অপ্রচলিত পণ্য রফতানি

চমকপ্রদ উন্নয়নের পাশাপাশি আজকের দিনে আমরা বেশ কতগুলো বড় বড় সমস্যার মুখোমুখি। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস, রাজস্ব আহরণে ভীষণ শ্লথগতি, আয়বৈষম্য, আমানত প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি, অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা, হ্রাসকৃত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, রফতানিতে বৈচিত্র্যহীনতা এবং কতিপয় দেশের ওপর রফতানি বাণিজ্যের নির্ভরতা। প্রতিটি সমস্যা নিজ গুণে বড়।

চমকপ্রদ উন্নয়নের পাশাপাশি আজকের দিনে আমরা বেশ কতগুলো বড় বড় সমস্যার মুখোমুখি। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস, রাজস্ব আহরণে ভীষণ শ্লথগতি, আয়বৈষম্য, আমানত প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি, অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা, হ্রাসকৃত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, রফতানিতে বৈচিত্র্যহীনতা এবং কতিপয় দেশের ওপর রফতানি বাণিজ্যের নির্ভরতা। প্রতিটি সমস্যা নিজ গুণে বড়। আমরা এসবে যাব না। আমাদের আলোচ্য বিষয় রফতানি বাজার এবং পণ্য, বিশেষ করে অপ্রচলিত পণ্য রফতানি। বলা চলে এ সমস্যা আজকের নয়, দীর্ঘদিনের। রফতানির বিষয়টি আমাদের ভাবাচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির উপায় হিসেবেই রফতানির কথা উঠে আসে। আমরা তখন তিন-চারটে রফতানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাও সামান্য রফতানি। পণ্যগুলো হচ্ছে, কাঁচাপাট, পাটজাত দ্রব্য, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য, চা এবং কিছু হস্তশিল্পজাত দ্রব্য। এসব পণ্য দিয়ে আমাদের চাহিদা মিটবে না এ ধারণা থেকে তখনই স্লোগান ওঠে, এক্সপোর্ট অর প্যারিস (রফতানি বাড়াও, না হয় মরো)। এ স্লোগান তোলার পর অনেকদিন চলে গেছে। কী আমাদের অবস্থা। রফতানির পরিমাণ কেমন বেড়েছে, এর বাজার কোথায়? বিশেষ করে অপ্রচলিত পণ্যের বাজার ও এর পরিমাণ। 

স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালের দিকে হঠাৎ দেখা গেল তৈরি পোশাক শিল্পের রমরমা অবস্থা। তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। আমরা ‘‌কোটার’ সুবিধা পেলাম, যা দেয়া হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। সে সুবাদে তৈরি পোশাকের রফতানি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আবার এরই ফাঁকে পণ্য রফতানি নয়, বরং আরো শক্তিশালী সম্ভাবনা তৈরি হয় জনশক্তি রফতানির। এ দুইয়ের আবির্ভাবের ফলে আমাদের চিন্তার সীমা এক-দুই জায়গায় আটকে যায়। আমাদের ধারণা হয় এতেই আমাদের চলবে। বছরে ৬ হাজার থেকে ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ পণ্য রফতানি এবং বছরে ২ হাজার ২০০ থেকে  ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের জনশক্তি রফতানি বা প্রবাসী আয় বিশাল ব্যাপার। আমাদের সব শক্তি নিয়োজিত হয় এ দুই খাতে। প্রভাবশালী লোকজন জড়িয়ে যায় এতে। এর ফল কী?

‘‌অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না’ বলে একটা প্রবাদ প্রচলন আছে। আমরা রফতানি আয়ের উল্লম্ফন এবং প্রবাসী আয়ের উল্লম্ফন দেখে স্বস্তি পেলাম বটে, কিন্তু প্রলয় ঘটছে অন্যত্র। দেখা যাচ্ছে, আজকের দিনে আমরা পণ্য রফতানিতে স্বাধীনতা পরবর্তীকালের মতো দুই-তিনটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তাও আবার কয়েকটি দেশের বাজারই আমাদের রফতানি পণ্যের গন্তব্যস্থল—আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার। আর পণ্য দুটো হলো তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার। স্বাধীনতার পর ছিল কাঁচা পাট, পাটজাত দ্রব্য, চামড়া, চামড়াজাত দ্রব্য, চা এবং হস্তশিল্পজাত দ্রব্য—আর এখন মাত্র দুটো, তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার। যেসব পণ্য স্বাধীনতার পর থেকে অনেকদিন রফতানি হয়েছে, আজ সেগুলো বিলীন হয়েছে/হচ্ছে। যেমন চা রফতানি। ২০২১-২২ অর্থবছরে চা রফতানি হয়েছে মাত্র ২০ লাখ ডলারের। চামড়া রফতানির পরিমাণ কমে আলোচ্য বছরে হয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। কাঁচা পাট রফতানি সম্প্রতি কিছুটা বেড়েছে কিন্তু তা তেমন কিছু নয়। কৃষিপণ্য, ‘‌অন্যান্য’ ক্যাটাগরির পণ্যণ্ররফতানি বেড়েছে। তবে অসম্ভব গতিতে বেড়েছে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার রফতানি। এ দুইয়ের ওপর নির্ভর করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য দেখা যাচ্ছে, সরকার অনেক বড় রফতানি টার্গেট নির্ধারণ করেছে। রফতানির লক্ষ্যমাত্রা সর্বমোট ৭ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে পণ্য রফতানির লক্ষ্য ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার এবং সেবা রফতানির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১ হাজার কোটি ডলার। দেখা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার রফতানি আয়ের মধ্যে ৪ হাজার ৬৯১ কোটি ডলার ছিল তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার। বাকিটা অন্যান্য পণ্য। দেখা যাচ্ছে, অপ্রচলিত পণ্যের রফতানি বাড়ছেই না। যদিও প্রতি বছর সরকার বলছে এটা বাড়াতে হবে। অর্থমন্ত্রী তার প্রতিটি বাজেটে এ অঙ্গীকার করেন। এসব অঙ্গীকারের বিপরীতে ফল দেখা যাচ্ছে শূন্য। ২১-২২ অর্থবছরে মোট রফতানিতে অপ্রচলিত পণ্যের অবস্থান ছিল ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর পরিমাণ ২০২২-২৩ অর্থবছরে খুবই সামান্য বেড়ে হয়েছে মাত্র ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তার মানে হলো মোটামুটি শূন্য। পোশাক শিল্পের ওপর রফতানিনির্ভরতা, তাও আবার কয়েকটি দেশের বাজারের ওপর আমাদের এক বড় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাজারে সামান্য ঝড় উঠলে আমাদের সবকিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছে। কভিড-১৯ অতিমারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের দেখাচ্ছে যে আন্তর্জাতিক বাজার টালমাটাল। এর উত্থান-পতন আছে। সর্ব সাম্প্রতিক উদাহরণ চীন। চীনের রফতানি বাণিজ্য আগের মতো বাড়ছে না। এখন প্রশ্ন চা, চামড়া, পাট ইত্যাদি রফতানি যায় যায়, তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার রফতানির উল্লম্ফন—বাকি পণ্য রফতানির ব্যবস্থা হচ্ছে।

