উনিশ শতকের শুরুতে লন্ডন ছিল বিশ্বের ব্যস্ততম নদীবন্দরগুলোর মধ্যে একটি। সে সময়ে লন্ডনের পাশ দিয়ে বয়ে চলা টেমস নদীর ওপর ৬০০ বছরের পুরনো পাথরের দীর্ঘ সেতুটি সক্ষমতার বাইরে চলে যায়। মধ্যযুগের অনেক সেতুর মতোই এর চারপাশ ছিল ভবনে ঘেরা। এ কারণে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচলের সময় মনে হতো অন্ধকারাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গ দিয়ে ছুটে চলেছে সেগুলো। যদিও সেতুটি ছিল প্রায় ৮০ মিটার। একই পথে গরুর গাড়ি, ওয়াগন, বাস ও পথচারী। দিনের ব্যস্ত সময়গুলোয় সেতুটি পার হতে ১ ঘণ্টার মতো সময় লেগে যেত। তাই বহমান টেমস নদীর নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণের চেষ্টা চলে।
প্রকৌশলীরা ১৭৯৯ সালে টানেল তৈরির চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। ১৮০৫ সালে লন্ডনের একদল প্রকৌশলী রথারহিথ ও ওয়াপিংয়ের মধ্যে টানেল খননের চেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু নদীর তলদেশের ভেজা নরম কাদামাটির কারণে তারা ব্যর্থ হয়। ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্স থেকে পালিয়ে ব্রিটেনে যাওয়া মেধাবী প্রকৌশলী মার্ক ব্রুনেল অবশ্য একটু অন্যভাবে চিন্তা করেছিলেন। তিনি ‘টানেল শিল্ড’ নামে বিশেষ এক প্রযুক্তি বের করেন, যার কৌশল ব্যবহার করে দুই শতাব্দী ধরে প্রায় প্রতিটি টানেলের সুড়ঙ্গ করা হয়েছে। তবে মাটির ওপরে থাকা টেমস নদীর নোংরা, ময়লা ও সুয়ারেজের পানি সুড়ঙ্গের ছাদ চুইয়ে টানেলের বাতাস চলাচলের জায়গাকে খুব বিষাক্ত করে ফেলে। ফলে ব্রুনেলসহ খনন শ্রমিকরা ডায়রিয়া, মাথাব্যথা ও সাময়িক চোখে কম দেখাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেন। একটা সময় সুড়ঙ্গটি কয়েক ফুট গভীর পানিতে প্লাবিত হয়।
খনি শ্রমিকরা ১৮২৭ সালে নদীর তলদেশে খননের সময় মাটি ফুঁড়ে টানেলে পানি প্রবেশ করে। ব্রুনেলের ছেলে ইসামবার্ড কিংডম ব্রুনেলকে তখন নিজে নদীর তলদেশে সেই গর্ত মেরামতের জন্য নামতে হয়েছিল। একটি নৌকার সাহায্যে বিশেষ ধরনের ডুবুরি সরঞ্জাম দিয়ে তিনি পানির গভীরে যান এবং গর্ত বন্ধ করে পানি প্রবেশ ঠেকান। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ১৮২৮ সালে আরেকটি ভয়ংকর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ছয়জন। অন্যদিকে ব্রুনেলের তহবিলও ফুরিয়ে যায়। একপর্যায়ে টানেলের মুখ বন্ধ করে তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর কেটে যায় সাত বছর। টানেলের খননকাজ শুরু করতে এ সময়টা অর্থ সংগ্রহ করেন ব্রুনেল। একই সঙ্গে টেমসের পানির চাপ সামাল দিতে সক্ষম এমন উন্নত প্রযুক্তির শিল্ড বানিয়ে ফেলেন। পুরনো টানেল শিল্ডের পরিবর্তে নতুন প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন করেন। রাত-দিন কাজ করার পর ১৮৪১ সালে কাঙ্ক্ষিত টানেল তার পুরোপুরি রূপ দেখতে পায়।
টেমস নদীর টানেলের শুরুর দিকে আর্থিক সাফল্য ছিল না, এটি ছিল পুরকৌশলের এক অনন্য বিজয়। যে খরচ হিসাবে করে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল তারও কয়েক গুণ বেশি ব্যয় হয়ে যায়। অর্থাৎ সেই সময়কার অর্ধ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি খরচ হয়েছিল টানেলটি তৈরিতে। চাকাচালিত গাড়ির জন্য প্রবেশদ্বার নির্মাণের প্রস্তাব অর্থাভাবের কারণে ব্যর্থ হওয়ায় টানেল চালুর পর এটি কেবল পথচারীরাই ব্যবহার করতেন। ১৮৬৫ সালে লন্ডন রেলওয়ে কোম্পানি এটিকে কিনে নেয় এবং রেল চলাচলের জন্য রূপান্তর করা হয়। পরে টানেলটি লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডের একটি অংশ হয়ে ওঠে এবং ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এটি ব্যবহার করা হয়।
এরপর বিশ্বের অনেক দেশেই নির্মাণ করা হয়েছে বহু টানেল। এর মধ্যে দীর্ঘতম আন্ডারওয়াটার টানেল বা পানির নিচ দিয়ে নির্মাণ করা সুড়ঙ্গ পথের নাম চ্যানেল টানেল। অ্যাংলো-ফ্রান্সের সমুদ্রের নিচ দিয়ে নির্মিত এ পথ ইউরোটানেল নামেও পরিচিত। প্রায় ৩৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ টানেলের নির্মাণকাজ ১৯৮৬ সালে শুরু হয়ে ১৯৯৪ সালে শেষ হয়। জাপানের হোনশুর আওমোরি থেকে এবং হোক্কাইডোর হাকোদাকে সংযুক্ত করার জন্য ১৯৮৭ সালে নির্মাণ হয় সেকান টানেল। এর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৩ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার হলেও সমুদ্রের নিচের অংশের দৈর্ঘ্য ২৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার। নরওয়ের রাইফলকে টানেল পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম সুড়ঙ্গপথ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৯০ মিটার নিচে নির্মিত টানেলটির দৈর্ঘ্য ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার। পানির তলদেশ দিয়ে নির্মিত বিশ্বের শীর্ষ টানেলগুলোর মধ্যে আরো রয়েছে টোকিও বে টানেল (৯ দশমিক ৬ কিমি), বোরিয়ং আন্ডারসি টানেল (৬ দশমিক ৯ কিমি), হংকং-ঝুহাই-ম্যাকাও ব্রিজ আন্ডারসি টানেল (৬ দশমিক ৭ কিমি), ইয়েরবা বুয়েনা টানেল (৫ দশমিক ৮ কিমি), শিজিয়াং টানেল (৪ দশমিক ৭৫ কিমি)।
চট্টগ্রামের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের জন্য কর্ণফুলী নদীর অবদান অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই বিদেশী বণিকদের জন্য এ নদী তথা চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল গুরুত্বপূর্ণ পোতাশ্রয় হিসেবে প্রসিদ্ধ। শহরের কাছেই নদীর তলদেশে বহু লেন টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। অনুমোদনকালে প্রকল্পটির নাম ছিল ‘কনস্ট্রাকশন অব মাল্টি লেন রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী’। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের বিশেষ এ সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নকে চীনের সাংহাইয়ের ন্যায় ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেল প্রকল্প বলা হচ্ছে। টানেলটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন হয় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। বোরিং মেশিনের মাধ্যমে টানেলের খনন কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। পরবর্তী সময়ে এ প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্ণফুলী টানেল’, যার দ্বার খুলে দেয়া হচ্ছে আজ।