আরামদায়ক পোশাক হিসেবে লুঙ্গির তুলনা মেলা ভার। যেসব দেশে আর্দ্রতা বেশি, সেখানে সবচেয়ে বেশি পছন্দসই পোশাকটির নাম লুঙ্গি। পোশাক হিসেবে লুঙ্গির যাত্রা দক্ষিণ ভারতে হলেও এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও পশ্চিম ভারতীয় অঞ্চলে লুঙ্গি ব্যাপক জনপ্রিয়। সময়ের পরিবর্তনে এ জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না। ফলে সারা বিশ্বে তৈরি হয়েছে লুঙ্গির এক বিশাল বাজার। লুঙ্গির বৈশ্বিক বাজারে শীর্ষস্থানে আছে বাংলাদেশী লুঙ্গি।
কাপড়ের মান, রঙ্গের বৈচিত্র্য ও আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে বাংলাদেশী লুঙ্গি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন রফতানি হচ্ছে বহির্বিশ্বে। বাংলাদেশী লুঙ্গির অন্যতম আমদানিকারক ভারত। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বস্ত্র ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে লুঙ্গি আমদানি করে। এমনকি ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে নিজেদের ব্র্যান্ড নাম ও স্টিকার ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশে তৈরি হওয়া লুঙ্গি রফতানি করছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। গুণ, মান ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের দিক দিয়ে এশিয়ায় বাংলাদেশের লুঙ্গি সর্বোৎকৃষ্ট। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী লুঙ্গির বড় বাজার আছে। এসব দেশে বসবাসরত বাঙালিরা তো বটেই, স্থানীয়দের অনেকের কাছেও দারুণ জনপ্রিয় বাংলাদেশী লুঙ্গি। তাছাড়া ফিলিপাইন, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, ভুটান, নেপাল, সিঙ্গাপুরসহ পূর্ব আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ প্রাত্যহিক পোশাক হিসেবে লুঙ্গি পরিধান করে। বাংলাদেশের লুঙ্গি ব্যবসায়ীরা এসব দেশের বাজার আয়ত্তে আনার উদ্দেশ্যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, এসব দেশেও বাংলাদেশী লুঙ্গি কালক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ থেকে লুঙ্গি রফতানি বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে সাধারণ পোশাক লুঙ্গি।
লুঙ্গি উৎপাদনে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, খুলনা, পাবনা, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী জেলা বিখ্যাত। এসব জেলায় লুঙ্গির অসংখ্য কারখানা অবস্থিত। একটা সময় তাঁতে লুঙ্গি বোনা হতো। কিন্তু এভাবে লুঙ্গি উৎপাদন বেশ সময়সাপেক্ষ। তাঁতে বোনা ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই লুঙ্গির বেশ কদর আছে। এ ধরনের চারটি লুঙ্গি উৎপাদনে একজন কারিগরের দুদিন সময় লেগে যায়। ১৯৯৮ সাল থেকে লুঙ্গি উৎপাদনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। হস্তচালিত তাঁতের পরিবর্তে তখন থেকে বৈদ্যুতিক মেশিনের ব্যবহার শুরু হয়। প্রযুক্তির নিত্য অগ্রগতি ও আধুনিকায়নে বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে প্রতিদিন হাজার হাজার লুঙ্গি উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশে ৯০ শতাংশই লুঙ্গিই এখন বৈদ্যুতিক মেশিনে উৎপাদন হচ্ছে। এখনো অনেকেই হস্তচালিত তাঁতে লুঙ্গি তৈরি করছেন। তবে কালক্রমে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১২৫টি লুঙ্গির ব্র্যান্ড আছে। এসব ব্র্যান্ডের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড, এটিএম, পাকিজা, অনুসন্ধান, বুখারি, সোনার বাংলা টেক্সটাইল, ডিসেন্ট, ইউনিক, রুহিতপুরী, স্মার্ট, ফজর আলী, জেএম, স্কাই, ওয়েস্ট ও রংধনুর নাম উল্লেখযোগ্য। প্রাত্যহিক পোশাক থেকে ফ্যাশনের অনুষঙ্গও হয়ে উঠেছে লুঙ্গি। বর্তমানে অনেক ফ্যাশন হাউজ ফ্যাশন শোর আয়োজন করে, যেখানে মডেলদের লুঙ্গি পরে র্যাম্পে হাঁটতে দেখা যায়। তাছাড়া আড়ং, প্রাইড, লা রিভ, ইনফিনিটি, অঞ্জন’স, কে ক্রাফট, নিপুনসহ অনেক ফ্যাশন হাউজে লুঙ্গির জন্য আলাদা ডিসপ্লে কর্নার আছে। কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানিও সারা বিশ্বে লুঙ্গির জনপ্রিয়তা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কাজ করছে।
