দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় রফতানি খাত প্লাস্টিক শিল্প। প্লাস্টিক রফতানি পরিস্থিতি, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এন পাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আল ফাতাহ মামুন
প্লাস্টিক রফতানি পরিস্থিতি এখন কেমন?
যদি সম্ভাবনার কথা বলি, সেক্ষেত্রে বলতে হয় আমরা প্লাস্টিক উৎপাদন করা শিখেছি। আমরা চীন, ইন্ডিয়া, জাপানের মতো প্রায় সমমানের প্রডাক্ট তৈরি করতে পারি। যার ফলে বাংলাদেশে একটা মার্কেট কিন্তু এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে আমরা পৃথিবীর প্রায় সব নামকরা রিটেইলসে পণ্য দিই। তারা কিন্তু আমাদের রিপিট অর্ডার দিতে চায়। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে আমাদের কস্ট। মাঝেমধ্যে চীনের চেয়েও আমাদের কস্ট বেশি হয়ে যাচ্ছে। পোস্টকভিড চীন তার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কিন্তু এখন ক্রেতা পাচ্ছে না। যেহেতু ইউরোপ-আমেরিকার পিছুটান আছে, সেক্ষেত্রে চীনের কাছে যদি ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে কোনো কাস্টমার যায় তারা কিন্তু যেকোনো প্রাইস অ্যাডজাস্ট করছে। অন্যদিকে আমি কিন্তু করতে পারছি না, কারণ আমার প্রত্যেকটা জায়গায় খরচ বেড়ে গেছে।
তবে সম্ভাবনার কথা যেটা বলছিলাম যে আমাদের একটা মার্কেট তৈরি হয়েছে। এই মার্কেট যদি আমরা ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারি তাহলে অনেক ভালো করব। আমরা যদি ইমপোর্ট চ্যালেঞ্জটা ওভারকাম করতে পারি তাহলে কিন্তু আমাদের ভালো করার কথা।
আমরা ৩৫টা দেশে প্লাস্টিক রফতানি করি। ইউরোপ-আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় আমরা প্লাস্টিক দিচ্ছি।
তাহলে প্লাস্টিক রফতানিতে বাংলাদেশে বড় সম্ভাবনা দেখছেন।
দীর্ঘদিন প্লাস্টিক খাতের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাংলাদেশে প্লাস্টিক খাতের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। কিছু সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠলে আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্লাস্টিক রফতানিও করতে পারব। এখন আমরা যতটা রফতানি করছি তা আরো বহুগুণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। পৃথিবীর যেখানে যেখানে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি আছে, তাদেরও আমরা প্লাস্টিক এক্সপোর্ট করতে পারব। সবসময় যে ফুল ফিনিশড পণ্য এক্সপোর্ট করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যেমন গার্মেন্টে আমরা হ্যাঙারটা উৎপাদন করি। একসময় আমাদের ইমপোর্ট হতো। এভাবে সব সেক্টরেই কিন্তু অপার সম্ভাবনা আছে প্লাস্টিক নিয়ে। বাংলাদেশে এ সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে চাই।
আমরা ১০-১৫ বছর ধরে একটা মার্কেট গড়েছি। বাংলাদেশের প্রডাক্ট এরই মধ্যে সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে অ্যাকসেপ্ট হয়েছে। তাই আমরা যদি এখন গ্লোবাল কম্পিটিশনকে ফেস করে এগোতে পারি আমাদের কিন্তু মার্কেটের অভাব নেই। এদিকে ইউরোপ বলেন, অস্ট্রেলিয়া বলেন, ইউএসএ বলেন, এশিয়ান মার্কেট বলেন এবং আফ্রিকান মার্কেট বলেন সবখানেই আমাদের মার্কেট আাছে। আফ্রিকা একটা নতুন সম্ভাবনার দেশ। আমরা আফ্রিকার ১০-১২টা দেশ থেকে অনেক ব্যবসায়ীকে আমাদের দেশে ভিজিট করিয়েছি। আমরা কিন্তু সেসব দেশে এক্সপোর্ট করছি। আফ্রিকায় আমাদের এক্সপোর্ট অনেক বাড়ছে। সম্ভাবনা অপার। একসময় আমরা শুধু বেসিক প্রডাক্টগুলোর দিকে যেতাম, আমরা এখন কিন্তু বিভিন্ন ধরনের প্রডাক্ট সাপ্লাই করছি। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কাস্টমার আগে চীন থেকে তাদের সোর্সিং করত তারা কিন্তু আমাদের দিকে আসছে। স্পেশালি প্লাস্টিকের বাইরে বলতে গ্যাসস্টোভ, তাঁবু, ফুটওয়্যার প্রডাক্টের চাহিদা বাড়ছে। প্রত্যেকটা সেক্টরে কিন্তু এখন প্রচুর রেসপন্স পাচ্ছি। আরএফএল গ্রুপ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বছরে ১৫ কোটি ডলার রফতানি করে।
প্লাস্টিক রফতানিতে এখন চ্যালেঞ্জ কী?
