মানিকগঞ্জের ঘিওরের বাঁশ-বেতের পণ্য যাচ্ছে আট দেশে

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় বাঁশ ও বেত শিল্পের নীরব বিপ্লব ঘটেছে। উপজেলার বড়টিয়া ইউনিয়নের শ্রীবাড়ি ঋষিপাড়া গ্রামের বাঁশ ও বেতের তৈরি আধুনিক ও সুদৃশ্য সামগ্রী এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। ওই গ্রামের ১৫০ পরিবার এ কাজে জড়িয়ে আছে। ২০০ বছর ধরে বংশপরম্পরায় এ পেশা আঁকড়ে ধরে আছে পরিবারগুলো। সেখানে অন্তত ৬৫০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক রয়েছেন। এখানকার সামগ্রী

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় বাঁশ ও বেত শিল্পের নীরব বিপ্লব ঘটেছে। উপজেলার বড়টিয়া ইউনিয়নের শ্রীবাড়ি ঋষিপাড়া গ্রামের বাঁশ ও বেতের তৈরি আধুনিক ও সুদৃশ্য সামগ্রী এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। ওই গ্রামের ১৫০ পরিবার এ কাজে জড়িয়ে আছে। ২০০ বছর ধরে বংশপরম্পরায় এ পেশা আঁকড়ে ধরে আছে পরিবারগুলো। সেখানে অন্তত ৬৫০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক রয়েছেন। এখানকার সামগ্রী স্থানীয় বাজার ছাড়াও সাভার, চট্টগ্রাম, এলিফ্যান্ট রোড, ইস্কাটনের বাঁশ-বেতের সামগ্রীর দোকানগুলোতে নিয়মিত বিক্রি হয়।

বিডি ক্রিয়েশন, নেচার ক্রাফট, আড়ং, হিট বাংলাদেশ, তরঙ্গ প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য ক্রয় করে বিদেশে রফতানি করে থাকে। এখান থেকে বর্তমানে বাঁশ ও বেতের পণ্য যাচ্ছে জাপান, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, ফ্রান্স, চীন, ভিয়েতনাম, ইংল্যান্ড, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে। প্রতি মাসে বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্য দেশের বাজারে বিক্রি হয়ে থাকে ২০ লাখ টাকার ওপরে। আর বিদেশে রফতানি হচ্ছে বার্ষিক প্রায় ৬০ লাখ টাকার পণ্যসামগ্রী।

জানা যায়, এ গ্রামের কারিগরদের তৈরি করা এসব পণ্যের স্থানীয় বাজারে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে এ শিল্পে ভাটা পড়ে। অনীহায় পেশা বদল করেছেন অনেকেই। দিন দিন কমে আসছিল শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যা। এমন সময় ঐতিহ্যবাহী এই কুটির শিল্পকে রক্ষায় এগিয়ে আসে উপজেলা প্রশাসন।

ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হামিদুর রহমান কয়েকটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এখানকার উৎপাদিত কুটির সামগ্রীর অনলাইনভিত্তিক বিশ্ববাজারজাতকরণের যাবতীয় ব্যবস্থা করেন। এখন ১৫০ সদস্যের একটি সমবায় সমিতির মাধ্যমে নিজেরাই তাদের পণ্যের বাজারজাত করছেন।  বিক্রি করছেন দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্তত আট দেশে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিম্ন আয়ের এ কুটির শিল্পীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে নতুন অফিস ঘর। সেখানে রয়েছে ল্যাপটপ, প্রিন্টার, মডেম, ডিএসএলআর ক্যামেরা, রাউটারসহ অন্যান্য উপকরণ। দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ। এখানে বসেই অনলাইনে দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পণ্যের নমুনা দেখাচ্ছেন। অর্ডার অনুযায়ী পণ্য তৈরি করে ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে। ফলে ঘুরে যাচ্ছে তাদের ভাগ্য। আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে পরিবারগুলো।