বাংলাদেশে লুঙ্গির ব্র্যান্ডিং প্রথম শুরু হয়েছিল মেসার্স হেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্সের মাধ্যমে। ১৯৭০-এর দশকের আগে কোনো ব্র্যান্ড নাম বা প্রাইস ট্যাগ ছাড়াই বাংলাদেশী লুঙ্গি বিক্রি হতো। তখন প্রতিটি ক্যাটাগরির লুঙ্গির জন্য সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ড নাম ও প্রাইস ট্যাগ নির্ধারণের মাধ্যমে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন মেসার্স হেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্সের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ হেলাল মিয়া। তার দেখানো পথেই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে লুঙ্গির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের যাত্রা হয়।
বাংলাদেশে মেসার্স হেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্সের অঙ্গসংগঠন আমানত শাহ গ্রুপ এবং মানসম্মত লুঙ্গি যেন সমার্থক। বাংলাদেশী লুঙ্গির প্রথম ব্র্যান্ডের নাম আমানত শাহ লুঙ্গি। বর্তমানে বিশ্বের ১৮টি দেশে বিপুল পরিমাণ লুঙ্গি রফতানি করে আমানত শাহ গ্রুপ। ১৯৮৩ সালে আমানত শাহ লুঙ্গি যাত্রা করেছিল। আরেকটি দিকেও পথিকৃৎ আমানত শাহ গ্রুপ। আগে বাজারে সেলাই করা লুঙ্গি পাওয়া যেত না। মানুষ সেলাইবিহীন লুঙ্গি কিনত এবং নিজ দায়িত্বে সেলাই করে নিত। আমানত শাহ গ্রুপই প্রথম বাজারে সেলাই করা লুঙ্গিকে পরিচিত করে। লুঙ্গি রফতানিতেও শীর্ষ নামটি হলো আমানত শাহ গ্রুপ। লুঙ্গি রফতানিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থেকে পুরস্কার পেয়েছে আমানত শাহ গ্রুপ। এর মধ্যে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ড এবং দুটি ন্যাশনাল এক্সপোর্ট ট্রফিও আছে। তারা সাতবার সিআইপি (কমার্শিয়ালি ইম্পর্ট্যান্ট পারসন) অ্যাওয়ার্ড এবং ১৬ বার ডিআইটিএফ (ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ার) অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। বর্তমানে আমানত শাহ গ্রুপের চারটি প্রধান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিটে ১৫ হাজার কর্মী কাজ করছেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে লুঙ্গি রফতানির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৫৩ হাজার ডলার। ২০২১-২২ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে এ পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩০ লাখ ৭৫ হাজার ডলার এবং ২০ লাখ ৭১ হাজার ডলার। এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশের লুঙ্গি রফতানি উত্তরোত্তর বাড়ছে। উজ্জ্বল হচ্ছে এ খাতের সম্ভাবনা।
লুঙ্গি রফতানিতে সম্ভাবনা যেমন আছে, চ্যালেঞ্জও কম নয়। লুঙ্গি উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের মতে, লুঙ্গি ব্যবসা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তারা জানান, সুতার বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে লুঙ্গির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লুঙ্গি তৈরিতে প্রয়োজনীয় রঙ ও রাসায়নিক দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। গ্যাস সরবরাহ এবং দক্ষ কর্মীর অভাবে এ শিল্প এখনো ভুগছে। আরেকটি ব্যাপারেও লুঙ্গি উৎপাদনকারীদের অসন্তোষ আছে। তারা জানান, লুঙ্গি উৎপাদনের জন্য তারা তেমন কোনো ব্যাংকঋণ বা সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। বাংলাদেশের লুঙ্গি রফতানিকারকরা বিশ্বাস করেন, পর্যাপ্ত আকারে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পেলে তারা দেশের জন্য ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসতে পারবেন।