সরকারের পরিসংখ্যানের আশ্রয় নেয়া যাক। দেখা যাচ্ছে, সরকার রফতানি আয়কে ১৫টি ভাগ করে দেখায়। এর মধ্যে পাঁচটি হচ্ছে প্রাথমিক পণ্য। এ পাঁচ খাতে ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত রফতানি বেড়েছে তিন গুণেরও কম। সর্বমোট ১৫টি পণ্যের মধ্যে ১৩টি হচ্ছে শিল্পজাত পণ্য। আলোচ্য সময়ে এসবের রফতানি বেড়েছে বেশি হারে। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ১০টি শিল্পজাত পণ্যের রফতানির পরিমাণ ছিল ৮০০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০২১-২২-এ এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক পণ্য রফতানির চেয়ে শিল্পজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে অনেক বেশি হারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এর সিংহভাগ হচ্ছে তৈরি পোশাক ও নিট। এ দুটো খাতে আলোচ্য সময়ে রফতানি ছিল ৩৫৯ কোটি ৮০ লাখ ও ২৮১ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ২০২১-২২-এ তা হয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৯৩৯ কোটি ৯০ লাখ ও ২ হাজার ৩২১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অর্থাৎ তৈরি পোশাকের চেয়ে রফতানি বেশি বেড়েছে নিটওয়্যারের। এখানে দেখা যাচ্ছে, শিল্পজাত পণ্যের মধ্যে পাটজাত দ্রব্য, চামড়া এবং হস্তশিল্প জাত জাতীয় প্রচলিত পণ্য বাদে যেসব নতুন পণ্যের নাম এসেছে, সেগুলো হচ্ছে পেট্রোলিয়াম পণ্য, রাসায়নিক দ্রব্য, সুতা, ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্য এবং ‘‌অন্যান্য’ শিল্প পণ্য। মুশকিল হচ্ছে, ‘‌অন্যান্য’ অপ্রচলিত পণ্যের মধ্যে কী কী পণ্য আছে তা খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। তবে সরকারি নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, সরকার সর্বমোট ৩৭টি পণ্যকে মোটামুটি অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে ধরে নিয়েছে। এর মধ্যে আছে স্বাস্থ্যবিষয়ক (যেমন টিস্যু পেপার, মাস্ক ইত্যাদি) দ্রব্য, জাহাজ, ওষুধ, আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক সাজসরঞ্জামাদি, হোম টেক্সটাইলস, এগ্রো প্রসেসিং রসদ, কাগজ, প্রিন্টিং প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়ালস, আইসিটি, রাবার, কাপড়ের সুতা, পলিশড, কাট ডায়মন্ড ইত্যাদি। অবশ্য অতিরিক্ত হিসেবে এরই মধ্যে আছে আরো শতাধিক দ্রব্যাদি, যা রফতানি হচ্ছে অল্প অল্প। যেমন বাইসাইকেল, উইগস, গোবর, চারকোল, মাথার টুপি, মৎস্য শিকারের যন্ত্রপাতি, কুঁচিয়া এবং কাঁকড়া, মশারি ও শুকনো খাবার, ফুল, লুঙ্গি, অ্যালমন্ড, চশমার ফ্রেম, কৃত্রিম ফুল, পুতুল, আগর, ছাতার স্টিক, নারকেলের ছোবড়া ইত্যাদি। এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে, বিগত বছরে প্লাস্টিক প্রডাক্টস, চামড়াজাত পণ্য, পেপার/পেপার প্রডাক্টস, কটন/কটন প্রডাক্টস, অ্যালমেইড ফিলামেন্ট, মাথার টুপি, নামাজের টুপি ইত্যাদির রফতানি দিন দিন বাড়ছে। টুপি রফতানিই গত বছরে হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। কৃত্রিম দুলের বাজার হচ্ছে আমেরিকা। এসব অপ্রচলিত পণ্যের বাজার হচ্ছে চীন, হংকং, জাপান, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। ভারত বস্তুত রফতানি উন্নয়নে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ জরিপ চালানোর প্রস্তাব দিয়েছে। কাগজে দেখেছি তা আমাদের বিবেচনাধীন। মশারি রফতানি হচ্ছে ভারতে—তৈরি পোশাকের কথা বাদ দিলাম। অপ্রচলিত পণ্যের বাজার হিসেবে আমেরিকা, ইউরোপ, চীন, হংকং, মালয়েশিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তেমনি হচ্ছে ভারতের বাজার। ১৪০ কোটি লোকের দেশ। একটা, দুটা, তিনটা পণ্যের বাজার পেলেও তা হবে বিশাল বাজার। যেমন পূর্ব ভারতে আমাদের নানা ধরনের পণ্য রফতানি হচ্ছে অনেকদিন থেকে। কৃষিপণ্য, মৎস্য, শুঁটকি ইত্যাদি বাদেও যেসব পণ্য ভারতে রফতানি হচ্ছে, তার মধ্যে আছে সিমেন্ট, লোহা, রড, প্রসাধনী দ্রব্য, বিস্কুট ইত্যাদি। চীনামাটির বাসনপত্রের বাজার ভারতে বড় বাজার হতে পারে। চামড়ার জুতা নয়, কাপড়ের জুতার বাজারের সম্ভাবনা প্রচুর। ওষুধ আমাদের একটি অপ্রচলিত রফতানি দ্রব্য। আইসিটি রফতানির বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। সাইকেল রফতানির বাজার বড় হচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে উদ্যোক্তার উৎসাহের অভাব। আর সমস্যা হচ্ছে আইনি এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা। রয়েছে গুণগত মানের সমস্যা। আমাদের উদ্যোক্তা তৈরি পোশাককে সহজ একটা খাত হিসেবে পেয়ে বসেছে। এতে সবাই ভালো করছে। অতএব, অন্যরা ঝুঁকি নিয়ে নতুন নতুন ক্ষেত্রে যেতে চায় না। আবার এদের মধ্যে অতিসম্প্রসারণ হচ্ছে। কারণে, অকারণে নতুন নতুন ক্ষেত্রে গিয়ে অনেকে হাত পুড়িয়েছেন। এ জায়গায় সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের গাইডেন্স দরকার। অর্থ সাহায্য দরকার। কর সমস্যা লাঘব করা দরকার। তাদের প্রশিক্ষণও দরকার। অনেক ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগের বেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ পণ্য তৈরি। স্ট্যান্ডার্ড রক্ষার জন্য ‘‌বিএসটিআই’ বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এর সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। একে ব্যবসা ও ব্যবসায়ীবান্ধব করা দরকার। রফতানির অনেক পুরস্কার/অ্যাওয়ার্ডের ব্যবস্থা আছে। বিশেষ ব্যবস্থায় অপ্রচলিত পণ্য রফতানিকারকদের পুরস্কৃত করা দরকার। ব্যাংক-ফাইন্যান্স ক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্য রফতানির জন্য আলাদা ফান্ড দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা দরকার বিশেষ ফান্ড। রফতানি ক্ষেত্রে যে ঝুঁকির মধ্যে আমরা পড়েছি/পড়তে যাচ্ছি, তার প্রতি এখনই যথেষ্ট নজর দেয়া দরকার।


লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

আরও