চ্যালেঞ্জ যদি বলি, সেটা হচ্ছে কাঁচামাল আমদানি। প্রথমত আমি কাঁচামাল ইমপোর্ট করতে পারছি না, বিকজ অব দ্য কান্ট্রি ডাজ নট হ্যাভ ডলারস। এটা চ্যালেঞ্জ নাম্বার ওয়ান। চ্যালেঞ্জ নাম্বার টু হচ্ছে ক্যাপিটাল মেশিন আমরা ইমপোর্ট করতে পারছি না। এই দুটো বড় চ্যালেঞ্জ। এখন বড় মেশিন আমদানি প্রায় বন্ধ। এলসি খোলাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তারপর হচ্ছে সব ক্ষেত্রে আমাদের দেশে দামটা খুব বেড়ে গেছে। ট্রান্সপোর্টেশন কস্ট থেকে শুরু করে, মূল্যস্ফীতির ফলে লেবার কস্ট, পাওয়ার কস্টটা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। ইচ অ্যান্ড এভরি কমপোনেন্ট অব কস্ট হ্যাজ ইনক্রিজড সিগনিফিকেন্টলি।
গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আমরা যে স্টোরগুলোতে এক্সপোর্ট করতাম, সেই দেশেও এখন ইনফ্লেশন চলছে। তারাও শুধু প্রয়োজনীয় আইটেমগুলো কিনছে। আর আমাদের এদিকেও যেহেতু প্রাইসটা বেড়ে গেছে, তার ফলে কিন্তু চাহিদা আবারো হ্রাস পাচ্ছে। যদি আমরা কোনো রকমভাবে আমাদের মূল্যস্ফীতিটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আমাদের ভলিউমটা ঠিক রাখতে পারতাম। এটা একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে নতুন করে।
শুধু প্লাস্টিক খাত নিয়ে যদি বলি, আমাদের আরেকটা বড় সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আর তা হলো মানুষের ভুল ধারণা। অনেকের ধারণা, প্লাস্টিক মানেই হলো শপিং ব্যাগ বা প্যাকেজিং। অথচ এগুলো প্লাস্টিকের ১০ শতাংশের বেশি না। ৯০ শতাংশই অন্যান্য পণ্য। সেগুলো পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। প্লাস্টিকের সৌন্দর্য হলো এটা রিসাইকেলযোগ্য। প্লাস্টিক সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক মনোভাবের ফলে প্লাস্টিকের এ মূল ফিচারটিকেও মানুষ পজিটিভভাবে নিতে পারছে না। এ নেতিবাচক মাইন্ডসেট যদি বদলানো যায় এবং প্লাস্টিক নিয়ে যদি আমরা ড্রাইভ দিতে পারি, তাহলে আশা করা যায় আমরা সহজেই অনেক দূর যেতে পারব। শপিং ব্যাগ একটা সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তবে প্লাস্টিক বলতে আমি কিন্তু শপিং ব্যাগ বোঝাই না। প্লাস্টিক বলতে ব্যাগ বাদ দিয়ে বাকি সবকিছু বোঝায়। আমি প্লাস্টিক খাতের লোক বলে বলছি না, আমি প্লাস্টিক বুঝি বলে বলছি। এ খাতে আমি গত ২০ বছর আছি। সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং পরিবেশবান্ধব। প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রির একটি পজিটিভ দিক হলো এটা কিন্তু জিরো ডিসচার্জ। মানে এখানের কোনো কিছু কিন্তু ফেলতে হয় না। সব রিসাইকেল করা যায়। এ ইন্ডাস্ট্রির মেশিনারিগুলো এমন যে এখান থেকে এক ফোঁটা পানিও নদীতে যাবে না, একবিন্দু বায়ুদূষণও করবে না এবং জিরো ডিসচার্জ অব কার্বন। পুরো ইন্ডাস্ট্রিটাই পরিবেশবান্ধব। জেনে খুশি হবেন আমরা প্রচুর রিসাইকেল করি। আমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রিসাইকেলার। বছরে আমরা ৪০ হাজার টন প্লাস্টিক রিসাইকেল করি। শুধু আমাদের প্লাস্টিকই নয়, আমরা মার্কেট থেকেও প্লাস্টিক সংগ্রহ করি, তারপর আমরা রিসাইকেল করি। রিইউজ পর্যন্ত করি। এ মাইন্ডসেটটা যদি দূর করা যায় এবং এ খাতকে এগিয়ে নেয়ার জন্য যদি সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়া যায়, তখন আমাদের অগ্রযাত্রা সাবলীল হবে। প্লাস্টিক নিয়ে সরকার অনেক সময় দ্বিধায় পড়ে যায়। ওয়ান টাইম ও মাল্টিপল ইউজ দুটোকে মিলিয়ে ফেলে। এ কারণে যে গতিতে প্লাস্টিক খাত এগিয়ে যাওয়া উচিত সে গতিতে এগোতে পারছে না।
প্লাস্টিক খাতের বিনিয়োগ, উৎপাদন, চাহিদা সম্পর্কে বলুন।
এক বছর ধরে উৎপাদনে কোনো অগ্রগতি নেই। কারণ মেশিন আনা যাচ্ছে না, কাঁচামাল আনা যাচ্ছে না। ইনভেস্টমেন্টও হচ্ছে না। আমার মনে হয় এটা সাময়িক। যখন আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে তখন এ খাতে উৎপাদন বাড়বে। কারণ আমাদের চাহিদা আছে। প্লাস্টিকে আমরা হাঁটতে শিখেছি, আমাদের দৌড়াতে দেয়া উচিত। যেখানে আমাদের এখনো হাঁটাই শুরু হয়নি, সেখানেও নজর দেয়া উচিত।