স্বাধীনতার পরও রাজধানীর উত্তরের টঙ্গী খাল থেকে শুরু হয়ে তুরাগ নদ পর্যন্ত বহমান ছিল কনাই নদ। গত চার দশকে ধীরে ধীরে অস্তিত্ব হারিয়েছে নদটি। মূলত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আবাসন প্রকল্পগুলোই নদটি বিলুপ্ত হওয়ার কারণ বলে দাবি গবেষকদের।
একই সময়ে রাজধানী থেকে বিলীন হয়েছে আরো একটি নদ। যার নাম ছিল পাইনার। বুড়িগঙ্গা থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ও কলাতিয়া ইউনিয়ন হয়ে ধলেশ্বরী নদীতে মিলেছিল এ নদ। অপরিকল্পিত আবাসন ও উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ধীরে ধীরে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে পাইনার নদও।
স্বাধীনতা-পরবর্তী দ্রুত চিত্র পরিবর্তন হতে থাকে ঢাকার। আবাসন ও উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বাণিজ্য-শিক্ষা ও চিকিৎসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে ওঠে এ শহর। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুততম সময়ে ঢাকার এমন রূপান্তরের পুরোটাই হয়েছে অপরিকল্পিত। কোথাও নদী ভরাট করে গড়ে উঠেছে আবাসন, আবার কোথাও বক্স-কালভার্টে বিলীন হয়েছে খাল ও জলাশয়। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্য মতে, আবাসন ও উন্নয়ন প্রকল্পে রাজধানীর মাঝ দিয়ে বয়ে চলা কনাই ও পাইনার নামে দুটি বড় নদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর এমনটা হয়েছে মাত্র চার দশকে। নদ দুটি বিলীন হওয়ার পেছনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) সরকারি সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) ঢাকার হারিয়ে যাওয়া নদী নিয়ে গবেষণা করে। বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পরও রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে অন্তত ১৫টি নদ-নদী প্রবাহিত ছিল। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকায় মোট কতগুলো নদী ও খাল রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে আমরা একটি জরিপ করি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বেশির ভাগ সরকারি সংস্থার কাছেও নদী ও খালের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। একসময় নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ঢাকার নগরসভ্যতা এখন অস্তিত্ব সংকটে। গত চার দশকে এ শহরের বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া নদ-নদীর মধ্যে কনাই ও পাইনার অন্যতম। নদগুলোর বিলুপ্তির পেছনে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও রাজউকের উদ্যোগে গড়ে তোলা আবাসনগুলো দায়ী বলে মনে করি। এছাড়া উত্তরা, বনানী, বনশ্রী, নিকুঞ্জসহ বড় বড় প্রজেক্ট তৈরির সময় কোনো পরিকল্পনা না থাকাও এর কারণ।’
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ১৮৮৮-১৯৪০ সালের ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (সিএস ম্যাপ) অনুযায়ী কনাই নদের দৈর্ঘ্য ছিল ১২ দশমিক ২৮ কিলোমিটার। এর আগে রেনেলের মানচিত্রের (১৭৬৫ সাল) তথ্য বলছে, কনাই নদটি ছিল ১৭ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের। বর্তমানে নদটি দ্বিগুণ খাল ও দিয়াবাড়ী খালের অংশে পরিণত হয়েছে। এ খাল দুটিও দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত।
সিএস ম্যাপ অনুযায়ী ২০২২ সাল পর্যন্ত খালে রূপান্তর হয়ে কনাই নদের দৈর্ঘ্য কমেছে ১ দশমিক ১০ কিলোমিটার। নামে কিংবা বৈশিষ্ট্যে কোনোভাবেই এটি আর নদ নেই বলে দাবি করেছেন মোহাম্মদ এজাজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কনাই নদের কোনো অস্তিত্ব নেই। নদের ন্যূনতম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এটি টিকে আছে খাল হিসেবে। তাছাড়া সরকারি কোনো নথিতেও ঢাকার নদ হিসেবে কনাই নদের নাম পাওয়া যায় না।’
ঢাকার হারিয়ে যাওয়া নদীর তালিকায় রয়েছে পাইনার নদের নামও। ১৭৬৫ সালে রেনেলের মানচিত্রে এর দৈর্ঘ্য উল্লেখ করা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার। সিএস ম্যাপে নদের দৈর্ঘ্য বেড়ে হয়েছে ২৪ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার। বর্তমানে নদের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে পাইনার হাট নামে একটি বড় হাট রয়েছে কেরানীগঞ্জে। বিশাল এ নদটি শুভাঢ্যা খালসহ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন খালে পরিণত হয়েছে। বেশির ভাগ খালেই এখন আর পানিপ্রবাহ নেই।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে যেসব নদী ও খালের অস্তিত্ব রয়েছে, সেগুলোও আকারে অনেক ছোট হয়ে পড়েছে। নদী দখলের পাঁয়তারা এখনো চলছে উল্লেখ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকাসহ সারা দেশ থেকেই অনেক নদী-খাল হারিয়ে গেছে। আমরা নদ-নদীর একটি খসড়া তালিকা প্রণয়ন করেছি। তবে নদী বা খাল দূষণের সঙ্গে সাধারণ মানুষ জড়িত নয়। প্রভাবশালী ও সরকারি সংস্থাগুলোই নদী ও খাল দখল-দূষণ করছে। তালিকা তৈরির কাজ শেষ হলে ঢাকার হারিয়ে যাওয়া নদীর বিষয়ে স্পষ্ট করে বলতে পারব।’