ওই গ্রামের ঘরে ঘরে নারী-পুরুষরা বাঁশ ও বেত দিয়ে নানা শোপিস তৈরিতে ব্যস্ত। নারীরা বাঁশ-বেতের বেনি তুলছেন, সেই বেনি দিয়ে পুরুষরা বুনছেন সামগ্রী। তাতে করছেন সুই-সুতার কারুকার্যের সেলাই। বাঁশ-বেতের ঝুড়ি, ফুড বাস্কেট, পেপার বাস্কেট, ওভাল ট্রে, রাউন্ড ট্রে, স্কয়ার ট্রে, আয়নার ফ্রেম, লন্ড্রি বাস্কেট, দোলনা, লেমজার বাতি, মোড়া, চেয়ার, টেবিল, মহিলাদের ব্যাগ, ওয়ালমেট, খোল, ধামা, কাঠা, রিং, সিলিন্ডার, ফুটকাপ, দাঁড়িপাল্লা, কুলা, ডালা, ঝুড়ি, চালুন, চাটাই মোড়া, খালোই, টুরকি, আমব্রেলা স্ট্যান্ড, হাতপাখা, ফুলের টবসহ বাঁশ ও বেতের নিত্যব্যবহার্য ১০০ ডিজাইনের সুদৃশ্য সামগ্রী তৈরি করছেন। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও এ কাজে সহায়তা করছে।

স্থানীয় বড়টিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল আলম মোল্লা রওশন বলেন, ‘‌মানিকগঞ্জ জেলার মধ্যে বাঁশ-বেত শিল্পের বড় একটি অংশ ঋষিপাড়া এলাকায়। সরকারিভাবে তাদের অনলাইন মার্কেটিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। আশা করছি এ এলাকার বাঁশ-বেত শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসার ঘটবে।’

বাঁশ-বেত শিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি ভবদিশ সরকার বলেন, ‘‌নিজেদের বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে বাঁশ-বেত শিল্পের সঙ্গে কয়েকশ পরিবার জড়িত রয়েছি। তবে বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি করা পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আমাদের পণ্য এখন বিশ্ববাজারে। আমরা নতুন করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছি।’

এ গ্রামের বাসিন্দা সদ্য পাস করা সিভিল প্রকৌশলী দেবাশীষ সরকার বলেন, ‘‌চাকরির পিছে ছুটছি না। দেশের বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ড আমাদের তৈরি পণ্য নিয়ে দেশের বাইরে রফতানি করছে। তারা আমাদের কাছ থেকে কম মূল্যে জিনিস কিনে উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে। আসলটা ওই সব প্রতিষ্ঠান পেয়ে থাকে। এখন সরাসরি ক্রেতাদের পণ্য প্রদর্শন করে বিক্রি করছি। লাভবান হচ্ছে গোটা গ্রামের বাসিন্দারা।’

নারী শ্রমিক চায়না রানী সরকার, আঁখি সরকার, মনিষা সরকার, স্বর্ণা সরকার বলেন, ‘‌পরিবারের কাজ শেষে বিভিন্ন ধরনের বেতের কাজ করি। আমাদের কাজ হচ্ছে বুনানো, চাপানো, পরিচ্ছন্ন করা। দেশ-বিদেশে বিক্রি বাড়ছে। গড়ে একেকজন ১০ হাজার টাকার মতো আয় করি।’

ঋষিপাড়া গ্রামের মাতব্বর স্বদেশ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘‌বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের আমাদের পণ্যের প্রতি আগ্রহ বেশি। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বাজার সৃষ্টি ও পণ্যের মান আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার প্রশিক্ষণের ফলে আমরা এ কাজে আরো দক্ষতা অর্জন করেছি।’

বাঁশ-বেত শিল্পসামগ্রীর অনলাইন অর্ডার ও পেমেন্টের দায়িত্বে থাকা এ গ্রামেরই বাসিন্দা অর্নপ সরকার বলেন, ‘‌আমাদের সমিতির সদস্যদের তৈরি করা বিভিন্ন সামগ্রী অনলাইনে প্রদর্শন, অর্ডার নেয়ার পাশাপাশি পণ্য সরবরাহ কাজে সহায়তা করছি। বিশ্বের ৮-৯টি দেশের ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আমাদের তৈরীকৃত পণ্যের মান, ডিজাইন ও মূল্য তাদের বেশ পছন্দ। আশা করছি, আগামী এক বছরের মধ্যে বিশ্ববাজারে ঘিওরের বাঁশ-বেত শিল্পের নাম থাকবে সম্মানের স্থানে।’

ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হামিদুর রহমান বলেন, ‘‌এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা তাদের পণ্যের সঠিক দাম পাচ্ছিলেন না মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে। এখানে ২০০ পরিবারকে এ পাইলট প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের সমবায় সমিতি গঠন করে দিয়েছি। অনলাইন কেনাকাটা করার জন্য ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজসহ যাবতীয় উপকরণসামগ্রী স্থাপন করে দেয়া হয়েছে। সেগুলো ব্যবহার করে নিজেরাই নিজেদের পণ্যের বেচাকেনা করছেন। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ফায়দা নিতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে গেছে ঘিওরের কুটির সামগ্রী।’


লেখক: সাংবাদিক

আরও