বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ডোবা ও মজাপুকুরে অযত্নে বেড়ে ওঠা কচুরিপানা থেকে তৈরি হচ্ছে হস্তশিল্পের নজরকাড়া পণ্য। সাশ্রয়ী দামের এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে দেশ-বিদেশে। বর্তমানে জেলা থেকে কচুরিপানার হস্তশিল্প ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশে রফতানি হচ্ছে। বিশেষ করে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ক্রিস্টমাস ডে বা বড়দিনের ‘ট্রে’ সাজাতে এসব পণ্যের বেশ কদর। এ কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছে স্থানীয় প্রায় দুই হাজার পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী ও আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটির (এমসিসি) উদ্যোগে উপজেলার পাঁচটি কেন্দ্রে প্রথমে কাজ শুরু হয়। বর্তমানে ‘প্রকৃতি বাংলাদেশ’-এর আওতায় এলাকার দুস্থ ও বিধবা নারীরা তৈরি করছেন বাহারি পণ্য। মূলত তারা কচুরিপানার কাগজের সঙ্গে শন, সুতা, কেয়াপাতা, তালপাতা, পাট দিয়ে তৈরি করে অ্যালবাম, নোটবুক, গহনা ঝুড়ি, গিফট বক্স, শুভেচ্ছা কার্ড, মালা, সুতলির ব্যাগ, পার্স, বক্স, খেলনা, ওয়ালম্যাট, সাইড ব্যাগসহ ৩০ হাজার উপহার সামগ্রী।
এমসিসির জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার পাপড়ী মণ্ডল জানান, বর্তমানে তাদের প্রকল্পের পাঁচটি কেন্দ্রে প্রায় দুই হাজার নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা কিংবা অসহায় ও দুস্থ।
উদ্যোক্তরা জানান, কচুরিপানাকে ঘিরে ১৯৮৪ সালে এমসিসির মাধ্যমে এলাকায় গড়ে ওঠে জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রকল্প। এর আওতায় অসহায় নারীরা শুধু ডোবা ও মজাপুকুর থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করেন। কচুরিপানার সঙ্গে পাট, পরিত্যক্ত কাগজ ও সিল্ক কাপড় দিয়ে তৈরি হয় মণ্ড। এরপর তাতে রঙ দিয়ে রোদে শুকানোর পর বানানো হয় কাগজ। পরে সে কাগজ দিয়ে তৈরি করা হয় হস্তজাত উপহার সামগ্রী। এতে বিভিন্ন ধরনের কাঁচা ফুলও ব্যবহার করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে অসহায় নারীদের হাতে তৈরি পণ্য বিদেশের বাজার দখল করে নেয়। একই বছর উপজেলার বাগধা এলাকায় বাগধা এন্টারপ্রাইজ নামে আরো একটি প্রকল্প চালু করা হয়। এ দুটি প্রকল্পের সাফল্যের পর ১৯৮৭ সালে গড়ে ওঠে কেয়াপাম হ্যান্ডিক্রাফট নামের আরো একটি প্রকল্প। আগৈলঝাড়ায় বিবর্তন হ্যান্ড মেইড পেপার প্রজেক্ট যাত্রা করে ১৯৯৩ সালে। বিদেশী একটি সংস্থা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিয়েছিল এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
বিবর্তন হেন্ড মেইড পেপার প্রজেক্টের আগৈলঝাড়ার ম্যানেজার অঞ্জন কুমার বিশ্বাস জানান, দেশব্যাপী তাদের ২৯টি ইউনিট রয়েছে। এসব ইউনিটে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। বর্তমানে প্রতি বছর কমবেশি ১২-১৫ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়। এতে পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা। কচুরিপানার কাগজ দিয়ে তৈরি তাদের উপহার সামগ্রী বর্তমানে কানাডা, ডেনমার্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে।
অঞ্জন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘যে জিনিসগুলো সবাই ফেলে দিচ্ছে, ব্যবহার করছে না, সেগুলো ব্যবহার করে আমরা নানা পণ্য তৈরি করছি। ক্রিসমাসের আগে আমাদের কাজের খুব চাপ থাকে। এছাড়া হোগলা পাতা ও জুট দিয়ে বাস্কেট তৈরি করি। তবে আমাদের মূল প্রকল্প হচ্ছে কচুরিপানা দিয়ে কাগজ তৈরি করা। ইতালি, জার্মানি, কানাডা, কোরিয়াসহ প্রায় ২৩টি দেশ থেকে অর্ডার আসে। আমরা তাদের চাহিদা মোতাবেক কাজ করি। আমাদের ভালো কাজগুলোও তারা নিয়ে থাকে।’
সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করেই পণ্য তৈরি করা হয় এসব প্রতিষ্ঠানে। এখানকার পণ্য সবচেয়ে বেশি কেনে যুক্তরাষ্ট্রের ফেয়ার ট্রেড কোম্পানি। এছাড়া জাপানের পিপল ট্রি লিমিটেড ও ইতালির সিটিএমসহ ২০টি দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোম্পানি আগৈলঝাড়ার পণ্য কিনে নিয়ে বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করছে। প্রকৃতি বাংলাদেশের মাদার প্রকল্প এমসিসি আমেরিকার কান্ট্রি প্রতিনিধি মি. জর্জ জানান, ১৯৮৭ সালে আগৈলঝাড়ায় কেয়াপাম হ্যান্ডিক্রাফটস মাত্র সাত নারী কর্মী নিয়ে ৬ লাখ ডলার মূল্যের রফতানি বাজারে প্রবেশ করে। আর এখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাজারে এখান থেকে ২০ লাখ ডলারের হস্তশিল্প রফতানি হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক