। দক্ষিণে যে আবাসন ব্যবস্থার পরিকল্পনা, টানেলকে ব্যবহার করে এর একটা বড় সুফল আসবে। শিল্পায়নের বড় সুযোগ তৈরি হবে। তবে কক্সবাজারের সঙ্গে যদি এখন দ্রুত ছয় লেন বা উপযুক্ত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা না হয় তাহলে এ টানেলের সুফল সেভাবে আসবে না। দেখা যায়, একটা বড় প্রকল্প হয় কিন্তু এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ছোট প্রকল্প ফ্যাসিলিটেট করতে না পারায় সেগুলোর সুফল পাওয়াটা সহজ হয় না। যেমন টানেলের সঙ্গে যদি কক্সবাজারের রাস্তার প্রকল্প একসঙ্গে নেয়া যেত তাহলে তুলনামূলক কম ব্যয়ে এতদিনে অন্তত চার লেনের রাস্তা হয়ে যেত। এতে বেশকিছু সুযোগ যেমন পর্যটনের একটা অপরচুনিটি তৈরি হতো, ইন্ডাস্ট্রি দ্রুত ডেভেলপ করত, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে লক্ষ্য করে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা দ্রুত পদক্ষেপ নিত। তাই বলব, বঙ্গবন্ধু টানেল অর্থনীতির জন্য অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি একটা বড় সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এখন ডিপেন্ড করবে এটাকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে।